ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৯ মার্চ ২০২৪, ১৫ চৈত্র ১৪৩০

আবুল মাল আবদুল মুহিত

ছেলেবেলা ও ছাত্রজীবন

প্রকাশিত: ০৪:৩২, ২৭ ডিসেম্বর ২০১৫

ছেলেবেলা ও ছাত্রজীবন

ছাত্রজীবনের অবসান (২৫ ডিসেম্বরের পর) সে তোমার আত্মবিশ্বাস ও মেধার খুব প্রশংসা করে।’ তিনি অনুনয় করে আরও বললেন, ‘আমি চাই তুমি আমার রোকেয়ার পড়াশোনার কিছু তদারকি করো। এজন্য তোমাকে আমি অর্থের বিনিময়ে টুইশনি করতে অনুরোধ করছি।’ আমি তাকে বললাম, আমার সময়ের বড় টানাটানি আছে। আমি একটি দূরবর্তী কলেজে কিছুদিন হলো পড়াই। তবে রোকেয়া তো আমার সহপাঠী, সহপাঠীকে তো আর টুইশনি করা যায় না। আমি সময় সময় তার সঙ্গে বইপত্র ও পাঠ্য নিয়ে আলোচনা করতে পারি। সে নিজে আমাকে বললে অবশ্যই গুরুত্বসহকারে বিবেচনা করতাম।’ আমিনুল্লাহ সাহেব রোকেয়াকে ডাকলেন এবং বললেন, ‘তার সঙ্গে কথা বলে সব ঠিকঠাক করে নাও। কখন কোথায় সে যাবে সেটি ঠিক করে ফেল।’ তাই বলতে গেলে শিক্ষানুরাগী এক স্নেহময় পিতার আবেদনে আমি রোকেয়ার পড়াশোনায় সাহায্য করার দায়িত্ব নিলাম। আমি বললাম, আমার মাঝে-মধ্যে মুন্সীগঞ্জে থাকতে হয়, তাই আমাদের একটি সময় নির্দিষ্ট করা দরকার। সময়টা নির্দিষ্ট থাকলে সপ্তাহে দুই বা তিনদিন আমি তার বাসায় যাব এবং প্রতিদিন ঘণ্টা দুয়েক সময় নির্দিষ্ট করতে হবে। আমি রোকেয়ার প্রতি টিউটর হিসেবে তেমন যত্নশীল ছিলাম না। প্রায়ই সপ্তাহ পার করে ১-২ দিন যেতাম। একদিনের ঘটনা না বলে পারছি না। একটি ১০-১২ বছরের বালক বিকেল বেলা আমার কামরায় এসে জিজ্ঞেস করল, এই কামরায় কি মুহিত সাহেব থাকেন? আমি বললাম ‘হ্যাঁ’। তারপর সে বলতে লাগল, ‘কি রকম মানুষ উনি। আমার আপাকে পড়ায়; কিন্তু প্রায় দশদিন হলো তার কোন খবর নেই।’ আমি তাকে আশ্বস্ত করে বললাম, ‘ওই লোকটি আমি। তুমি যাও। আমি কিছুক্ষণের মধ্যে আসছি।’ কিন্তু সে তাতে রাজি নয়। তার কথা হলো যে, তার আব্বা ও আপা তাকে পাঠিয়েছেন। সে আমাকে সঙ্গে না নিয়ে যাবে না। আমি তাকে বললাম যে, তুমি তাহলে অপেক্ষা করতে পার, আমি তৈরি হয়ে তারপর যাব। আমি বেশ ক’দিন দাড়ি কাটিনি, তাই ছেলেটি আমাকে চিনতেই পারেনি। সে সময় আমি প্রতিবছর একটি মাস দাড়ি রাখতাম; আবার মাঝে মাঝে ৭-১০ দিন দাড়ি কাটতাম না। রোকেয়ার সঙ্গে আলোচনায় আমি আনন্দ পেতাম। প্রায়ই কোন বই বা লেখক বা কবিকে নিয়ে যখন আলোচনা করতাম তখন এক নতুন দৃষ্টিকোণ যেন উদ্ঘাটিত হতো। অর্থাৎ তার সঙ্গে আমিও পড়াশোনা করতাম। এ যাত্রায় আমার যখন মনে হলো আমাদের আলোচনা সম্ভাব্য পাঠ্য বিষয়ের অনেকটাই আয়ত্তে এসেছে তখন একদিন তার কাছ থেকে বিদায় নিলাম। রোকেয়ার সঙ্গে দেখা হয় অনেক পর, সম্ভবত আমেরিকায়। তখন সে কলেজের অধ্যাপিকা। খুবই আত্মবিশ্বাসী মহিলা এবং শুনলাম, অধ্যাপিকা হিসেবে তার সুনাম আছে। সম্ভবত রোকেয়া সুলতানা শিক্ষা বিভাগের মহাপরিচালক বা অতিরিক্ত মহাপরিচালক হিসেবে বাংলাদেশে অবসর নেন। আগেই বলেছি যে, বগুড়ার মোহাম্মদ আলী ১৯৫৪ সালেই পাকিস্তানের সংবিধান প্রণয়নপর্ব শেষ করেন। তার এই উদ্যোগটি বাধাপ্রাপ্ত হয় দেশশত্রু গোলাম মোহাম্মদের ১৯৫৪ সালের ২৪ অক্টোবরের পদক্ষেপে। ১৯৫৫ সালে অবশ্য নতুন করে গণপরিষদ গঠিত হয় এবং