ঢাকা, বাংলাদেশ   শনিবার ২০ এপ্রিল ২০২৪, ৭ বৈশাখ ১৪৩১

মোঃ সাহাবুদ্দিন চুপ্পু

জাতির ভাবমূর্তি ও পদ্মা সেতুর কথিত দুর্নীতির ষড়যন্ত্র

প্রকাশিত: ০৫:৩৪, ২৮ ডিসেম্বর ২০১৫

জাতির ভাবমূর্তি ও পদ্মা সেতুর কথিত দুর্নীতির ষড়যন্ত্র

বঙ্গবন্ধু কন্যা মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার দৃঢ়প্রত্যয়, দেশপ্রেম, জাতির প্রতি অঙ্গীকারের ফলশ্রুতিতে সকল প্রতিকূলতাকে জয় করে আজ স্বপ্নের পদ্মা সেতু বাস্তব রূপ ধারণের পথে এগিয়ে যাচ্ছে। মাননীয় প্রধানমন্ত্রী আপনার প্রতি রইল সশ্রদ্ধ সালাম ও অভিনন্দন। বিজয়ের মাসে গত ১২ ডিসেম্বর ২৭% প্রস্তুতিমূলক কাজ সম্পন্ন হওয়ার পর মূল পাইলিং কাজের ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপন করেন মাননীয় প্রধানমন্ত্রী। সমগ্র জাতি ওই দিনে স্বপ্নের সেতুর বাস্তব রূপ তাদের হৃদয়ে অনুধাবন করে। ওই দিনের টিভি চ্যানেলসমূহের টক-শো এবং দৈনিক পত্রিকায় প্রকাশিত বিভিন্ন প্রতিবেদনে পদ্মা সেতুর বাস্তবতা সম্পর্কে ইতিবাচক মনোভাব পোষণ করে স্বাগত জানানো হয়। আমিও এতে অনেকটা আবেগপ্রবণ হয়ে পড়ি এবং ভাবি যে নিকট অতীতে মাত্র তিন বছর পূর্বে যখন পদ্মা সেতুর পরামর্শক নিয়োগে কথিত দুর্নীতির ষড়যন্ত্রের অভিযোগ উত্থাপিত হয়, তখন অভিযোগের গভীরে প্রবেশ করে সঠিক তথ্যের ভিত্তিতে সমগ্র ঘটনাপ্রবাহ প্রকাশিত হলে জাতি বিভ্রান্ত হতো না এবং মানবসৃষ্ট ভাবমূর্তি সঙ্কটেরও প্রশ্ন থাকত না। উক্ত কথিত দুর্নীতির অভিযোগের ভিত্তিতে পরিচালিত অনুসন্ধান ও তদন্ত প্রক্রিয়ার সঙ্গে আমি নিজে ঘনিষ্ঠভাবে সম্পৃক্ত থাকায় বস্তুনিষ্ঠ ঘটনাপ্রবাহ এবং প্রাপ্ত তথ্য জনসম্মুখে প্রকাশের তাগিদ থেকেই আমার এ লেখার অবতারণা। ৬.১৫ কিলোমিটার বহুমুখী পদ্মা সেতু প্রকল্প বাস্তবায়নের সরকারী সিদ্ধান্তের পর বিশ্বব্যাংক, এশীয় উন্নয়ন ব্যাংক, জাইকা ও ইসলামী উন্নয়ন ব্যাংক এ প্রকল্পে অর্থায়নের জন্য আগ্রহ প্রকাশ করে। বিশ্বব্যাংক ১২০০.০০ মিলিয়ন, এশীয় উন্নয়ন ব্যাংক ৬১৫.০০ মিলিয়ন, জাইকা ৪১৫.০০ মিলিয়ন, ইসলামী উন্নয়ন ব্যাংক ১৪০.০০ মিলিয়ন ডলার ঋণ সহায়তার প্রস্তাব দেয়। পক্ষান্তরে বাংলাদেশ সরকার নিজস্ব তহবিল হতে ৬১৭.০০ মিলিয়ন ডলার প্রদানের সিদ্ধান্ত নেয়। সেসময়ে সর্বমোট প্রকল্প ব্যয় ধরা হয় ২৯৭২.০৬ মিলিয়ন মার্কিন ডলার; অর্থাৎ বাংলাদেশী টাকায় ২০,৫০৭.