ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৯ মার্চ ২০২৪, ১৫ চৈত্র ১৪৩০

চাই আধুনিকায়ন

প্রকাশিত: ০৪:০১, ২৪ ডিসেম্বর ২০১৫

চাই আধুনিকায়ন

মোঃ রফিকুল ইসলাম মহান মুক্তিযুদ্ধের দিনগুলোয় আমি যখন ৫ বছরের শিশু, ঠিক তখনই প্রথম শুনেছিলাম পোস্ট অফিস শব্দটি। কারণ, মুক্তি কামনার সেই উত্তাল দিনগুলোয় আমার এক সহোদর ভাই ও প্রতিবেশী এক বোনের জন্ম হওয়ায় তাদের সুন্দর দু’টি নামের জন্য চিঠি লেখা হচ্ছিলো নেত্রকোনা কলেজে অধ্যাপনারত আমার একমাত্র চাচা শহীদ বুদ্ধিজীবী অধ্যাপক আরজ আলীকে। যথারীতি চিঠি লেখা শেষ হলে সেটিকে পোস্ট করার জন্যে পাঠানো হয়েছিল বাড়ি থেকে তিন কিলোমিটার দূরে বিরিশিরি পোস্ট অফিসে। এর কিছুদিন পরে ডাকপিয়ন নেত্রকোনা থেকে আমার চাচার লেখা একটি চিঠি আমার বাবার হাতে দিয়ে যায়। সেই চিঠিতে তিনি আমার ভাইটির নাম রেখে পাঠিয়েছিলেন ‘মুজিব’ এবং প্রতিবেশী বোনটির নাম রেখেছিলেন ‘রাষ্ট্রন্নেসা’। মুক্তিযুদ্ধে সাংগঠনিক কাজ ও সহযোগিতাদানের অভিযোগে পাকি বর্বর বাহিনী ও এদেশীয় দালালেরা ১৬ আগস্ট ১৯৭১ সালে তাঁকে হত্যা করে। তাঁর আত্মদানের স্বীকৃতিস্বরূপ ১৯৯৪ সালে বাংলাদেশ ডাকবিভাগ তাঁর ছবি সংবলিত স্মারক ডাকটিকেট প্রকাশ করে। তৎকালীন ডাক ও টেলিযোগাযোগ মন্ত্রী আমার বাবাকে শোক, সহমর্মিতা ও কৃতজ্ঞতা জানিয়ে একটি চিঠি এবং শহীদ বুদ্ধিজীবীদের ছবি সংবলিত কিছু স্মারক ডাকটিকেট পাঠিয়েছিলেন এই পোস্ট অফিসের মাধ্যমেই। ১৯৭৭ সালে বিরিশিরি মিশনারি স্কুলে ষষ্ঠ শ্রেণিতে ভর্তি হওয়ার পরে পোস্ট অফিসের চিঠি আদান-প্রদান বহির্ভূত আরও কিছু কাজের সঙ্গে পরিচিত হয়ে উঠি। সেই সুবাদে, পছন্দমতো বিভিন্ন দৈনিক, সাপ্তাহিক ও মাসিক পত্রিকার গ্রাহক-চাঁদা পোস্ট অফিসে মানিঅর্ডার করে পাঠিয়ে দিতাম এবং কিছুদিন পর থেকে সেই কাক্সিক্ষত পত্রিকা-সাময়িকীগুলো আমাদের হাতে এসে পৌঁছুতো। আমরা এ পোস্ট অফিসের কল্যাণেই বিশ্বের অজানাকে জানার সুযোগ পেতাম। দেশীয় পত্র-পত্রিকার পাশাপাশি সে সময় ডাকযোগে আমাদের হাতে এসে পৌঁছুতো বিদেশী উদয়ন, সোভিয়েত ইউনিয়ন, সোভিয়েত নারী, ভারত বিচিত্রা ও চায়না পিক্টোরিয়াল নামক সাময়িকীগুলো। এই পোস্ট অফিসের মাধ্যমে বিশ্বের পঁয়ত্রিশটি বেতারকেন্দ্রে চিঠি লিখে যোগাযোগ করতাম, শুভেচ্ছাস্বরূপ তারা উপহার পাঠাতো স্যুভেনির, ভিউকাডর্, ক্যালেন্ডার ইত্যাদি। গ্রামে বসেই এই পোস্ট অফিসের মাধ্যমেই আমরা বিদেশের সঙ্গে যোগাযোগ করতাম। পার্সেল, মানিঅর্ডার, ক্ষুদ্র সঞ্চয়- সবই করতে দেখতাম পোস্ট অফিসের মাধ্যমেই। কিন্তু চিঠিই ছিল পোস্ট অফিসের মূল উপজীব্য। এই চিঠিকে কেন্দ্র করে পৃথক এক ভাষারীতি ও সাহিত্যও গড়ে উঠেছিল এ দেশে। কবিগুরুর জাপান ও রাশিয়ার চিঠিও তো সেকথার বড় প্রমাণ। আজ পোস্ট অফিসের বিকল্প হিসেবে কাজ করছে ইন্টারনেট, কুরিয়ার সার্ভিস, সেলফোন ইত্যাদি। যোগাযোগের এ মাধ্যম যত যান্ত্রিক ও ত্বরিত হচ্ছে ঠিক ততই যেন কমে যাচ্ছে সম্পর্কের আবেগ ও নিবিড়তা। অবস্থাদৃষ্টে মনে হচ্ছে, পোস্ট অফিসের কার্যকলাপের পুরনো পদ্ধতি ও তালিকার পরিবর্তন না ঘটালে অচিরেই এর বিলুপ্তি ঘটবে। অথচ, সবেমাত্র আংশিক বিদ্যুতায়িত ব্যাপক জনসংখ্যার বাংলাদেশে প্রত্যন্ত এলাকায় যোগাযোগ ও কর্মসংস্থানের ক্ষেত্রে পোস্ট অফিসের গুরুত্ব এখনও ফুরিয়ে যায়নি। প্রতিটি পোস্ট অফিসকে বিদ্যুতায়িত করার মাধ্যমে এটিকে জনগণের দোরগোড়ার একেকটি ‘রুরাল কমিউনিকেশন অ্যান্ড সেভিংস সেন্টার’-এ রূপান্তরিত করা যেতে পারে। যেখানে পুরনো পদ্ধতির পাশাপাশি কম্পিউটার, সেলফোন ও ব্যাংকিং সুযোগ-সুবিধাসমূহ গ্রাহকদের প্রদান করা হবে। এর ফলে এ পোস্ট অফিসগুলো লোকসান কাটিয়ে ওঠার পাশাপাশি নতুন নতুন কর্মসংস্থানও সৃষ্টি করবে। এ আধুনিকায়নের মাধ্যমে বেঁচে থাকবে পোস্ট অফিস সংশ্লিষ্ট পেশা ও সেবাসমূহ । দুর্গাপুর, নেত্রকোনা থেকে
×