ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৯ মার্চ ২০২৪, ১৫ চৈত্র ১৪৩০

দফায় দফায় বৈঠক করেও হাইকমান্ড বাগে আনতে পারছে না শরিকদের

পৌর নির্বাচন নিয়ে বিএনপি জোটে ক্ষোভ অবিশ্বাস

প্রকাশিত: ০৪:৪৬, ২১ ডিসেম্বর ২০১৫

পৌর নির্বাচন নিয়ে বিএনপি জোটে ক্ষোভ অবিশ্বাস

শরীফুল ইসলাম ॥ আসন্ন পৌরসভা নির্বাচনকে কেন্দ্র করে বিএনপি নেতৃত্বাধীন জোট নড়বড়ে। জামায়াতসহ জোটের ক’টি শরিক দলের সঙ্গে দূরত্ব সৃষ্টি হয়েছে বিএনপির। কোন কোন শরিক দল জোট থেকে বেরিয়ে যাওয়ারও হুমকি দিয়েছে। বিএনপি হাইকমান্ডের পক্ষ থেকে দফায় দফায় চেষ্টা করেও এসব দলকে পুরোপুরি বাগে আনতে পারছে না। জানা যায়, যুদ্ধাপরাধে দায়ে বেশ ক’জন প্রভাবশালী জামায়াত নেতার ফাঁসি হওয়ার পরও ২০ দলীয় জোটের নেতৃত্বদানকারী দল বিএনপি নিরবতা পালন করায় আগে থেকেই জামায়াতসহ ক’টি দল বিএনপির প্রতি ক্ষুব্ধ হয়। আর পৌরসভা নির্বাচনের তফসিল ঘোষণার পর সারাদেশের ৩৩৪টি পৌরসভায় জোটগতভাবে প্রার্থী ঠিক করা নিয়ে বিএনপির সঙ্গে জামায়াত, ইসলামী ঐক্যজোট ও খেলাফত মজলিসের সমঝোতা না হওয়ায় পরস্পরের মধ্যে ক্ষোভ আরও বেড়ে যায়। এরই বহির্প্রকাশ ঘটে ১৯ ডিসেম্বর বিএনপি চেয়ারপার্সন খালেদা জিয়ার গুলশান কার্যালয়ে অনুষ্ঠিত ২০ দলীয় জোটের মহাসচিব পর্যায়ের বৈঠকে। এ বৈঠকে জামায়াত ও ইসলামী ঐক্যজোট অনুপস্থিত থাকে। তবে বৈঠকে উপস্থিত লেবারপার্টি ও খেলাফত মজলিসসহ ২০ দলীয় জোটের কোন কোন প্রতিনিধি ওই ২টি দলের পক্ষ নিয়ে বিএনপির ভারপ্রাপ্ত মহাসচিবের কাছে পৌর নির্বাচনে সমঝোতার ভিত্তিতে প্রার্থী ঠিক করতে না পারায় ক্ষোভ প্রকাশ করেন। বিএনপির একরোখা নীতির কারণেই বিভিন্ন পৌরসভায় জোটগতভাবে প্রার্থী ঠিক করা যায়নি বলেও তারা অভিযোগ করেন। এক পর্যায়ে বৃহত্তর স্বার্থে মির্জা ফখরুল স্থানীয়ভাবে জোটগত একক প্রার্থী ঠিক করার কথা বললে তারা তা এখন তা অসম্ভব বলে সাফ জানিয়ে দেন। আর এ নিয়ে বৈঠকের এক পর্যায়ে বিএনপির ভারপ্রাপ্ত মহাসচিবের সঙ্গে তাদের হটটক হয় বলেও জানা যায়। সূত্র মতে, ২০ দলীয় জোটের মহাসচিব পর্যায়ের বৈঠকে ২টি প্রভাবশালী দল অনুপস্থিত থাকায় জোটে টানাপোড়েনের বিষয়টি স্পষ্ট হয়। অথচ এ বৈঠকের অনেক আগে থেকেই জোটের শরিক দলগুলো বিএনপি হাইকমান্ডের কাছে জোটগতভাবে সারাদেশের সকল পৌরসভার প্রার্থী চূড়ান্ত করার দাবি জানালেও এ দাবি আমলে নেয়া হয়নি। জোটের শরিক দলগুলোর দাবি বিএনপি আমলে না নেয়ার কারণ খুঁজতে গিয়ে জানা যায়, ৩৩৪টি পৌরসভার মধ্যে জামায়াত প্রথমে ৪২টিতে প্রার্থী দেয়। পরে ৩০টি পৌরসভায় জোটগত প্রার্থী দাবি করে বিএনপির কাছে। কিন্তু বিএনপি ১০ থেকে ১২টির বেশি পৌরসভায় জামায়াতকে ছাড় দিতে রাজি হয়নি। এ কারণে শেষ পর্যন্ত ২৮টি পৌরসভায় প্রার্থী চূড়ান্ত করে দলগতভাবে জোর প্রচার শুরু করে। আর জামায়াতের সঙ্গে সমঝোতা করে ইসলামী ঐক্যজোট ২টি এবং খেলাফত মজলিস ৫টি পৌরসভায় প্রার্থী চূড়ান্ত করে জোরালোভাবে প্রচার চালিয়ে যাচ্ছে। ২০ দলীয় জোটের অন্য শরিক দলগুলোর মধ্যে বিএনপির সঙ্গে সমঝোতা করে চট্টগ্রামের সাতকানিয়ায় এলডিপি এবং কুষ্টিয়ার ভেড়ামারায় জাতীয় পার্টি (জাফর) ধানের শীষ প্রতীকে মেয়র প্রার্থী দিয়েছে। কিন্তু এ ২ প্রার্থীর পক্ষেও কাজ করছে না জামায়াত, ইসলামী ঐক্যজোট ও খেলাফত মজলিস। অবশ্য বিএনপি নেতাকর্মীরাও এখন পর্যন্ত কোথাও এ ৩ দলের প্রার্থীদের পক্ষে প্রচারে নামেনি। শনিবার বিএনপি চেয়ারপার্সনের গুলশান কার্যালয়ে ২০ দলীয় জোটের বৈঠক শেষে বিএনপির ভারপ্রাপ্ত মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর সাংবাদিকদের ব্রিফিংকালে বলেন, কোন কোন পৌরসভায় প্রার্থী নিয়ে জোটের সঙ্গে কিছু সমস্যা থাকলেও তা স্থানীয় পর্যায়ে সমাধান করা হবে। তিনি আরও বলেন, সারাদেশের সকল পৌরসভায় ২০ দলীয় জোট সম্মিলিতভাবে প্রচার চালাবে। মির্জা ফখরুলের এ অবস্থান সম্পর্কে জানতে চাইলে নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক ২০ দলীয় জোটের একটি শরিক দলের শীর্ষ পর্যায়ের নেতা বলেন, বিএনপি মহাসচিব তার অবস্থান থেকে প্রার্থী নিয়ে সমস্যার সহজ সমাধানের কথা বললেও তা এত সহজে হবে না। কারণ, বিএনপির একগুয়েমির কারণেই জোটগতভাবে প্রার্থী চূড়ান্ত করা সম্ভব হয়নি। তাই এর মাশুল বিএনপিকেই গুণতে হবে। তবে বিএনপি চেয়ারপার্সন যদি শেষ পর্যন্ত জোটের শীর্ষ নেতাদের এ ইস্যুতে ঐক্যবদ্ধ করতে পারেন তাহলে হয়তো সমস্যার সমাধান হতেও পারে। যেভাবে উপজেলা নির্বাচনে জোটগত প্রার্থী ঠিক করতে অনেকটাই সফল হয়েছিলেন বিএনপি চেয়ারপার্সন খালেদা জিয়া। এ ব্যাপারে বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য লে জেনারেল (অব) মাহবুবুর রহমান বলেন, স্থানীয় সরকার নির্বাচনে জোটগতভাবে প্রার্থী চূড়ান্ত করা কঠিন হয়ে পড়ে। কারণ, একেক এলাকায় একেক দলের প্রাধান্য থাকতে পারে। এসব এলাকায় সব দলই চায় তাদের আধিপত্য বজায় রাখতে। আর যখন জোট থেকে সিদ্ধান্ত চাপিয়ে দেয়া হয় তখন স্থানীয় পর্যায়ের নেতাদের তা মানতে কষ্টসাধ্য হয়ে পড়ে। তবে পৌরসভা নির্বাচনে প্রার্থী নিয়ে সাময়িক সমস্যা হলেও এ নিয়ে ২০ দলীয় জোট ভেঙে