ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৯ মার্চ ২০২৪, ১৪ চৈত্র ১৪৩০

রোকসানা বেগম

বাংলাদেশ আর মাশরাফির বছর

প্রকাশিত: ০৪:৩৫, ৩০ ডিসেম্বর ২০১৫

বাংলাদেশ আর মাশরাফির বছর

‘ছু মন্তর ছু...’ জাদুকররা জাদু দেখানোর আগে এমনই বলে থাকেন। সেই জাদুর ছোঁয়া যেন বাংলাদেশ ক্রিকেটেও এ বছর লেগেছে। অধিনায়ক মাশরাফি বিন মর্তুজা যেন সেই জাদুকর। বছরটি বাংলাদেশের হওয়ার সঙ্গে মাশরাফিময়ও হয়েছে। তার হাত ধরেই যে সেরা বছরটি পেল বাংলাদেশ। শুধু আন্তর্জাতিক ক্রিকেটেই নয়, ঘরোয়া ক্রিকেট বিপিএলও মাশরাফিময় হয়েছে। ২০১৫ সালটি বাংলাদেশের জন্য সাফল্যে মোড়ানো বছর। একসঙ্গে অনেক প্রাপ্তি মিলে গেছে। দলীয় ও ব্যক্তিগত প্রাপ্তির দিক থেকে অন্য যে কোন বছরের চেয়েও বেশি অর্জন মিলেছে। মুশফিকুর রহীমকে নেতৃত্ব থেকে সরিয়ে মাশরাফির হাতে ওয়ানডে ও টি২০ ম্যাচের নেতৃত্ব তুলে দেয়া হলো। সেই থেকেই বদলে গেল যেন বাংলাদেশ ক্রিকেট দল। ওয়ানডে বিশ্বকাপে প্রথমবারের মতো কোয়ার্টার ফাইনালে উঠে বাংলাদেশ। পাকিস্তানের মতো শক্তিশালী দলকে ১৯৯৯ সালের পর আবার হারানোর সঙ্গে প্রথমবারের মতো হোয়াইটওয়াশ করে। ভারত ও দক্ষিণ আফ্রিকাকেও সিরিজে হারিয়ে দিয়ে র‌্যাঙ্কিংয়ের সেরা আটে উঠে। ২০১৭ সালের আইসিসি চ্যাম্পিয়ন্স ট্রফিতে খেলার যোগ্যতা অর্জন করে নেয়। বিশ্বের সব শক্তিশালী দলকেই ভালভাবে বুঝিয়ে দেয়া গেছে, এখন কোনভাবেই ‘হেলা-ফেলা’র দল নয় বাংলাদেশ। মাশরাফির নেতৃত্বে ড্রেসিংরুম থেকে শুরু করে সব স্থানে ক্রিকেটাররা অন্যরূপে উপস্থাপন হয়েছেন। তাতে একের পর এক জয় মিলেছে। শত ঝামেলার মাঝেও বিশ্বকাপে রুবেল হোসেন জৌলুস ছড়িয়েছেন। বিশ্বকাপে ইংল্যান্ডের বিপক্ষে শেষ মুহূর্তে যে ২ উইকেট নিয়েছেন রুবেল, তা এখনও সবার চোখে ভাসে। বিশ্বকাপে মাহমুদুল্লাহর সেঞ্চুরি করার মধ্য দিয়ে প্রথমবারের মতো কোন বাংলাদেশী ব্যাটসম্যানের বিশ্বকাপে সেঞ্চুরি করার কৃতিত্বও দেখা গেছে। ‘ব্যাক টু ব্যাক’ সেঞ্চুরি করেছেন মাহমুদুল্লাহ। পাকিস্তানের বিপক্ষে লড়াই করে টেস্টে ড্র করা। তামিম-ইমরুলের ৩১২ রানের জুটি গড়া, যা টেস্ট ম্যাচটাকে ড্রয়ের পথে নিয়ে যায়। তামিমের ডাবল সেঞ্চুরি করা। সবকিছুই সাফল্যের মুহূর্ত হয়ে ধরা দিয়েছে। মুস্তাফিজুর রহমানের আবির্ভাব ও বছর শেষে বিপিএলের মাধ্যমে আবু হায়দার রনির মতো বোলারের আবির্ভাব সাফল্যে যুক্ত হয়েছে। সৌম্য সরকার, সাব্বির রহমান রুম্মনদের তারকাখ্যাতিও এ বছরেই মিলেছে। বিপিএলে সাদামাটা একটি দলকে চ্যাম্পিয়ন করান মাশরাফি। এখানেও মাশরাফিই সেরা হয়ে উপস্থাপন হন। তবে সবকিছুকে ছাপিয়ে ওয়ানডেতে যে এ বছরটিতে যে কোন বছরের চেয়ে বেশি সাফল্য মিলেছে, তাই বছরটিকে রাঙ্গিয়ে তুলেছে। সাফল্যম-িতই হয়ে আছে বছরটি। যে কোন বছরের চেয়ে এ বছর নিজেদের ক্রিকেট ইতিহাসের সেরা সাফল্য মিলেছে। সেই ১৯৮৬ সালের ৩১ মার্চ থেকে ঊনত্রিশ বছর সাত মাস ধরে ওয়ানডে ক্রিকেট খেলছে বাংলাদেশ। ২০১৫ সালে এসে নিজেদের ক্রিকেট ইতিহাসের সর্বোচ্চ সাফল্যই মিলেছে বাংলাদেশের। এ বছর ১৮ ম্যাচের ১৩টিতেই জিতেছে। তাও আবার ইংল্যান্ড, পাকিস্তান, ভারত, দক্ষিণ আফ্রিকার মতো দলকে হারিয়েছে। পাকিস্তানকে তো ১৯৯৯ সালের পর দ্বিতীয়বারের মতো হারিয়েছে। প্রথমবারের মতো সিরিজে হারানোর সঙ্গে পাকিদের হোয়াইটওয়াশও করে দিয়েছে বাংলাদেশ। ভারত ও দক্ষিণ আফ্রিকাকেও প্রথমবারের মতো সিরিজে হারিয়েছে। আর বিশ্বকাপে প্রথমবারের মতো কোয়ার্টার ফাইনালে উঠেছে। এ বছর একটি সিরিজেও হারেনি মাশরাফিবাহিনী। এমনকি দেশের মাটিতে ১২ ম্যাচ খেলে মাত্র ২টি ম্যাচ হেরেছে! টানা চার সিরিজ জিতেছে। বিশ্বকাপ দিয়েই এ বছর শুরু করে বাংলাদেশ। বছরের প্রথম ম্যাচেই জয় তুলে নেয়। অস্ট্রেলিয়া-নিউজিল্যান্ডে হওয়া বিশ্বকাপে আফগানিস্তানকে ১০৫ রানের বড় ব্যবধানে হারিয়েই বছর শুরু করে। এরপর অস্ট্রেলিয়ার বিপক্ষে ম্যাচটি বৃষ্টিতে পরিত্যক্ত হয়ে যায়। শ্রীলঙ্কার কাছে পরের ম্যাচটিতেই ৯২ রানে হারে। পরের ম্যাচেই আবার জয় পায় বাংলাদেশ। স্কটল্যান্ডকে ৬ উইকেটে হারিয়ে দেয়। এমন অবস্থা ছিল, যে করেই হোক বিশ্বকাপের কোয়ার্টার ফাইনালে উঠতে হলে ইংল্যান্ডকে হারাতেই হবে। এমন ম্যাচে ইংলিশদের হারিয়ে দিয়ে শেষ আটে খেলা নিশ্চিত করে নেয় টাইগাররা। এরপর গ্রুপ পর্বের শেষ ম্যাচে নিউজিল্যান্ডের বিপক্ষে ৩ উইকেটে হারলেও লড়াই করে বাংলাদেশ। বিশ্বকাপে বাংলাদেশ দলটি খুবই প্রশংসিত হয়। কোয়ার্টার ফাইনালে ভারতের কাছে ১০৯ রানে হেরে বিশ্বকাপ থেকে বিদায় নেয় বাংলাদেশ। কিন্তু এ ম্যাচটি কতটা বিতর্কিত ছিল, তা সবারই জানা। বিশ্বকাপ শেষ হতেই দেশের মাটিতে টানা ম্যাচ খেলতে থাকে বাংলাদেশ। একটি করে দল আসে খেলতে, আর হারতে থাকে। বাংলাদেশ শুধুই জয়ের ধারা অব্যাহত রাখে। বিশ্বকাপের পর পাকিস্তান আসে খেলতে। প্রথম ওয়ানডেতে পাকিস্তানকে ৭৯ রানে হারিয়ে দেয় বাংলাদেশ। ১৯৯৯ বিশ্বকাপের পর পাকিস্তানের বিপক্ষে খেলা হলেই হারে বাংলাদেশ। পাকিস্তানের সঙ্গে খেলা হলেই হতাশা ঘিরে ধরে। এবার তা থেকে বের হয় বাংলাদেশ। ১৬ বছর পর পাকিস্তানকে হারায়। শুধু এক ম্যাচ হারালেই