২০ কোটি টাকা। এ সেতু প্রকল্পে মোট ৫টি প্যাকেজ রয়েছে। ৫টি প্যাকেজের মধ্যে মূল সেতু নির্মাণে ৮৩৯৬.২২ কোটি, নদী শাসনে ৪৪০৬.১৫ কোটি, সংযোগ সড়ক নির্মাণে ১২৭৫.০৭ কোটি, ভূমি অধিগ্রহণ ও পুনর্বাসনে ২৩৭৯.৮২ কোটি টাকা এবং নির্মাণ তদারকি পরামর্শক নিয়োগের জন্য ৩৪৬.৪৫ কোটি টাকা বরাদ্দ রাখা হয়। মূল সেতু প্রাক যোগ্যতা নির্ধারণী প্রক্রিয়ায় ১১টি আন্তর্জাতিক প্রতিষ্ঠান অংশগ্রহণ করে। তন্মধ্য হতে বিশ্বব্যাংকের নির্ধারিত মানদ- অনুসরণপূর্বক মূল্যায়ন শেষে ৫টি প্রতিষ্ঠানকে যোগ্য এবং ৬টি প্রতিষ্ঠানকে অযোগ্য বিবেচনা করে বিশ্বব্যাংকের অনুমোদনের জন্য প্রেরণ করা হয়। ইতোমধ্যে ডিজাইনের আংশিক পরিবর্তন হওয়ায় বিশ্বব্যাংক পুনরায় দরপত্রের আবেদন আহ্বানের পরামর্শ দেয়। সে পরামর্শ অনুযায়ী কার্যক্রম শেষে দেখা যায় যে, পূর্বের ৫টি প্রতিষ্ঠানই পুনরায় দরপত্রের যোগ্য বিবেচিত হয়েছে। ফলে তা বিশ্বব্যাংকের অনুমোদনের জন্য প্রেরণ করা হয়। ১ জুলাই ২০১১ তারিখে প্রাক যোগ্যতা মূল্যায়ন সংক্রান্ত প্রতিবেদনে বিশ্বব্যাংক সম্মতি প্রদান করে। এ প্রক্রিয়া চলাকালীন টেন্ডার প্রক্রিয়ায় অংশগ্রহণকারী চায়না রেলওয়ের ফিফটিন ব্যুরো গ্রুপ কর্পোরেশনের বরাত দিয়ে এর স্থানীয় এজেন্ট জনৈক হেলাল উদ্দিন দাবি করেন যে, তাদের মূল প্রতিষ্ঠানে একটি চিঠি প্রেরণ করা হয়েছে এবং ওই চিঠিতে বাংলাদেশের একটি প্রতিষ্ঠান তাদের সঙ্গে যোগাযোগসাপেক্ষে সর্বাত্মক সহযোগিতার আশ্বাস দিয়েছে। ওই পত্রের একটি কপি বিশ্বব্যাংকের ওয়াশিংটনের প্রধান কার্যালয়ে ও ঢাকার কান্ট্রি ডিরেক্টরের কাছে প্রেরণ করা হয়। তৎপ্রেক্ষিতে বিশ্বব্যাংক সরকারের নীতি-নির্ধারণী পর্যায়ে পত্রটি প্রেরণ করে এবং অনুসন্ধানের জন্য অনুরোধ করা হয়। বিশ্বব্যাংকের রেফারেল রিপোর্টের একটি কপি দুর্নীতি দমন কমিশনপ্রাপ্ত হলে দুর্নীতি দমন কমিশন অনুসন্ধানের সিদ্ধান্ত গ্রহণ করে। অনুসন্ধানকালে কথিত চিঠির যথার্থতা যাচাইয়ের জন্য চায়না রেলওয়ের ফিফটিন ব্যুরো গ্রুপ কর্পোরেশনের সঙ্গে ই-মেইলে যোগাযোগ করা হলে তারা জানান যে, এ ধরনের পত্র তারা পাননি এবং তাদের স্থানীয় প্রতিনিধি হেলাল উদ্দিনের নিকট এ সংক্রান্ত পত্র তারা প্রেরণ করেননি। ওই কথিত হেলাল উদ্দিনের সঙ্গে যোগাযোগের চেষ্টা করা হলে তিনি সশরীরে হাজির না হয়ে ফোনে জানান যে, তিনি পত্রটি মেইলের মাধ্যমে