ঢাকা, বাংলাদেশ   শনিবার ২০ এপ্রিল ২০২৪, ৭ বৈশাখ ১৪৩১

সংবর্ধনার জবাবে শিল্পী শাহাবুদ্দিন

রং তুলি মানে দুর্বলতা- মুক্তিযুদ্ধে গিয়ে এই ধারণা ভেঙ্গেছি

প্রকাশিত: ০৫:২০, ২৮ ডিসেম্বর ২০১৫

রং তুলি মানে দুর্বলতা- মুক্তিযুদ্ধে গিয়ে এই ধারণা ভেঙ্গেছি

মোরসালিন মিজান শাহাবুদ্দিনের বেলায় শুধু চিত্রকর্ম নয়, শিল্পী নিজেও দারুণ উপভোগ্য। অনেক রকমের গুণ নিজের মধ্যে ধারণ করেছেন। সামনে এসে দাঁড়ালে সেগুলো একটু একটু করে ছুঁয়ে যেতে থাকে। নিজের অজান্তেই শিল্পীর প্রেমে পড়ে কাতরাতে থাকেন ভক্ত-অনুরাগীরা। রবিবার আরও একবার দেখা গেল অপরূপ সে দৃশ্য। ফ্রান্স থেকে সদ্য দেশে ফেরা শিল্পী এদিন তাঁর আঁতুড়ঘর চারুকলা অনুষদে এসেছিলেন। স্মৃতিবিজড়িত বকুলতলায় আয়োজন করা হয়েছিল সংবর্ধনা অনুষ্ঠানের। খ্যাতিমান শিল্পী-শিক্ষক-শিক্ষার্থীরা ভালবাসার মানুষটিকে ফুল দিয়ে ভরিয়ে দেন। উপলক্ষ ছিল শিল্পীর সাম্প্রতিক অর্জন। এবার ফরাসী সরকারের দেয়া ‘শোভালিয়ে দো র্লদ্ দেজার্ত এ দে লেত্র্’ পদকে ভূষিত হয়েছেন বাঙালী শিল্পী। সে আনন্দ ভাগাভাগি করতেই অনুষ্ঠানের আয়োজন। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের চারুকলা অনুষদের আয়োজনে অনেকেই উপস্থিত হয়েছিলেন। তবে মাতিয়ে রাখলেন একজনই। তিনিÑ শাহাবুদ্দিন। না ছবি আঁকার কোন বিষয় ছিল না। সামান্য বলা। তাতেই মন্ত্রমুগ্ধ সবাই! আয়োজনের শুরুতে সঙ্গীতায়োজনের মাধ্যমে অভিনন্দিত করা হয় শাহাবুদ্দিনকে। এ সময় রবীন্দ্রনাথ থেকে গাওয়া হয়Ñ আনন্দলোকে মঙ্গলালোকে বিরাজ সত্যসুন্দর/ মহিমা তব উদ্ভাসিত মহাগগনমাঝে,/ বিশ্বজগত মণিভূষণ বেষ্টিত চরণে...। পরের পরিবেশনা ভূপেন হাজারিকার বিখ্যাত গানÑ সবার হৃদয়ে রবীন্দ্রনাথ/ চেতনাতে নজরুল/ যতই আসুক বিঘœ-বিপদ/ হাওয়া হোক প্রতিকূল/ এক হাতে বাজে অগ্নিবীণা/ কন্ঠে গীতাঞ্জলি/ হাজার সূর্য চোখের তারায়/ আমরা যে পথ চলি...। এভাবে শাহাবুদ্দিনের মহিমা গাইতে গিয়ে যেন বলা হয়ে যায় স্বপ্নের বাংলাদেশের কথা। গান শেষে ছোট্ট করে আলোচনা। ছাত্রকে অভিনন্দন জানিয়ে বক্তব্য রাখেন শিক্ষক বিখ্যাত শিল্পী রফিকুন নবী ও শিল্পী সমরজিৎ রায় চৌধুরী। বক্তব্য রাখেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য অধ্যাপক আ আ ম স আরেফিন সিদ্দিক ও শিক্ষক সমিতির সভাপতি অধ্যাপক ফরিদ উদ্দিন আহমেদ। মানপত্র পাঠ করেন শিল্প-সমালোচক মঈনুদ্দীন খালেদ। অভিজ্ঞানপত্র পাঠ করেন চারুকলা অনুষদের ডিন