ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৯ মার্চ ২০২৪, ১৪ চৈত্র ১৪৩০

ইচ্ছেমতোই ভাড়া নিচ্ছে গণপরিবহন, ফেরেনি শৃঙ্খলা

প্রকাশিত: ০৫:৩৫, ২৭ ডিসেম্বর ২০১৫

ইচ্ছেমতোই ভাড়া নিচ্ছে গণপরিবহন, ফেরেনি শৃঙ্খলা

রাজন ভট্টাচার্য ॥ কমলাপুর রেলস্টেশন থেকে সায়েন্স ল্যাবরেটরি পর্যন্ত বাহন পরিবহনে বাস ভাড়া ২০ টাকা! মিরপুর ১০ নম্বর পর্যন্ত গুনতে হচ্ছে ৫০ টাকা। অনাবিল-ছালছাবিল পরিবহনে মালিবাগ রেলগেট থেকে নতুন বাজার পর্যন্ত বাস ভাড়া ২০ টাকা। খিলক্ষেত পর্যন্ত নেয়া হচ্ছে ৩৫ টাকা পর্যন্ত। মতিঝিল থেকে হাজী ট্রান্সপোর্টে ফার্মগেট পর্যন্ত বাস ভাড়া নেয়া হচ্ছে ১২ থেকে ১৫ টাকা। বাস ভাড়ার তালিকা শুনে চোখ কপালে উঠলে লাভ নেই। এটাই নিয়তি। যাত্রীদের অনেকটা জিম্মি করে রাজধানীজুড়ে এভাবেই চলছে ভাড়া নৈরাজ্য চলছে। অথচ দেখার কেউ নেই। নীরব সড়ক পরিবহন মন্ত্রণালয় থেকে শুরু করে বিআরটিএ পর্যন্ত। পুলিশও এখন আর আগের মতো তৎপর নয়। পরিবহন মালিকদের ধর্মঘটের ভয়ে মোবাইলকোর্ট পরিচালনাও কার্যত বন্ধ। সব মিলিয়ে গেল তিন মাসেও ভাড়া নৈরাজ্য বন্ধ করা যায়নি। পরিবহন সেক্টরে শৃঙ্খলা ফিরিয়ে আনা সম্ভব হয়নি। অতিরিক্ত বাস ভাড়া নিয়ে নগরীতে যেসব পরিবহন প্রতিদিন যাত্রীদের পকেট কাটছে সেগুলোর মধ্যে অন্যতম লাব্বায়েক ট্রান্সপোর্ট। শুরু থেকেই এ পরিবহন কোম্পানিটি কোন কিছুই তোয়াক্কা করে না। নিজেদের ইচ্ছামতো ভাড়া নিচ্ছে। এক কিলোমিটার রাস্তা গেলেই গুনতে হয় ১০ টাকা। এর অধিক রাস্তায় বাস ভাড়া ১৫-২০ টাকা পর্যন্ত। এদিকে নিয়ন্ত্রণ না থাকায় লেগুনা ও হিউম্যান হলারে ইচ্ছামতো ভাড়া নির্ধারণ করেছেন পরিবহন মালিকরা। বিআরটিএ সচিব শওকত আলী জনকণ্ঠ’কে বলেছেন, নির্ধারিত ভাড়া আদায় নিশ্চিত করতে আমরা সর্বাত্মক চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছি। অভিযোগ পেলেই সংশ্লিষ্টদের বিরুদ্ধে কার্যকর ব্যবস্থা নেয়ার কথা জানান তিনি। সড়ক পরিবহন সমিতির মহাসচিব খন্দকার এনায়েত উল্যাহ জনকণ্ঠ’কে বলেন, বাড়তি ভাড়া আদায় বন্ধে আমরা সকল পরিবহন মালিকদের নির্দেশ দিয়েছি। কমলাপুর থেকে ছয় নম্বর বাসে মতিঝিল পর্যন্ত মাত্র