প্রিন্সিপালের নিকট থেকে প্রাপ্ত হয়েছেন। তিনি জানান, মূলকপি তার নিকট নেই। এই কথিত হেলালউদ্দিন কখনও দুদকের মুখোমুখি হয়নি এবং আত্মগোপনেই রয়েছে। তার কোন খোঁজ পাওয়া যায়নি। উল্লেখ্য, প্রিন্সিপাল অর্থাৎ চায়না রেলওয়ের ফিফটিন ব্যুরো কর্পোরেশন এই পত্রের বিষয়টি সম্পূর্ণ অস্বীকার করেছে। যে প্রতিষ্ঠানটির উদ্ধৃতি দেয়া হয়েছে সে প্রতিষ্ঠানটিও এ বিষয়ে তাদের অজ্ঞতা প্রকাশ করে এবং বিস্মিত হয়। ওই পত্রের কপি পর্যালোচনায় এটা সুস্পষ্ট ধারণা পাওয়া যায় যে, সৃজিত প্যাডে স্বাক্ষর সুপার ইমপোজ করে ষড়যন্ত্রের অংশ হিসেবে পত্রটি সৃজন করা হয়েছে। কেননা মূল পত্রের কোন অস্তিত্ব পাওয়া যায়নি এবং চীনের যে কোম্পানির বরাত দিয়ে পত্রের কপি সরকার ও বিশ্বব্যাংকে দেয়া হয়েছে চীনা কোম্পানিও তা অস্বীকার করেছে। প্রাপ্ত অভিযোগের বিষয়ে প্রাক যোগ্য ৫টি প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে ই-মেইল ও ডাকযোগে যোগাযোগ করা হলে তারা সকলেই এক ও অভিন্ন ভাষায় জানায় যে, বাংলাদেশের কোন প্রতিষ্ঠানের পক্ষে তাদের সঙ্গে যোগাযোগ করে সাইলেন্ট এজেন্ট নিয়োগের শর্তে সর্বাত্মক সহযোগিতা প্রদানের আশ্বাস দেয়া হয়নি। ওই ৫টি যোগ্য বিবেচিত প্রতিষ্ঠান দুর্নীতি দমন কমিশনের অনুসন্ধান টিমকে জানায়, প্রাক যোগ্যতা নির্ধারণী দরপত্রের বিষয়ে তাদের কোন অনিয়মের অভিযোগ নেই। অভিযোগের সমর্থনে কোন দালিলিক বা মৌখিক সাক্ষ্যপ্রমাণ না পাওয়ায় বিশ্বব্যাংকের আনীত প্রথম অভিযোগের সত্যতা প্রমাণিত হয়নি। উল্লেখ্য, সেসময়ে কোন কার্যাদেশও প্রদান করা হয়নি এবং কোন দাতা সংস্থা অর্থ ছাড়ও করেনি। দুর্নীতি দমন কমিশনের অনুসন্ধানে প্রমাণিত হয়েছে যে, বিতর্কিত পত্রখানা উদ্দেশ্যমূলকভাবে সৃজনকৃত এবং ভুয়া। উল্লেখ্য, অযোগ্য বিবেচিত অপর একটি প্রতিষ্ঠান ‘চায়না রেলওয়ে কনস্ট্রাকশন কোম্পানি’র প্রাক যোগ্যতা বিবেচনার জন্য তাদের দরপত্র পুনঃপরীক্ষার বিষয়ে দুইবার মূল্যায়ন কমিটিকে অনুরোধ করা হয়েছিল। ওই প্রতিষ্ঠানের অনুকূলে দেশের বাইরের সংশ্লিষ্ট শক্তিশালী একটি মহলের সমর্থন ছিল। মূল্যায়ন কমিটি তাদের অনুরোধের প্রেক্ষিতে দুইবার তাদের সুযোগ দেয়। কিন্তু তারা বারংবার ভুল তথ্য ও প্রতারণার আশ্রয় নেয়ায় বিবেচনায় আসতে পারেনি। অবশেষে তারা প্রাক যোগ্যতার আবেদন প্রস্তাব প্রত্যাহার করে নেয় এবং তাদের