অধ্যাপক নিসার হোসেন। এরই মাঝে উত্তরীয় পরিয়ে দেয়া হয় শাহাবুদ্দিনকে। আসতে থাকে ফুল। ফুলে ফুলে ভরে ওঠে মঞ্চ। এদিন খুব সম্ভবত প্রথমবারের মতো বাংলাদেশের কোন মঞ্চে দেখা যায় শিল্পীপতœী আনা ইসলামকেও। দর্শক সারি পরিপূর্ণ ছিল। বিভিন্ন বয়সী মানুষ। সকলের দৃষ্টি শহাবুদ্দিনে। অনুষ্ঠানের শেষভাগে এসে মাইকের সামনে দাঁড়ালেন শিল্পী। সেই চিরচেনা রূপ। গায়ে গোলাপী রঙের ফুলহাতা শার্ট। একই রকম উজ্জ্বল রঙের প্যান্ট। এমনকি কোমরের বেল্টটি রঙ্গিন খুব। শাহাবুদ্দিন এর পর মাইকের আড়াল নিলেন। বললেন, ধন্যবাদ দেয়া ছাড়া আর কিছু তেমন বলার নেই তাঁর! মোটামুটি তা-ই করে বিদায় নিচ্ছিলেন। কিন্তু উপস্থিত সবাই আরও কিছু শুনতে চান। অগত্যা লাজুক সেই ভঙ্গিটি। নতুন করে শুরু করেন শিল্পী। এবার নানান প্রসঙ্গ। যথা নিয়মে আসে একাত্তর। মুক্তিযুদ্ধ। স্মৃতি হাতড়ে শাহাবুদ্দিন বলেন, একাত্তর সালে মুক্তিযুদ্ধ শেষে আর্ট কলেজে এলাম। ততদিনে জীবন থেকে এক বছর চলে গেছে। মুক্তিযুদ্ধের সময় লেখাপড়া হয়নি। সেই ক্ষতি পুষিয়ে নিতে সকল শিক্ষার্থীর বিনা পরীক্ষায় প্রমোশন দিয়ে উপরের ক্লাসে পাঠানোর সিদ্ধান্ত প্রায় চূড়ান্ত। তখন আমি শুধু এর বিরোধিতা করলাম। বললাম, শিল্পীর জন্য প্রমোশন তো ফাঁকি হয়ে যায়। ফাঁকি দিয়ে কখনও উপরে ওঠা যায় না। বর্তমানের আলোচনায় এসে তিনি বলেন, শুধু সার্টিফিকেটে বড় শিল্পী হয় না। সাধনা-চর্চা ইত্যাদির দরকার হয়। সে পথে হেঁটেছিলেন বলেই হয়ত তিনি খুব আত্মবিশ্বাসের সঙ্গে বলেন, আমার কনফিডেন্ট ছিল-ই। আমি জানতাম, আজ হোক, কাল হোক, ফরাসী সরকার আমাকে ‘শোভালিয়ে দো র্লদ্ দেজার্ত এ দে লেত্র্’ দেবে। রণাঙ্গনের সাহসী সৈনিক শাহাবুদ্দিনের বলায় ঘুরেফিরেই আসে মুক্তিযুদ্ধ। তিনি বলেন, সবার ধারণা শিল্পী মানেই দুর্বল চিত্ত। রং তুলি মানে দুর্বলতা। মুক্তিযুদ্ধে অংশ নেয়ার মধ্য দিয়ে এই দুর্বলতাটাকে আমি ভেঙ্গে দিয়েছি। জয় বাংলা সেøাগানটিকে আবেগ দিয়ে ব্যাখ্যা করেন তিনি! বলেন, একাত্তরে আমাদের মূল আর্মস ছিল জয় বাংলা। এটি এমন এক জিনিস, উচ্চারণ করার সঙ্গে সঙ্গে কারেন্ট চলে আসে শরীরে। এটা আমাদের হার্ট। এত ছোট, এত সরল-সুন্দর সেøাগান বিদেশের নেই। এত খাঁটি বাংলা সেøাগান আর হয় না। তিনি বলেন, অনেকে জয় বাংলা বলে হাসি দিয়ে দেয়। আমার খুব খারাপ লাগে তখন। মুক্তিযুদ্ধের চেতনা থেকে অনেক সাহিত্যিক-গায়ক-গায়িকা সরে গেছেন জানিয়ে তিনি বলেন, কিন্তু চারুকলার ৯৯ ভাগ শিক্ষক-শিক্ষার্থী-শিল্পী অনড়। জাতির জনককে নিয়েও শাহাবুদ্দিনের সিমাহীন আবেগ। বলেন, ’৭৫ এ ধসে গিয়েছিলাম। বুকে ধক্ করে উঠেছিল। মনে হয়েছিল, এই দেশে এমন ঘটনাও ঘটে! এখানে আর আসা হবে না। আর দেখা হবে না কারও সঙ্গে। তবে মুক্তিযুদ্ধের যে তেজ, আমাকে তা আবার জাগ্রত করেছিল। আমি ফিরেছিলাম। শাহাবুদ্দিনের আরেক অনুপ্রেরণা শিল্পাচার্য জয়নুল আবেদিন। কিংবদন্তি শিল্পীর তিনি ছিলেন অত্যন্ত স্নেহধন্য। সে স্মৃতি থেকে বলেন, উনি (শিল্পাচার্য) না হলে কোথায় থাকতাম, নো বডি নোজ। ছোটবেলায় স্বপ্ন ছিল, উনার মতো হব। কল্পনা করতাম, তিনি দেখতে কেমন হবেন! তবে, স্বাধীনতার পর অপেক্ষা করেছিলাম, তিনি ডাকলে পরেই যাব। তাঁর আর্ট কলেজের একজন ছাত্র মুক্তিযুদ্ধ করে এসেছে জেনে সত্যি সত্যি ডাকলেন তিনি। সেই থেকে তাঁর সান্নিধ্যে ছিলাম। ১৯৭৪ সালে বন্যার সময় ত্রাণবাহী হেলিকপ্টারে চড়ে ফরিদপুর, ঝিনাইদহ ও পিরোজপুরে গিয়েছিলেন শিল্পাচার্য। তাঁর আগ্রহে আমিই এর ব্যবস্থা করেছিলাম। আমার সুযোগ হয়েছিল তাঁর সঙ্গে থাকার। তখন হাঁটুপনিতে দাঁড়িয়ে আমার শিক্ষক দুর্গত মানুষের দিকে তাকিয়েছিলেন। আমাকে বলেছিলেন, দেখ। ভাল করে দেখ। কাজে লাগবে। শাহাবুদ্দিন কৃতজ্ঞচিত্তে স্বীকার করেন, এমন দেখা তাঁর জীবনে অনেক অনেক কাজে এসেছে। সম্প্রতি ভারতে অনুষ্ঠিত শিল্পীর একক প্রদর্শনী প্রসঙ্গ টেনে তিনি বলেন, সেখানে দেশটির রাষ্ট্রপতি প্রণব মুখার্জী উপস্থিত ছিলেন। তিনি তাঁর মুখ দিয়ে দু’বার শিল্পাচার্যের নাম নিয়েছেন। উল্টোটাও হয় জানিয়ে শাহাবুদ্দিন বলেন, অনেকে ভাবেন এই গরিব দেশে এত শিল্পী কী করে হলো! যারা ভাত খেতে পারছে না, ছবি আঁকে কী করে? উত্তরও দেন তিনি। বলেন, বাংলার মাটিই শিল্পী তৈরি করে। চারুকলায় পাঁচ বছর কাটানোর স্মৃতি তুলে ধরে শাহাবুদ্দিন বলেন, এখানকার প্রতিটি ইটকে মনে হয় আমার। আমার জীবনের গোল্ডেন পিরিয়ড আমি এখানে কাটিয়েছি। তাঁর প্রতি ভালবাসা দেখানোর জন্য প্রিয় প্রতিষ্ঠানের সকলের প্রতি বার বার কৃতজ্ঞতা জানিয়ে বক্তব্য শেষ করেন শাহাবুদ্দিন। এরপর আবারও ফুল দেয়া-নেয়ার পালা। বাংলা একাডেমি, জাতীয় জাদুঘরসহ বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান ও সংগঠনের পক্ষ থেকে ফুল দিয়ে অভিনন্দিত করা হয় শিল্পীকে। অনেকে একলাটি আসেন। একগুচ্ছ ফুল হাতে তুলে দেন শাহাবুদ্দিনের। এভাবে দেখতে দেখতে মঞ্চ ভরে ওঠে ফুলে। মাঝখানে বসে বিনয়াবনত শিল্পী সংগ্রামী মানুষটি।
×