এক কিলোমিটার রাস্তায় সাত টাকা ভাড়া নেয়া হচ্ছে। মগবাজার পর্যন্ত চাওয়া হচ্ছে ১৫ টাকা। নতুন ভাড়া অনুযায়ী ১৫ টাকা নিতে হলে অন্তত প্রায় ১০ কিলোমিটার রাস্তা পাড়ি দিতে হবে। অথচ চার কিলোমিটার রাস্তার জন্য এই টাকা গুনতে হচ্ছে যাত্রীদের। কমলাপুর থেকে বাহন, মিডওয়ে পরিবহনে সায়েন্স ল্যাবরেটরি পর্যন্ত ২০ টাকা আদায় করা হচ্ছে! এক টাকা বাড়তি ভাড়া নিতে হলে অন্তত ১০ কিলোমিটার রাস্তা অতিক্রম করতে হবে। অথচ এসব বাসে ভাড়ার তালিকাই চোখে পড়েনি। গাজীপুর পর্যন্ত চলা বলাকা পরিবহনে তালিকা নেই। গাজীপুর পরিবহনের চিত্র একই। ভাড়া আদায় নিয়ে যাত্রীদের সঙ্গে বাস সংশ্লিষ্টদের ব্যাপক বাকবিত-া দেখা যায়। তবে বাসচালক আলী জানান, এখনও কর্তৃপক্ষ এই রুটে নতুন ভাড়া আদায় করছে না। যাত্রীদের কাছে গন্তব্য প্রতি এক টাকা বাড়তি চাওয়া হচ্ছে। যারা ইচ্ছে করে দিচ্ছেন তাদের কাছ থেকে নেয়া হচ্ছে। যারা দিচ্ছেন না তাদের কাছে দাবি নেই বলে জানান তিনি। বিদ্যুত ও গ্যাসের মূল্যবৃদ্ধির প্রেক্ষিতে গেল ১০ সেপ্টেম্বর ঢাকা ও চট্টগ্রামে বাস-মিনিবাসসহ অটোরিক্সা বাড়তি ভাড়া নির্ধারণ করে সড়ক পরিবহন মন্ত্রণালয়। পরবর্তীতে এক অক্টোবর থেকে নতুন ভাড়া কার্যকর হয় ঢাকায়। নানা কারণে চট্টগ্রামে পাঁচ অক্টোবর থেকে কার্যকর শুরু হয়েছে। নতুন করে প্রতি কিলোমিটারে বাস ভাড়া এক টাকা ৭০ পয়সা ও মিনিবাসে এক টাকা ৬০ পয়সা নির্ধারণ করা হয়। সর্বনিম্ন ভাড়া ৫ ও ৭ টাকা অপরিবর্তিত থাকছে। সর্বশেষ ২০১১ সালের ১৯ সেপ্টেম্বর ঢাকা ও চট্টগ্রামে গণপরিবহনের ভাড়া বাড়ানো হয়েছিল। বাসের ভাড়া বৃদ্ধির পর পরই তা কার্যকর দেখতে রাজধানীতে অনেকটা জোরেশোরে অভিযানে নামে বিআরটিএ কর্তৃপক্ষ। সড়ক পরিবহনমন্ত্রী ওবায়দুল কাদের নিজেই এসব দেখভালের জন্য মাঠে ছিলেন। একাধিক দিন মন্ত্রী নিজেই রাষ্ট্রায়ত্ত পরিবহন বিআরটিসিসহ বেসরকারী বিভিন্ন পরিবহন কোম্পানি যাত্রীদের কাছ থেকে বাড়তি ভাড়া আদায়ের সময় হাতেনাতে ধরেন। মন্ত্রীর নির্দেশে বাড়তি ভাড়া যাত্রীদের ফেরত দেয়ার ঘটনাও ঘটেছে। অভিযান আরও জোরালো হলে হঠাৎ করে পরিবহন ধর্মঘটের ডাক দেয় মালিক সমিতি। এক পর্যায়ে