স্থানীয় এজেন্ট ভেঞ্চার ইন্টারন্যাশনাল লিমিটেডের এজেন্সিশিপ বাতিল করে। সেই সিআরসিসি কোম্পানির স্থানীয় এজেন্ট জনৈক ক্যাপ্টেন রেজা সেতু কর্তৃপক্ষকে ভবিষ্যতের খারাপ পরিণতির হুমকি দিয়ে আত্মগোপনে চলে গেছেন। দুর্নীতি দমন কমিশন কর্তৃক তাদের অনুসন্ধান কার্যক্রমে ও সিদ্ধান্তের একটি সারসংক্ষেপ বিশ্বব্যাংকের জ্ঞাতার্থে তাদের সদর দফতরে প্রেরণ করা হয়। এ অনুসন্ধান প্রতিবেদন সম্পর্কে বিশ্বব্যাংকের কোন মন্তব্য পাওয়া যায়নি। এভাবে প্রথম অভিযোগের সমাপ্তি ঘটে। প্রথমোক্ত অভিযোগের অনুসন্ধান চলাকালীন ০৪.০৯.২০১১ তারিখে ‘দৈনিক ইত্তেফাক’ ও ‘দৈনিক সমকাল’ পত্রিকায় ‘পদ্মা বহুমুখী সেতু প্রকল্প’র নির্মাণ তদারকি পরামর্শক নিয়োগের প্রক্রিয়ায় অনিয়ম ও দুর্নীতির অভিযোগ প্রকাশিত হলে দুদক স্ব-প্রণোদিত হয়ে অনুসন্ধানের সিদ্ধান্ত নেয়। এ পরামর্শক নিয়োগ প্যাকেজে অর্থের বরাদ্দ ছিল সর্বনিম্ন মাত্র ৫০ মিলিয়ন মার্কিন ডলার, অর্থাৎ ৩৪৬.৪৫ কোটি টাকা। দরপত্র আহ্বান করা হলে ১৩টি আন্তর্জাতিক প্রতিষ্ঠান আগ্রহ প্রকাশ করে প্রস্তাব দাখিল করে। তন্মধ্যে ৫টি প্রতিষ্ঠানকে এড়ড়ফ এৎধফব এ ৎধঃরহম করা হয়। মূল্যায়ন কমিটি কর্তৃক কারিগরি ও আর্থিক মূল্যায়নের ক্রমানুসারে ঝঘঈ খধাধষরহ-ঈধহধফধ ১ম, ঐধষপৎড়ি এৎড়ঁঢ় ট.ক. ২য়, ঐরময ঢ়ড়রহঃ ৎবহফধষ-ট.ক. ৩য়, অবপড়স ঘবুিবধষধহফ ৪র্থ, ঙৎরবহঃধষ ঈড়হংঁষঃধহঃং, ঔধঢ়ধহ ৫ম স্থানে নির্ধারিত হয়। কারিগরি ও আর্থিক মূল্যায়ন ১০০ নম্বরের মধ্যে ০.০২৫ নম্বর বেশি পেয়ে ঝঘঈ খধাধষরহ-ঈধহধফধ ১ম থাকায় মূল্যায়ন কমিটি তাদের কার্যাদেশ প্রদানের সুপারিশ করে কিন্তু বিশ্বব্যাংক সম্মতি দেয়নি। পরামর্শক নিয়োগ সংক্রান্ত অনুসন্ধান চলাকালীন বিশ্বব্যাংক অনুসন্ধান ও তদন্ত কার্যক্রমে সহায়তা প্রদানের জন্য সরকারের বরাবর পত্র প্রেরণ করলে দুর্নীতি দমন কমিশনের সঙ্গে পরামর্শক্রমে শর্তসাপেক্ষে বিশ্বব্যাংকের সহায়তা গ্রহণ করতে আমরা রাজি আছি মর্মে সরকারকে জানিয়ে দেয়া হয়। দুর্নীতি দমন কমিশনের স্বাধীনতা এবং আইন ও বিধিকে সমুন্নত রেখে বিশ্বব্যাংকের সহায়তা গ্রহণে আমরা রাজি হয়েছিলাম শুধু দেশ ও জনগণের স্বার্থে। আমরা এটাও ভেবেছি যে, বিশ্বব্যাংকের ঊীঢ়বৎঃ ঃবধস অনুসন্ধান ও তদন্ত কার্যক্রমে সম্পৃক্ত হলে তারা তদন্ত কার্যক্রমে দুদকের স্বচ্ছতা সম্পর্কে অবহিত হবে এবং তারাও প্রাপ্ত তথ্য-উপাত্তের ভিত্তিতে মতামত প্রদানসহ প্রয়োজনীয় সহযোগিতা দেবে। আন্তর্জাতিক খ্যাতিসম্পন্ন আইনজীবী খঁরং গড়ৎবহড় ঙপধসঢ়ড়-এর নেতৃত্বে ৩ সদস্যবিশিষ্ট বিশ্বব্যাংকের ঊীঃবৎহধষ চধহবষ ড়ভ ঊীঢ়বৎঃং-এর অপর দুই সদস্য ছিলেন হংকংয়ের দুর্নীতি দমন কমিশনের কমিশনার ঞরসড়ঃযু ঞড়হম এবং ট.