ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ২৫ এপ্রিল ২০২৪, ১২ বৈশাখ ১৪৩১

গোলাম মোস্তফা

আমিনার কোলে

প্রকাশিত: ০৪:৩৬, ২৫ ডিসেম্বর ২০১৫

আমিনার কোলে

রবিউল আউয়াল মাসের বারো তারিখ। সোমবার। শুক্লা-দ্বাদশীর অপূর্ণ-চাঁদ সবেমাত্র অস্ত গিয়াছে। সুবহে-সাদিকের সুখ-নূরে পূর্ব আসমান রাঙা হইয়া উঠিতেছে। আলো-আঁধারের দোল খাইয়া ঘুমন্ত প্রকৃতি আঁখি মেলিতেছে। বিশ্বপ্রকৃতি আজ নীরব। নিখিল সৃষ্টির অন্তরতলে কি যেন একটা অতৃপ্তি ও অপূর্ণতার বেদনা রহিয়া রহিয়া হিল্লোলিত হইয়া উঠিতেছে। কোন্ স্বপ্নসাধ আজও যেন তার মিটে নাই। যুগ-যুগান্তরের পুঞ্জীভূত সেই নিরাশার বেদনা আজও যেন জমাট বাঁধিয়া দাঁড়াইয়া আছে। আরবের মরু-দিগন্তে মক্কা-নগরীর এক নিভৃত কুটিরে একটি নারী ঠিক এই সময়ে সুখস্বপ্ন দেখিতেছিলেন। নাম তাঁর আমিনা। আমিনা দেখিতেছিলেন : এক অপূর্ব নূরে আসমান-যমীন উজালা হইয়া গিয়াছে। সেই আলোকে চন্দ্র-সূর্য-গ্রহ-তারা ঝলমল করিতেছে। কার যেন আজ শুভাগমন, কার যেন আজ অভিনন্দন। যুগ-যুগান্তের প্রতীক্ষিত সেই না-আসা অতিথির আগমনমুহূর্ত আজ যেন আসন্ন হইয়া উঠিয়াছে। তাঁরই অভ্যর্থনার জন্য আজ যেন এই আয়োজন। কুল-মাখলুক আজ সেই আনন্দে আত্মহারা। গগনে গগনে ফেরেশতারা ছোটাছুটি করিতেছে, তোরণে-তোরণে বাঁশি বাজিতেছে। সবাই আজ বিস্মিত পুলকিত কম্পিত শিহরিত। জড়-প্রকৃতির অন্তরেও আজ দোলা লাগিয়াছে; খসরুর রাজপ্রাসাদের স্বর্ণচূড়া ভাঙিয়া পড়িয়াছে; ‘কাবা-মন্দিরের’ দেব-মূর্তিগুলি ভূলুণ্ঠিত হইয়াছে; সিরিয়ার মরুভূমিতে নহর বহিতেছে। আমিনার কুটিরেই বা আজ এ-কি অপরূপ দৃশ্য। কারা ওই শ্বেতবসনা পুণ্যময়ী নারী? বিবি হাওয়া, বিবি হাজেরা, বিবি রহিমা, বিবি মরিয়ম, সবাই আজ তাঁর শিয়রে দ-ায়মান। বেহেশতী নূরে সারা ঘর আজ আলোকিত। বেহেশতী খুশবুতে বাতাস আজ সুরভিত। এক স্নিগ্ধ পবিত্র চেতনার মধ্যে আমিনার স্বপ্ন ভাঙিল। আঁখি মেলিয়া চাহিয়া দেখিলেনÑ কোলে তাঁহার পূর্ণিমার চাঁদ হাসিতেছে। সঙ্গে সঙ্গে সারা সৃষ্টির অন্তর ভেদিয়া ঝঙ্কৃত হইল মহাআনন্দ ধ্বনিÑ “খুশ আমদিদ ইয়া রসূলুল্লাহ!” “মারহাবা ইয়া হাবীবুল্লাহ!” বেহেশতের ঝরোকা হইতে হুর-পরীরা পুষ্পবৃষ্টি করিতে লাগিল; অনন্ত আকাশে অনন্ত গ্রহ-নক্ষত্র তসলিম জানাইল। বিশ্ববীণাতারে আগমনী-গান বাজিয়া উঠিল। নীহারিকা-লোকে, তারায় তারায়, অণু-পরমাণুতে আজ কাঁপন লাগিল। সবার মধ্যে আজ যেন কিসের একটা আবেগ, কিসের একটা চাঞ্চল্য। সবারই মুখে আজ বিস্ময়! সবারই মুখে আজ কি-যেন এক চরম পাওয়ার পরশ আনন্দ সুপ্রকট। প্রভাত সূর্য-রশ্মি-করাঙ্গুলি বাড়াইয়া নব-অতিথির চরণ-চুম্বন করিল; বনে বনে পাখিরা সমবেত কণ্ঠে গাহিয়া উঠিল; সমীরণ দিকে দিকে তাঁহার আবির্ভাবের খুশ-খবর লইয়া ছুটিয়া চলিল। ফুলেরা স্নিগ্ধ হাসি হাসিয়া তাহাদের অন্তরের গোপন সুষমাকে নযরানা পাঠাইল। নদ-নদী ও গিরি-নির্ঝর উচ্ছ্বসিত হইয়া আনন্দ-গান গাহিতে গাহিতে সাগরপানে ছুটিয়া চলিল। জলে-স্থলে, লতায়-পাতায়, তৃণে-গুল্মে, ফুলে-ফলে আজ এমনি অবিশ্রান্ত কানাকানি আর জানাজানি। যার আসার আশায় যুগযুগান্ত ধরিয়া সারা সৃষ্টি অধীর আগ্রহে প্রহর গণিতেছিল, সে যেন আসিয়াছেÑ এই অনুভূতি আজ সর্বত্র প্রকট। আরবের মরুদিগন্তে আজ এ কী আনন্দোচ্ছ্বাস, মরি! মরি! আজ তার কী গৌরবের দিন। সবচেয়ে যে নিঃস্ব, সবচেয়ে যে রিক্ত, তারই অন্তর আজ এমন করিয়া ঐশ্বর্যে ভরিয়া গেল। চরম রিক্ততার অধিকারেই কি সে আজ এমন চরম পূর্ণতার গৌরব লাভ করিল। বেদুঈন বালারা অকস্মাৎ ঘুম হইতে জাগিয়া উঠিয়া অবাক বিস্ময়ে চাহিয়া রহিল। দিগন্ত-বিস্তৃত উষর মরুর দিকে দিকে আজ এ কী অপূর্ব দৃশ্য! এত আলো, এত রূপ কোথা হইতে আসিল আজ? আজিকার প্রভাত এমন স্নিগ্ধপেলব হইয়া দেখা দিল কেন? খর্জুর-শাখায় আজ এত শ্যামলিমা কে ছড়ায়ে দিল? মেষ শিশুরা আজ উল্লসিত কেন? নহরে-নহরে এত স্নিগ্ধ বারিধারা আজ কোথা হইতে আসিল? কিসের উল্লাস আজ দিকে দিকে? আকাশ পৃথিবীর সর্বত্র এমনই আলোড়ন। ছন্দ-দোলায় সারা সৃষ্টি আজ যেন দোল খাইতে লাগিল। জড়-চেতন সকলের মধ্যেই আজ চরম পাওয়ার পরম তৃপ্তি সুপ্রকট। কোথাও ব্যথা নাই, বেদনা নাই, দুঃখ নাই, অভাব নাই। সব রিক্ততার আজ যেন অবসান ঘটিয়াছে, সব অপূর্ণতা আজ যেন দূরীভূত হইয়াছে। বিশ্বভুবনে আল্লাহ্্র অনন্ত আশীর্বাদ ও অফুরন্ত কল্যাণ নামিয়া আসিয়াছে। আকাশে-বাতাসে, জলে-স্থলে, লতায়-পাতায়, জড়-চেতনে আজ যেন সার্থকতা ও পরিপূর্ণতার এক মহাতৃপ্তি ভাসিয়া বেড়াইতেছে। মহাকাল-ঋতুচক্রে আজ কি প্রথম বসন্ত দেখা দিল? প্রকৃতির কুঞ্জবনে আজ কি প্রথম কোকিল গান করিল? কে এই নব অতিথি! কে এই বেহেশ্তী নূর- যাঁহার আবির্ভাবে আজ দ্যুলোকে-ভূলোকে এমন পুলক-শিহরণ লাগিল? এই মহামানবশিশুই আল্লাহ্্র প্রেরিত সর্বশ্রেষ্ঠ এবং সর্বশেষ পয়গম্বর- নিখিল বিশ্বের অনন্ত কল্যাণ ও মূর্ত আশীর্বাদ- মানব জাতির চরম এবং পরম আদর্শ- স্রষ্টার শ্রেষ্ঠ সৃষ্টি- বিশ্বনবী- হযরত মুহম্মদ (সাল্লাল্লাহু আলায় হি অ-সাল্লাম)। সূত্র : কবি গোলাম মোস্তফা (বিশ্বনবী থেকে)
×