নমনীয় হয় সরকার। এমনকি পিছু হটে। এই সুযোগে ইচ্ছামতো বাস ভাড়া নেয়া চলছেই। এদিকে যাত্রী কল্যাণ সমিতি অভিযোগ করে বলেছে, বাস-মিনিবাসে যাত্রীদের কাছ থেকে সর্বনিম্ন ১০০ ভাগ ও সর্বোচ্চ ৬০০ ভাগ পর্যন্ত বাড়তি ভাড়া আদায় করা হচ্ছে। সংগঠনের মহাসচিব মোজাম্মেল হক জনকণ্ঠ’কে বলেন, রাজধানীতে কমপক্ষে চার হাজারের বেশি বাস ও মিনিবাস চলছে। বাস ও নিউম্যান হলারে গড়ে প্রতিদিন ৩০০ কোটি টাকা বাড়তি ভাড়া আদায় করা হচ্ছে। অটোরিক্সাসহ সকল গণপরিবহনে প্রতিদিন ৫০০ কোটি টাকা বাড়তি ভাড়া আদায়ের অভিযোগ করেন তিনি। তিনি বলেন, বাড়তি ভাড়া আদায় বন্ধে যাত্রীসহ পরিবহন সংশ্লিষ্টদের সচেতন করতে হবে। ভাড়া অরাজকতা বন্ধে সরকারের কঠোর হওয়া ছাড়া বিকল্প কিছু নেই বলেও মনে করেন তিনি। ভাড়া নির্ধারণ কমিটির সুপারিশ অনুযায়ী ঢাকা ও চট্টগ্রামের দুই সিটিতে আগে কিলোমিটার প্রতি বাস ভাড়া ছিল এক টাকা ৬০ পয়সা। মিনিবাসের কিলোমিটারপ্রতি ভাড়া ছিল এক টাকা ৫০ পয়সা। এখন উভয় বাসেই ১০ পয়সা করে বাড়ানো হয়েছে। এছাড়া বাসে ৭ টাকা ও মিনিবাসে ৫ টাকা সর্বনিম্ন ভাড়া বহাল থাকছে। ঢাকা ট্রান্সপোর্ট কো-অর্ডিনেশন অথরিটির (ডিটিসিএ) আওতায় হওয়ার মানিকগঞ্জ, নারায়ণগঞ্জ, গাজীপুর, মুন্সীগঞ্জ, নরসিংদীসহ পাঁচ জেলায় ঢাকা-চট্টগ্রামের বাস ও মিনিবাসের সমান ভাড়া আদায় করা হবে। বাস্তবতা হলো, মাঠ পর্যায়ে কিলোমিটার প্রতি ১০ পয়সা ভাড়া বাড়ানোর প্রমাণ পাওয়া যায় না। সিএনজিচালিত অটোরিক্সার ক্ষেত্রে দুই সিটি কর্পোরেশনে প্রথম দুই কিলোমিটারের ভাড়া ২৫ টাকার স্থলে ৪০ টাকা করা হয়েছে। সর্বনিম্ন ভাড়াও তাই। পরবর্তী প্রতি কিলোমিটারের ভাড়া সাত টাকা ৬৪ পয়সার স্থলে ১২ টাকা করা হয়েছে। যানজট বা অন্য কোন কারণে রাস্তায় বিরতিকালীন সময়ে প্রতি মিনিটের ভাড়া এক টাকা ৪০ পয়সার স্থলে ২ টাকা নির্ধারণ করা হয়েছে। তবুও বশে আনা যাচ্ছে না অটোরিক্সা চালকদেরও। নিয়মের বাইরে গিয়ে ইচ্ছামতো ভাড়া নিচ্ছে যাত্রীদের কাছ থেকে। অটোরিক্সা মালিক ও শ্রমিক ইউনিয়নের নেতারা বলছেন, সরকার নির্ধারিত জমা মেনে চলতে মালিকদের কখনই বাধ্য করা যায়নি। এবারও সম্ভব হবে না। মালিকরা