ক. ঝবৎরড়ঁং ঋৎধঁফ ড়ভভরপব-এর পরিচালক জরপযধৎফ অষফবৎসধহ. কোন কোন মহল থেকে উচ্চক্ষমতাসম্পন্ন এ বিশেষ চধহবষ-কে মোকাবেলা করা দুর্নীতি দমন কমিশনের পক্ষে সম্ভব নয়Ñ এমন সন্দেহ প্রকাশ করা হয়েছিল। তাদের এই সন্দেহ যে অমূলক ছিল তা পরবর্তী সময় আমরা আমাদের দক্ষতা ও সক্ষমতা দিয়ে প্রমাণ করেছি। এটা স্বীকৃত যে, পদ্মা সেতু প্রকল্পে কোন ঘুষ লেনদেন হয়নি বা কোন দুর্নীতি হয়নি। কেননা অর্থ বরাদ্দ হলেও কোন অর্থ ছাড় করা হয়নি। ঊীঃবৎহধষ চধহবষ-এর সঙ্গে আলোচনাকালে দুর্নীতি না হলেও দুর্নীতির ষড়যন্ত্র হয়েছিল মর্মে চধহবষ-এর পক্ষ থেকে দাবি করা হয়। আমরা এই ‘দুর্নীতির ষড়যন্ত্র’ সংক্রান্ত অপরাধের তথ্য-উপাত্ত, দালিলিক, মৌখিক এবং ঘটনাপ্রবাহ দ্বারা সমর্থনের জন্য পর্যাপ্ত তথ্য চেয়েছিলাম। বিশ্বব্যাংকের জবভবৎৎধষ জবঢ়ড়ৎঃ অভিযোগের ভিত্তি হলেও ওই জবঢ়ড়ৎঃ-এ বর্ণিত বক্তব্যসমূহের সমর্থনে প্রণিধানযোগ্য পর্যাপ্ত সাক্ষ্যের অভাব ছিল। বিশ্বব্যাংকের অভিযোগে অপরাধের যে চরিত্র ও প্রকৃতির বর্ণনা দেয়া হয়েছিল তা সাক্ষ্য দ্বারা প্রমাণিত হলে দ-বিধি ১২০ (খ) ধারা প্রয়োগের সুযোগ সৃষ্টি হতো। দ-বিধি ১২০ ধারায় অপরাধ সংগঠনের প্রয়োজনীয় উপাদানের (রহমৎবফরবহপব) বিষয় উল্লেখ করা হয়েছে। দ-বিধি ১২০-এর (ক) ও (খ) তে অপরাধমূলক ষড়যন্ত্রের বিষয়টি বর্ণিত আছে। কোন অপরাধ সংগঠনের জন্য ষড়যন্ত্র বা পরিকল্পনা প্রয়োজনীয় উপাদানসমূহের সংজ্ঞা তথায় উল্লেখ আছে। আলোচ্য ক্ষেত্রে অপরাধটি হলো ঘুষ সম্পর্কিত দুর্নীতি। দ-বিধি ১২০-এর (ক) ও (খ) ধারার সংজ্ঞা অনুযায়ী দরপত্র মূল্যায়ন সম্পর্কিত সংঘটিত ঘটনাপ্রবাহ ও গৃহীত কার্যক্রম চলাকালীন ঘুষগ্রহণের জন্য ষড়যন্ত্র বা পরিকল্পনার উপাদানসমূহের অস্তিত্ব থাকলে দ-বিধির এই ধারায় অপরাধ সংঘটিত হয়েছে মর্মে সিদ্ধান্তে আসা যায়। আলোচ্য ক্ষেত্রে ঘটনাপ্রবাহ ও আইনে সুদৃঢ় ভিত্তির আলোকে ওই উপাদানসমূহের অস্তিত্ব আছে কিনাÑ এরূপ তথ্য বিশ্বব্যাংকের ঊীঃবৎহধষ চধহবষ-এর নিকট আমরা চেয়েছিলাম। তারা আমাদের ভবিষ্যতে