যাবে না। নির্বাচনের পর সবকিছু আবার ঠিক হয়ে যাবে। আর অতীতে জোটের কোন কোন নেতা চলে গেলেও অন্য নেতারা আবার ওই দলের হাল ধরে জোটে রয়ে গেছেন। খোঁজ নিয়ে জানা যায়, ইসলামী ঐক্যজোট প্রথমে ১০ পৌরসভায় মেয়র পদে প্রার্থী দিতে চাইলেও পরে নরসিংদী সদর এবং বগুড়া সদর পৌরসভায় মেয়র পদে প্রার্থী দেয়। নরসিংদীতে প্রার্থিতা বাতিল হলেও বগুড়ায় এখনও দলগতভাবে প্রচার চালাচ্ছে ইসলামী ঐক্যজোট। আর টাঙ্গাইল সদর, মানিকগঞ্জের সিংগাইর, সিলেটের জকিগঞ্জ, গোলাপগঞ্জ ও মৌলভীবাজারের কমলগঞ্জে মেয়র পদে প্রার্থী দিয়েছে খেলাফত মজলিস। বিএনপির সঙ্গে দূরত্ব বজায় রেখেই তারা প্রচার চালিয়ে যাচ্ছে। বিএনপির কেন্দ্রীয় নেতারা এ নিয়ে ইসলামী ঐক্যজোট ও খেলাফত মজলিসের নেতাদের সঙ্গে কথা বলেও এখন পর্যন্ত কোন সমাধান করতে পারেননি। তাই এখন এ সমস্যার সমাধানের দায়িত্ব স্থানীয় জোট নেতাদের ওপর ছেড়ে দেয়া হয়েছে। অবশ্য জোটের বৈঠক শেষে বিএনপির ভারপ্রাপ্ত মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীরও বলেছেন এ সমস্যার সমাধান স্থানীয়ভাবেই করা হবে। সূত্র মতে, দীর্ঘদিন ধরে বিভিন্ন কারণে বিএনপির প্রতি নাখোশ থাকায় ২০ দলীয় জোট থেকে বেরিয়ে যেতে চাচ্ছে ইসলামী ঐক্যজোট ও জমিয়তে উলামায়ে ইসলাম। বিএনপি সহসা ক্ষমতায় যাওয়ার সম্ভাবনা না থাকায় এ ২ দলের নেতারা এখন সরকারী দলের নেতাদের সঙ্গে সম্পর্ক উন্নয়নের চেষ্টা চালাচ্ছেন বলে জানা গেছে। এরই অংশ হিসেবে বিজয় দিবসে রাষ্ট্রপতির আমন্ত্রণে বঙ্গভবনেও গিয়েছিলেন ইসলামী ঐক্যজোটের চেয়ারম্যান আব্দুল লতিফ নেজামী, মহাসচিব মুফতি ফয়জুল্লহ, সিনিয়র ভাইস-চেয়ারম্যান মুফতি আমিনীর বড় ছেলে আবুল হাসনাত আমিনী ও সিনিয়র নেতা মাওলানা জুবায়ের আহমেদ, জমিয়তে উলামায়ে ইসলামের নির্বাহী সভাপতি মুফতি মুহম্মদ ওয়াক্কাস, মহাসচিব মহীউদ্দিন একরাম ও সাংগঠনিক সম্পাদক মুফতি রেজাউল করিম। এ ২ দলের নেতারা মনে করছেন বিএনপির সঙ্গে জোটে থাকলে মামলাসহ বিভিন্নভাবে হয়রানির শিকার হতে হচ্ছে। তাই এখন বিএনপি জোট থেকে বের হয়ে গেলে এ হয়রানি থেকে বাঁচা যাবে। ৭ জানুয়ারি ইসলামী ঐক্যজোটের কাউন্সিল হওয়ার কথা রয়েছে এবং ওই কাউন্সিল থেকে ২০ দলীয় জোট ত্যাগের ঘোষণা আসতে পারে। তবে বিএনপি হাইকমান্ডের পক্ষ থেকে এ ২ দলের শীর্ষ নেতাদের সঙ্গে সার্বক্ষণিক যোগাযোগ রাখা হচ্ছে। তারপরেও যদি তারা জোট থেকে চলে যান তাহলে এ ২ দলের নেতৃত্বে নতুন শীর্ষ নেতাকে এনে ২০ দলীয় জোটে রাজনৈতিক দলের সংখ্যা ঠিক রাখার চেষ্টা করা হবে বলে বিএনপি সূত্রে জানা যায়।
×