জমা বাড়িয়ে নিলে চালকরা বাধ্য হলে মিটার ছাড়া চুক্তিতে যাত্রীদের কাছ থেকে বাড়তি ভাড়া আদায় করে। এ ব্যাপারে সরকারকে আরও কঠোর হওয়ার পরামর্শ তাদের। মতিঝিল থেকে চিড়িয়াখানা পর্যন্ত চলা নিউ ভিশন পরিবহনের বাসে নতুন ভাড়ার তালিকা ঝুলতে দেখা গেছে। বাস কর্তৃপক্ষের স্বাক্ষরিত তালিকায় দেখা গেছে, মতিঝিল থেকে ফার্মগেট পর্যন্ত দেখানো হয়েছে প্রায় সাড়ে সাত কিলোমিটার রাস্তা। ভাড়া নির্ধারণ করা হয়েছে ১২ টাকা। নতুন ভাড়া অনুযায়ী আসে ১১ টাকা ৫৫ পয়সা। আর চিড়িয়াখানা পর্যন্ত ১৬ কিলোমিটার রাস্তায় ভাড়া নির্ধারণ করা হয়েছে ২৬ টাকা। এখানে ভাড়া আসে ২৫ টাকা ৬ পয়সা। মতিঝিল থেকে চিড়িয়াখানা পর্যন্ত ১৬ কিলোমিটার রাস্তা নিয়ে সন্দেহের কথা জানিয়েছেন যাত্রীরা। কমলাপুর থেকে মিরপুর রুটে চলা স্বকল্প পরিবহনে মগবাজার পর্যন্ত ১৫ টাকা দাবি করা হচ্ছে। অথচ গাড়িতে সরকারী ভাড়ার তালিকা নেই। আট নম্বর বাসে নেয়া হচ্ছে বাড়তি ভাড়া। আরামবাগ থেকে সিটি সার্ভিসে মোহাম্মদপুর পর্যন্ত কখনও ২০-২৫ টাকা পর্যন্ত আদায়ের অভিযোগ করেছেন যাত্রীরা। ঢাকা পরিবহন, বিকল্প পরিবহন, ইটিসিসহ মিরপুরের বিভিন্ন গাড়ির বিরুদ্ধে বাড়তি ভাড়া আদায়ের অভিযোগ পাওয়া গেছে। ঢাকা থেকে মাওয়া, গাজীপুর, সাভার, মানিকগঞ্জ, নরসিংদী, কুমিল্লা, ভুলতা, গাউছিয়া, কালিয়াকৈরসহ আশপাশের জেলা উপজেলায় বাড়তি বাস ভাড়া নেয়ারও অভিযোগ মিলেছে। যদিও ঢাকা ট্রান্সপোর্ট কো-অর্ডিনেশন অথরিটির (ডিটিসিএ) আওতায় হওয়ার রাজধানীর আশপাশে ছয় জেলার বাস ভাড়াও কিলোমিটার প্রতি ১০ পয়সা করে বেড়েছে। বাস ও মিনিবাসে নেয়া হচ্ছে সমান ভাড়া। তা নিয়ন্ত্রণ বা দেখভালের কেউ নেই। এদিকে মালিবাগ রেলগেট থেকে মুগদা পর্যন্ত নিউম্যান হলারের ভাড়া ১০-এর স্থলে ১৫ টাকা করা হয়েছে। ফার্মগেট থেকে মোহাম্মদপুর পর্যন্ত নেয়া হচ্ছে ১৫ টাকা। ফার্মগেট থেকে ক্যান্টনমেন্ট-বালুঘাট পর্যন্ত ম্যাক্সি ভাড়া নেয়া হচ্ছে ২০ টাকা। বাসাবো থেকে গুলিস্তান পর্যন্তও ২০ টাকা। মহাখালী থেকে গাবতলী পর্যন্ত নিউম্যান হলারের ভাড়া ৩০ টকা। অথচ এসব পরিবহনের ভাড়া বৃদ্ধির বিষয়ে কোন সিদ্ধান্ত নেয়নি সরকার।
×