সরবরাহ করবেন মর্মে জানিয়েছিলেন। ঝঘঈ খধাধষরহ-এর কর্মকর্তা রমেশ সাহা ও ইসমাইলের প্রদত্ত জবানবন্দী, কথিত ডায়েরি এবং সংশ্লিষ্ট অন্যান্য তথ্যাদির তদন্তের জন্য আবশ্যকীয় উপাদান হলেও আমাদের তা সরবরাহ করা হয়নি। দুর্নীতি দমন কমিশন কর্তৃক স্ব-উদ্যোগে গখঅজ (পরস্পর আইনগত সহায়তা চুক্তি)-এর আলোকে জড়ুধষ ঈধহধফরধহ গড়ঁহঃবফ চড়ষরপব এবং ঈধহধফরধহ উবঢ়ধৎঃসবহঃধষ ড়ভ ঔঁংঃরপব-এর নিকট ওই তথ্য পাওয়ার চেষ্টা করা হয়। তৎকালীন দুর্নীতি দমন কমিশনের মুখ্য আইনজীবী বর্তমানে আইনমন্ত্রী আনিসুল হকসহ তদন্ত কর্মকর্তা ঈধহধফধ গমন করেন এবং কানাডায় বাংলাদেশের হাইকমিশনের সহায়তায় ওই তথ্য সংগ্রহের চেষ্টা করেন। জোরালো চেষ্টা সত্ত্বেও কানাডিয়ান আইনের সীমাবদ্ধতার কারণে তা সংগ্রহ করা সম্ভব না হলেও ঙহঃধৎরড় ঈড়ঁৎঃ ড়ভ ঔঁংঃরপব এ ঝঘঈ খধাধষরহ-এর বিরুদ্ধে ঘুষ প্রদানের ইচ্ছা পোষণ ও কার্যাদেশ পাওয়ার জন্য পৃথক অর্থ বরাদ্দ রাখার অভিযোগে বিচার কার্যক্রমে সাক্ষীদের সাক্ষ্যের কিছু সারসংক্ষেপ সংগ্রহ করা সম্ভব হয়। অভিযোগকারী বিশ্বব্যাংকের আশ্বাস সত্ত্বেও প্রয়োজনীয় তথ্য-উপাত্ত না পাওয়ায় দুর্নীতি দমন কমিশন তাদের প্রাপ্ত তথ্য-উপাত্ত, দালিলিক ও মৌখিক সাক্ষ্য এবং কানাডার আদালতের সাক্ষ্যের সারসংক্ষেপকে ভিত্তি করে তাদের তদন্তকার্য পরিচালনা করে। তদন্তে এটা প্রতিভাত হয় যেÑ ক. পদ্মা বহুমুখী সেতু প্রকল্পের নির্মাণ তদারকি পরামর্শক নিয়োগের যে মূল্যায়ন করা হয়েছে সেই মূল্যায়ন বিশ্বব্যাংকের গাইডলাইন ও জবয়ঁবংঃ ভড়ৎ চৎড়ঢ়ড়ংধষ-এর নীতিমালার আলোকে মূল্যায়ন কার্য সম্পাদন করা হয়েছে; খ. মূল্যায়ন প্রক্রিয়ায় প্রতিটি পর্যায়ে বিশ্বব্যাংকের সম্মতি (ঈড়হপঁৎৎবহপব) নেয়ার পরই পরবর্তী পদক্ষেপ গ্রহণ করা হয়েছে; গ. নির্মাণ তদারকি পরামর্শক নিয়োগের টেন্ডার প্রক্রিয়ার প্রতিটি পর্যায় যেমন- ঝযড়ৎঃ ষরংঃ প্রতিষ্ঠান নির্বাচন, জবয়ঁবংঃ ভড়ৎ চৎড়ঢ়ড়ংধষ, কমিটি গঠন, কারিগরি মূল্যায়ন অনুমোদনের ক্ষেত্রে বিশ্বব্যাংকের সম্মতি (ঈড়হপঁৎৎবহপব) নেয়া হয়েছে। এক্ষেত্রে বিশ্বব্যাংকের কোন আপত্তি পাওয়া যায়নি এবং মূল্যায়নের বিভিন্ন পর্যায়ে বিশ্বব্যাংকের পরামর্শ নিয়ে মূল্যায়ন কাজ করা হয়েছে; ঘ. মূল্যায়ন কমিটি কর্তৃক যে কারিগরি ও আর্থিক মূল্যায়ন করা হয়েছে সেই মূল্যায়নের বিষয়ে বিশ্বব্যাংকের কোন প্রশ্ন বা অভিযোগ নেই; ঙ. মূল্যায়ন কমিটির অপর একজন গুরুত্বপূর্ণ সদস্য ছিলেন বিশ্বব্যাংকের সাবেক কর্মকর্তা ও প্রকিউরমেন্ট স্পেশালিস্ট ড. দাউদ আহমেদ। তিনিও অনুসন্ধানকালে ই-মেইলের মাধ্যমে জানান যে, এই মূল্যায়ন চলাকালে সাবেক মন্ত্রী বা সেতু বিভাগের সচিব বা অন্য কোন উর্ধতন সরকারী কর্মকর্তা তার সঙ্গে সাক্ষাত করেনি বা মূল্যায়ন কাজে কোন প্রভাব বিস্তার করেনি। ঝঘঈ-খধাধষরহ কে যে নির্বাচন করা হয়েছে, তা বিশ্বব্যাংকের বিদ্যমান নীতিমালার আলোকে নির্বাচিত করা হয়েছে; চ. অনুসন্ধানকালে ৫টি জবংঢ়ড়হংরাব প্রতিষ্ঠানসমূহের নিকট অভিযোগের বিষয়ে কোন তথ্য প্রমাণ রয়েছে কি-না, সে বিষয়ে সহযোগিতা করার জন্য তাদের নিকট ই-মেইল প্রেরণ করা হলে ঙৎরবহঃধষ ঈড়হংঁষঃধহঃং ঈড়. খঃফ. এবং ঝঘঈ খধাধষরহ ওহঃবৎহধঃরড়হধষ খঃফ. এ বিষয়ে আদৌ কোন তথ্য প্রেরণ করেননি। তবে ঐরময চড়রহঃ জবহফবষ খরসরঃবফ ই-মেইলের মাধ্যমে জানান যে, পদ্মা বহুমুখী সেতু প্রকল্পের মূল্যায়ন প্রক্রিয়ায় তাদের নিকট কোন সুনির্দিষ্ট অভিযোগ বা দালিলিক কোন তথ্যপ্রমাণ নেই। অপরদিকে ঐধষপৎড়ি এৎড়ঁঢ় খঃফ. এ বিষয়ে সরাসরি কোন জবাব দেয়নি। তারা বিষয়টি কবে নিষ্পত্তি হবে সে বিষয়ে প্রশ্ন রাখেন। অর্থাৎ ঐধষপৎড়ি মৎড়ঁঢ় খঃফ. এর নিকট থেকেও কোন সুনির্দিষ্ট অভিযোগ বা দালিলিক কোন তথ্যপ্রমাণ পাওয়া যায়নি। আলোচিত ডায়েরির কোন অস্তিত্ব নেই। কানাডার আদালতে বিচারাধীন মামলায় প্রদত্ত সাক্ষ্যসমূহের সারসংক্ষেপ পর্যালোচনা করলে একটি নোট প্যাডে ঝঘঈ খধাধষরহ এর কর্মকর্তা রমেশ সাহার পার্সেন্টেজ নোট করার অস্তিত্ব ছিল মর্মে ধারণা করা যায়। উক্ত নোট প্যাডে যে বিষয়টি নোট করা হয়েছে সে বিষয়ে সুস্পষ্ট ধারণা পেতে হলে রমেশ সাহার বক্তব্য জানা প্রয়োজন। তার বক্তব্য আমরা গখঅজ-এর মাধ্যমে পাইনি। কথিত ঘড়ঃবঢ়ধফ অভিযোগকারীর পক্ষ থেকে সরবরাহ করা হয়নি। কথিত নোটপ্যাডের বিষয়বস্তু সম্পর্কে নিরপেক্ষ সাক্ষী ও সমর্থনযোগ্য দালিলিক তথ্যপ্রমাণ পাওয়া যায়নি। ঘুষের যে পার্সেন্টেজের কথা বলা হয়েছে, তা একটি পক্ষের নিজস্ব ধারণা বা তাদের মনগড়া ব্যাপার। বিশ্বব্যাংক স্বীকার করে যে ঘুষ লেনদেন হয়নি। তাদের দাবি ষড়যন্ত্র হয়েছে। ঘড়ঃবঢ়ধফ এ লেখার অন্তর্নিহিত উদ্দেশ্য লেখকের ওপর বর্তায়। কিন্তু উক্ত প্যাডে উল্লিখিত সাঙ্কেতিক ব্যক্তিরা ঘুষ গ্রহণের পরিকল্পনা বা