ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ১৮ এপ্রিল ২০২৪, ৫ বৈশাখ ১৪৩১

অপূর্ব কুমার কুণ্ডু

প্রেমের অমরগাথা সোনাই মধাব

প্রকাশিত: ০৬:১৪, ২৪ ডিসেম্বর ২০১৫

প্রেমের অমরগাথা সোনাই মধাব

ভোগ সর্বস্বতা আর সবকিছুরই দখলদারিত্বের এই ভঙ্গুর সময়ে মানুষ যখন উপলব্ধি করে কোন কিছ্ ুকিছু না ততক্ষণে বেলা গড়িয়ে কালবেলা। মাঝখান থেকে একের লালসা আর অপরের মরণদশা। মহাকালের বিচারে লোলুপ হয় নর্দমার আঁস্তকুড়ে নিক্ষিপ্ত আর ত্যাগের প্রতিভু হয় সকাল কালে সকলের দ্বারা আদৃত। অনেকটা সেরকম আমাদের সংস্কৃতির তীর্থস্থান ময়মনসিংহের বহুল আলোচিত চরিত্র দেওয়ান ভাবনা এবং প্রেমিক যুগল সোনাই মাধব। প্রেমিকা সোনাইয়ের প্রতি মাধবের ভালবাসা, ভালবাসাকে অর্থ পূর্ণতা দিতে বিবাহ, ঘর বাঁধবার মুহূর্তে দেওয়ান ভাবনার হিংস্রতায় ক্ষত-বিক্ষত দুটি ব্যাকুল হৃদয়ের রক্তক্ষরণ এবং চিরবিচ্ছেদের আর্তিগাঁথা সোনাই মাধব। লোক নাট্যদল প্রযোজিত, পরিকল্পক ও নির্দেশক লিয়াকত আলী লাকী পরিকল্পিত ও নির্দেশিত, ময়মনসিংহ গীতিকা অবলম্বনে পদাবলী যাত্রা সোনাই মাধব মঞ্চস্থিত হলো গত ১৮ ডিসেম্বর শিল্পকলা একাডেমির স্টুডিও থিয়েটার হলে। হলে না বরং জীবনের কোলাহলে জন্মসূত্রে সোনাইয়ের প্রাপ্তি অতুলনীয় রূপ আর বিচিত্র কর্মসূত্রে গুণ। বাবাকে হারিয়ে, ভাইকে না পেয়ে একমাত্র অবলম্বন অসহায় মা। শৈশব- কৈশর ডিঙ্গিয়ে, যৌবনে পা রাখা সোনাইকে উপযুক্ত পাত্রে পাত্রস্থ করার আশায় মামার কাছে সোনাইয়ের আশ্রয়। যোগ্য পাত্রের দেখা নাই কিন্তু লোকচক্ষুর আড়ালে সোনাইয়ের সঙ্গে মাধবের পরিচয়-প্রেম আর অব্যক্ত পঙ্ক্তি মালয়ে পত্রের আদান প্রদান। আকাশ উড়ে উড়ে শকুন যেভাবে ডাঙ্গার মরা খোঁজে তেমনিভাবে দেওয়ান ভাবনা লাস্য রমণী খোঁজে। সোনাইয়ের সন্ধান পেয়ে প্রথম দফায় হরণ এবং সেক্ষেত্রে ব্যর্থ হয়ে দ্বিতীয় দফায় কৌশলে বশীকরণ। কৌশলের প্রথম পর্বে মাধবের বাবাকে বন্দী করা, ছেলে মাধবের বিনিময়ে বাবাকে ছেড়ে দেয়া আর মুক্ত শ্বশুরের অনুরোধে সোনাইয়ের জীবনের বিনিময়ে সন্তান মাধবের মুক্তি লাভ। স্বামী মাধবকে ছেড়ে দেয়ার শর্তে সোনাই দেওয়ান ভাবনার ঘরে যায় কিন্তু স্বর্ণ পালঙ্কে শুয়ে বিষ পানে সোনাই আত্মাহুতি দেয়। আর নিরুদ্দশা সোনাইয়ের খোঁজে নদীর পাড়ে বিবাগী মাধব দিবা-নিশি অশ্রু সজল নয়নে নৌকার পানে চেয়ে রয় পাছে যদি তার প্রাণাধিক প্রিয় সোনাই এর দেখা পায়। বিরহ-বিলাপ আর আর্তনাদের মধ্য দিয়ে সোনাই মাধব মঞ্চায়ন শেষ হয়। মঞ্চায়নের প্রারম্ভে মঞ্চের দু’প্রান্ত জুড়ে যন্ত্রী-অভিনেতা-অভিনেত্রী-গায়কী এবং নৃত্যশিল্পীদের শৃঙ্খলভাবে বসা, উঠানের আদোলে মঞ্চ নির্মাণ, হ্যাজাকের আলোয় গ্রামের কৌতূহলী নীরবতা, বন্ধনা আবহ প্রভৃতি চঞ্চল সময়কে সাময়িক হলেও প্রশান্তি অবকাশের সুযোগ করে দেয় নির্দেশক লিয়াকত আলী লাকীর মরমীয় নির্দেশনায়। অজস্র সুর আর ছন্দের দোলায় পুরো পালার গল্পের বয়ান করতে পারায়, প্রতিটি বাক্যের অন্তর্নিহিত অর্থের সঙ্গতিপূর্ণ নাটকীয় অভিনয়, লাইভ মিউজিকের তীব্র দোত্যনা, অসংখ্য স্বল্প চরিত্রের স্বতন্ত্র প্রকাশমানতা, সুনাই-মাধব এবং দেওয়ান ভাবনার অসম্ভব জীবন রস রসাস্বাধনে লিয়াকত আলী লাকী ব্যতিক্রম-নান্দনিক এবং প্রতি নিধিত্বশীল। তাঁর এবং তাঁর দলের দলীয় অভিনয় সমৃদ্ধ প্রযোজনা সোনাই মাধব আগামী ২৭ নবেম্বর কলকাতার গঙ্গা যমুনা নাট্যোৎসবে যে বাংলাদের নদী-জল-মাটি-মানুষের সুর কে তুলে ধরবে, রসাস্বাদনে আপ্লুত করবে অগণিত দর্শককে সেখানেই সান্ত¡না। শেক্সপীয়ার যদি ব্রিটেনের প্রতিনিধিত্ব করতে পারে বিশ্ববলয়ে তবে ময়মনসিংহ গীতিকাও পারবেও বাংলাদেশকে চিনিয়ে দিতে বহির্বিশ্বে সোনাই মাধব মঞ্চায়নের অবয়বে।
×