তাতেও মোহাম্মদ আলী প্রণীত সংবিধানটি গৃহীত হয় ১৯৫৫ সালের ২১ সেপ্টেম্বরে। ইতোমধ্যে অবশ্য পশ্চিম পাকিস্তানী চক্রান্তের ফলে ১৯৫৫ সালের ১১ আগস্ট বগুড়ার মোহাম্মদ আলী পদত্যাগ করতে বাধ্য হন এবং তার স্থলে আসীন হলেন পাকিস্তানের শুরু থেকে অত্যন্ত দক্ষ সরকারী কর্মকর্তা এবং ষড়যন্ত্রকারী নেতা পাঞ্জাবের মোহাম্মদ আলী চৌধুরী। মোহাম্মদ আলী চৌধুরীর প্রথম কাজ হলো পশ্চিম পাকিস্তানের পাঁচটি প্রদেশকে একত্র করে এক ইউনিট গঠন করা। ১৯৫৫ সালের ৩০ সেপ্টেম্বর সেই প্রস্তাব পাস হওয়ার পর সংবিধান নিয়ে আর কোন সমস্যা থাকল না। ১৯৫৫ সালের ৩০ ডিসেম্বরে গণপরিষদ সিদ্ধান্ত নিল, বাংলা এবং উর্দুই হবে পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা। চৌধুরী মোহাম্মদ আলী ঠিক করলেন, পাকিস্তানের প্রথম সংবিধানটি ১৯৫৬ সালের ২৩ মার্চে কার্যকরী হবে। ১৯৪০ সালের ২৩ মার্চে তথাকথিত পাকিস্তান প্রস্তাব মুসলিম লীগ কাউন্সিলে পাস হওয়ার পরই পাকিস্তান আন্দোলন জোরদার হয়। সে কারণেই ২৩ মার্চ সংবিধান কার্যকরী দিবস হিসেবে প্রতিপালিত হয়। সংবিধানটি মোটামুটিভাবে সোহ্রাওয়ার্দী কর্তৃক প্রণীত হলেও সংবিধান পাসের জন্য যখন তা গণপরিষদে উপস্থাপিত হলো তখন ৮ মার্চ আওয়ামী লীগ পক্ষে ভোট না দিয়ে ওয়াক আউট করে। তাদের যুক্তি ছিল, এই আইনে রাষ্ট্রপতিকে অত্যধিক ক্ষমতা দেয়া হয়েছে। দ্বিতীয়ত, এই আইনে প্রাদেশিক স্বায়ত্তশাসন যথাযথভাবে সমুন্নত হয়নি। ২৩ মার্চ দেশব্যাপী সরকার উৎসবের আয়োজন করে। কিন্তু সেই আয়োজনটিতে আওয়ামী লীগ যোগ দিল না। আমাদের হল ইউনিয়নে তখন যে কার্যকরী কমিটি ছিল তার সদস্য ছিল আওয়ামী লীগের সমর্থক ছাত্রলীগের নেতৃবৃন্দ। তারা এই উৎসবটি পালন করতে তেমন আগ্রহী ছিলেন না। কিন্তু সারাদেশে যে ধরনের আগ্রহ পরিলক্ষিত হয় তাতে তারা এতে তেমন বিপত্তি সৃষ্টি করতেও চাননি। হল ইউনিয়নে এই উৎসবটি কিভাবে প্রতিপালিত হবে সেটা নিয়ে নানা চিন্তা-ভাবনা আলোচিত হতে থাকে। সাধারণ ছাত্রদের মনোভাব ছিল যে, নয় বছরে একটি সংবিধান রচিত হয়েছে, সুতরাং সে উদ্দেশ্যে আনন্দানুষ্ঠান করা উচিত। হল ইউনিয়ন কর্তৃপক্ষ এই দোটানায় পড়ে আমাকে ব্যবহার করতে মনস্থ করলেন এবং আমি তাদের উদ্যোগে সানন্দে রাজি হলাম। ইউনিয়ন কর্তৃপক্ষ ইউনিয়নের একজন জ্যেষ্ঠ সদস্য হিসেবে আমাকে এই উৎসব পালনের জন্য আহ্বায়ক নিযুক্ত করলেন। আমরা মহাসমারোহে ১৯৫৬ সালের ২৩ মার্চ পাকিস্তান সংবিধান দিবস পালন করলাম। হলটি সাজানো হলো। গেট গাছপাতা দিয়ে সাজানো হলো এবং সন্ধ্যাবেলায় রেড়ির তেলের সলতা দিয়ে আমরা আলোকসজ্জার ব্যবস্থা করলাম। এছাড়াও কিছু হাওয়াই ফুলঝুরি পোড়ানো হলো। একটি ফুলঝুরি আমি নিজ হাতে হলের ছাদ থেকে জ্বালাই। উত্তপ্ত বারুদ আমার হাতে পড়লে কিছু অংশ পুড়ে যায়। তার একটি চিহ্ন আমি সারাজীবন বয়ে বেড়াচ্ছি। সংবিধান দিবস পালিত হওয়ার আগেই কিন্তু কেন্দ্রীয় পাকিস্তান সরকার পুরোপুরিভাবে একটি ষড়যন্ত্র গোষ্ঠীর হাতে সমর্পিত হলো। ৪ মার্চ দেশশত্রু ইসকান্দার মীর্জা হলো পাকিস্তানের রাষ্ট্রপতি এবং ৯ মার্চ শেরে বাংলা এ কে ফজলুল হক হলেন পূর্ব বাংলার লাট সাহেব। ২৩ মার্চ পূর্ব বাংলা হয়ে গেল পূর্ব পাকিস্তান। চলবে...
×