ষড়যন্ত্রের সঙ্গে সম্পৃক্ত ছিলেনÑ এমন তথ্য পাওয়া যায়নি। আক্ষরিক অর্থে আগ্রহের বাস্তব প্রকাশ ও গ্রহণে স্বীকৃতির অকাট্য প্রমাণ ঘটনাপ্রবাহ ও মৌখিক বা দালিলিক সাক্ষ্য দ্বারা সমর্থিত না হলে পরিকল্পনা বা ষড়যন্ত্রের অস্তিত্ব কোথায়? ঢ যদি ণ কে ঘুষ দেয়ার পরিকল্পনা করে সেটা সম্পর্কে যদি ণ জ্ঞাত না থাকে তাহলে ণ কে তো দোষী করা যায় না। কারণ ণ তো জানেই না ঢ এর পরিকল্পনা। ঝঘঈ খধাধষরহ এর কোন কর্মকর্তা যদি কথিত নোটপ্যাডে সম্ভাব্য ঘুষের তালিকা লিখেন এবং সে সম্পর্কে যদি তালিকায় উল্লিখিত ব্যক্তিগণ না জানেন বা তারা এ পরিকল্পনা বা ষড়যন্ত্রের সঙ্গে জড়িত না থাকেন তাহলে কোন্ যুক্তিতে তাদের দুর্নীতির ষড়যন্ত্রের অভিযোগে অভিযুক্ত করা যাবে? দুর্নীতি দমন কমিশন গুরুত্বসহকারে নিষ্ঠার সঙ্গে ‘দুর্নীতির জন্য ষড়যন্ত্র’ নামক অভিনব এ অনুসন্ধান ও তদন্ত কার্যক্রম পরিচালনা করেছে এবং এক্ষেত্রে স্বচ্ছতার কোন ঘাটতি ছিল না। ‘দুর্নীতির জন্য ষড়যন্ত্রের’ অভিযোগ প্রমাণিত না হওয়ায় গত ০৪/০৯/২০১৪ তারিখে চূড়ান্ত প্রতিবেদন দাখিল করা হয়। তদন্তকালীন সময়ে দাতাগোষ্ঠীর নিকট হতে প্রতিশ্রুত ঋণসহায়তা পাওয়ার স্বার্থে কোন কোন মহল থেকে বিশ্বব্যাংকের অভিযোগ নিষ্পত্তিতে দুদককে কৌশলী অবস্থান গ্রহণ করার পরোক্ষ ইঙ্গিত দেয়া হলেও দুদক বিবেকের তাড়নায় সত্য ঘটনা প্রকাশের দায়িত্ব থেকে বিচ্যুত হয়নি। আমরা অহেতুক সমালোচিত হয়েছি কিন্তু বিবেককে প্রশ্নবিদ্ধ হতে দেইনি। আমার দৃঢ়বিশ্বাস গোয়েবলসীয় কায়দায় পদ্মা সেতু নিয়ে অপপ্রচার হয়েছে। একটি মিথ্যাকে বারংবার বললে সেটি সত্যের মতো শোনায়। পদ্মা সেতুর বেলায়ও বারবার বলা হয়েছে দুর্নীতির ষড়যন্ত্র হয়েছে। এ ষড়যন্ত্রের বিষয়টি জনগণের মগজে ঢুকিয়ে দেয়ার চেষ্টা করা হয়েছে। এই অপপ্রচার বারবার করিয়ে বিশ্বাসযোগ্য করে তোলার চেষ্টা করা হয়েছে যে, এ ষড়যন্ত্রের সঙ্গে বাংলাদেশের একাধিক ব্যক্তি জড়িত। অবশেষে দুদকের তদন্তে এসব অপপ্রচার ভিত্তিহীন হিসেবে প্রমাণিত হয়েছে। আজ সত্য প্রতিষ্ঠিত হয়েছে এবং দৃঢ়প্রত্যয়ী, সাহসী দেশপ্রেমিক মাননীয় প্রধানমন্ত্রী দাতাগোষ্ঠীর সহায়তা ব্যতীত সম্পূর্ণ নিজস্ব অর্থায়নে স্বপ্নের পদ্মা সেতু নির্মাণের কাজ এগিয়ে নিয়ে যাচ্ছেন। লেখক : মুক্তিযোদ্ধা, কমিশনার দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক)
×