ঢাকা, বাংলাদেশ   মঙ্গলবার ২৩ এপ্রিল ২০২৪, ১০ বৈশাখ ১৪৩১

আবুল মাল আবদুল মুহিত

ছেলেবেলা ও ছাত্রজীবন

প্রকাশিত: ০৪:৩৯, ২৫ ডিসেম্বর ২০১৫

ছেলেবেলা ও ছাত্রজীবন

ছাত্রজীবনের অবসান (২৩ ডিসেম্বরের পর) আমার খুব ভাল লাগত, ছাত্র-ছাত্রীরা অত্যন্ত আগ্রহের সঙ্গে ক্লাস করত, নোট নিত এবং নানা প্রশ্ন করত। প্রায়ই আমাকে নির্দিষ্ট ক্লাসের চেয়ে বেশি ক্লাস নিতে হতো। ১০ এপ্রিল আমার এই খণ্ডকালীন চাকরি শেষ হলো। তারপর সম্ভবত স্কুল-কলেজে ছুটি শুরু হয়ে গেল। অন্যদিকে মাস দুয়েক টিউশনি করার পর আমার মনে হলো, আমার ছাত্রী উচ্চ মাধ্যমিক পরীক্ষার জন্য যথেষ্ট প্রস্তুত। তখন তাকে এবং তার আব্বাকে বললাম, আমার আর টিউশনি করার প্রয়োজন নেই। তখন মোর্শেদী সাহেব বললেন, অন্যান্য বিষয়ে আপনি আমার মেয়েকে সাহায্য করলে খুব ভাল হবে। সুতরাং প্রায় মাসখানেক আমি ইতিহাস, লজিক, বাংলা ইত্যাদি বিষয়ে টিউশনি করলাম। তারপর আর একদিন আমার ছাত্রীকে বললাম, ‘কামরুন্নেসা, এখন তুমি নিজে পড়াশোনা কর। আশা করি তুমি পরীক্ষায় ভাল করবে।’ এই টিউশনি শেষ করার পরেই জ্যোতির্ময় স্যার বললেন, ‘তোমার জন্য আর একটা টিউশনি আছে। এবারে বিএ ক্লাসের ছাত্রীকে ইংরেজী পড়াতে হবে।’ আমি বললাম, ‘স্যার, টিউশনি করতে পারব, তবে সপ্তাহে তিনদিনের বেশি সময় দিতে পারব না।’ স্যার বললেন, ‘তথাস্তু! এখানে মাসে দেড়শ’ টাকা পাবে।’ কাকরাইলের অদূরে এক নতুন বসতিতে এই ছাত্রীকে পড়াতে যেতাম। কয়েকদিনেই আমার মনে হলো, ছাত্রীটির কোন সহায়তার প্রয়োজন নেই। সে বেশ ভাল ছাত্রী। তার সমস্যা হচ্ছে পরীক্ষাভীতি, সেজন্য ছিল অত্যধিক নার্ভাস। আমি তার পড়া দেখতাম; কিন্তু বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই তাকে খুব উৎসাহ দিতাম। বলতাম, সে তো খুব ভাল ছাত্রী। আর একটু আত্মবিশ্বাস থাকলেই সে খুব ভাল করবে। তাকে পড়িয়েও আনন্দ ছিল। কারণ, সে সহজেই বুঝতে পারত এবং কোন বিষয় আয়ত্ত করার জন্য যথেষ্ট মেধা ছিল। এই ছাত্রীকে মাস-দেড়মাস পড়িয়েই আমার মনে হলো, তার সঙ্গে আর সময় নষ্ট করার কোন কারণ নেই। তাকে বললাম, ‘এখন তোমার নিজের রাস্তা দেখ।’ সে মেয়েটি ছিল পরবর্তীকালে জেনারেল পদে উন্নীত গোলাম দস্তগীরের বোন; সে থাকত তার আরেক ভাই আজমিরীর সঙ্গে। আমার দুই ছাত্রীই তাদের পরীক্ষায় ভালভাবে পাস করে এবং দ্বিতীয় ছাত্রীটি পরবর্তীকালে আমার এক সহপাঠীকে বিয়ে করে। তার সঙ্গে দ্বিতীয়বার দেখা হয় করাচিতে ১৯৬৯ সালে। তখন সে আমার বন্ধুর গৃহিণী। সেই বন্ধুটির পুরো নাম ভুলে গেছি, তবে তার শেষ নাম ছিল জামান; কেন্দ্রীয় পাবলিক সার্ভিস কমিশনে সে চাকরি করত। সম্ভবত বাংলাদেশ হওয়ার কিছুদিন পরেই অকালে মৃত্যুবরণ করে। আমার প্রথম ছাত্রীটির বিয়ে হয় সম্ভবত বিএ পাস করার আগেই আমাদের এক বন্ধু সলিমুল্লাহ হলের আমার দুই বছরের জ্যেষ্ঠ ছাত্র নাসির উদ্দিন আহমদের সঙ্গে। নাসির উদ্দিন আহমদ ছিলেন তখন পূর্ব পাকিস্তানের রেল বোর্ডে একজন ট্রাফিক অফিসার। তিনি ১৯৭১ সালের একজন গর্বিত শহীদ। তার বিধবা স্ত্রী কামরুন্নেসার সঙ্গে আমার দেখা হয় দ্বিতীয়বার যখন আমি বাংলাদেশ সরকারের সচিব ছিলাম। কোন এক সামাজিক আসরে সেই মোলাকাত হয়। টিউশনির কথা সম্পূর্ণ হবে না যদি আমার তৃতীয় টিউশনের কথা না বলি। এবারে আমার ছাত্রী ছিলেন আমারই সহপাঠী অধ্যাপক রোকেয়া সুলতানা। তিনি আমাদের সঙ্গে এম এ দ্বিতীয় বর্ষে পড়তেন; কিন্তু আমাদের সঙ্গে পরীক্ষা দেয়া থেকে বিরত থাকেন। বিশ্ববিদ্যালয়ে এমনি গিয়েছি, দো-তলায় শিক্ষকদের কামরায় কিছুক্ষণ বসে, মধুর ক্যানটিনে যাব। রাস্তায় আমাকে আমার এক বা বছর দুয়েকের সিনিয়র একজন ছাত্রী বললেন, আপনি একটু আমার আব্বার সঙ্গে দেখা করতে আসবেন। তাকে আমি আপা বলে ডাকতাম। তার পিতা ছিলেন পূর্ব বাংলা শিক্ষা বিভাগের যুগ্ম-সচিব মোহাম্মদ আমিনুল্লাহ এবং সেগুনবাগিচায় ছিল তার বাসস্থান। নির্দিষ্ট দিনে আমি যথাস্থানে গেলাম। আমিনুল্লাহ সাহেব আমাকে বসতে বললেন এবং বেশি ভনিতা না করে সরাসরি বললেন, ‘বাবা আপনাকে আমি ডেকেছি আমার লাজুক এক মেয়ের হয়ে একটি অনুরোধ করতে। আমার বেশ কয়েকটি মেয়ে আছে, ছেলে দুটো বেশ ছোট। আমি শিক্ষাকে খুব মূল্যবান মনে করি। তাই আমার মেয়েদের শিক্ষা বিষয়ে বিশেষ নজর দিই। তবে মেয়েরা বিবাহোপযুক্ত হলেই আমি বিয়ে দিয়ে দিই আর জামাইকে বলি, আমার মেয়েকে কিন্তু লেখাপড়ার সুযোগ দিতে হবে। এই দেখেন আমার বড় মেয়ে সে সংসার করছে। তার সন্তানেরা অল্পবয়স্ক হলেও এখন মাকে ছাড়া থাকতে পারে। তাদের মা এখন এমএ পড়ছে। সে বিএ পাস করেছে বিয়ের পর। দ্বিতীয় মেয়ে হলো আমার সমস্যা। সে বেশ মেধাবী; কিন্তু তার পরীক্ষাভীতি ভয়ানক। এই দেখেন না সে এবার আপনাদের সঙ্গে পরীক্ষা দিল না। তার প্রস্তুতি তেমন মন্দ ছিল না। আমি তাকে লেখাপড়া চালিয়ে যেতে খুব চাপ দিচ্ছি। সে থাকে আজিমপুর। তার স্বামী একজন প্রকৌশলী এবং সেও চায় তার স্ত্রী লেখাপড়া করুক। কিন্তু আমার মেয়ে বলে তার দ্বারা পরীক্ষা দেয়া হবে না। অনেক চাপাচাপির পর বলে, তুমি যদি তার পড়াশোনা একটু দেখিয়ে দাও তাহলে সে হয়তো পরীক্ষা দেয়ার সাহস পাবে। চলবে...
×