কথা ছিল, দ্বিতীয় ওয়ানডেতেও ৭ উইকেটে জিতে বাংলাদেশ। প্রথমবারের মতো টেস্ট খেলুড়ে পূর্ণশক্তির কোন দলকে সিরিজে হারিয়ে দেয় বাংলাদেশ। এমনকি তৃতীয় ওয়ানডেতে ৮ উইকেটে জিতে পাকিস্তানকে ৩-০ ব্যবধানে হারিয়ে হোয়াইটওয়াশ করার গৌরবও অর্জন করে। পাকিস্তান গো-হারা হেরে যাওয়ার পর ভারত আসে খেলতে। বাংলাদেশকে পাত্তাই দেয় না ভারত। শুরুতে শক্তিশালী দল পাঠাতেই চায়নি। শেষে পাঠায়। তাতেও লাভ হয়নি। বিশ্বকাপের কোয়ার্টার ফাইনালে হারের প্রতিশোধ শুধু বাংলাদেশ নেয় না, সিরিজেই হারিয়ে দেয়। তিন ম্যাচের ওয়ানডে সিরিজের প্রথম দুই ম্যাচেই জিতে যায় বাংলাদেশ। ভারতের বিপক্ষেও প্রথমবার সিরিজ জিতে। তৃতীয় ও শেষ ওয়ানডেতে গিয়ে হেরে যায় বাংলাদেশ। ভারতকে হোয়াইটওয়াশের দ্বারপ্রান্তে গিয়েও পারা যায়নি। এবার বাংলাদেশে খেলতে আসে দক্ষিণ আফ্রিকা। বাংলাদেশ যে ওয়ানডেতে চমক দেখাচ্ছে তাতে ভয় ছিল প্রোটিয়াদের। কিন্তু পরপর দুই টি২০তে জিতে এমন এক ভাব তৈরি হয়েছিল, যেন ওয়ানডেতে অনায়াসেই জিতে যাবে। এবি ডি ভিলিয়ার্সতো টি২০ খেলার পর ওয়ানডেতে খেললেনই না। প্রথম ওয়ানডেতেও ৮ উইকেটে জিতল দক্ষিণ আফ্রিকা। কিন্তু এরপর প্রোটিয়ারা বুঝল বাংলাদেশ এখন আর ফেলনা দল নয়। দ্বিতীয় ও তৃতীয় ওয়ানডেতে জিতে গেল বাংলাদেশ। এ বছর টানা তিন সিরিজ জিতে নিল। সিরিজ জয় দিয়েই বাংলাদেশের বছর শেষ হলো। তখনও কেউই জানত না জিম্বাবুইয়ের বিপক্ষে ওয়ানডে সিরিজ খেলা হবে। অস্ট্রেলিয়ার দুই টেস্ট খেলতে আসার কথা ছিল। কিন্তু নিরাপত্তার অজুহাত দেখিয়ে সফর স্থগিত করে দিল অসিরা। অনেক দিন বিরতি পড়ে গেল বাংলাদেশের আন্তর্জাতিক সূচীতে। জিম্বাবুইয়েকে সিরিজ খেলতে আনার চেষ্টা করল বিসিবি। জানুয়ারিতে তিন ওয়ানডে, দুই টেস্ট, দুটি টি২০ ম্যাচের সিরিজ খেলতে বাংলাদেশে আসার কথা ছিল জিম্বাবুইয়ের। বিসিবি প্রস্তাব দিল নবেম্বরে নির্ধারিত ওভারের সিরিজটি খেলতে। তাতে জিম্বাবুইয়ে রাজি হয়ে গেল। বাংলাদেশও আরেকটি ওয়ানডে সিরিজ খেলার সুযোগ পেয়ে গেল। যেটি হয়ে গেল বছরের শেষ সিরিজ। এ সিরিজে ওয়ানডেতে জিম্বাবুইয়েকে হোয়াইটওয়াশ করে দিল বাংলাদেশ। বছরটি আরও সাফল্যের রঙে রঙিন হয়ে গেল। জয় সংখ্যা আরও বেড়ে গেল। ওয়ানডেতে সেরা একটি বছরই অতিক্রম করল বাংলাদেশ। হার-জিতের হিসেবে অবশ্য ২০০৯ সালটিকেই সেরা ধরা হয়। এ বছর ১৯ ম্যাচে ১৪ জয় পায় বাংলাদেশ। হার-জিতের হিসেবে এক ম্যাচ বেশি খেলায় ২.৮০০ ভাগ সাফল্য। আর ২০১৫ সালে সাফল্য ২.৬০০। তবে ২০০৯ সালে পূর্ণশক্তির দলগুলোর মধ্যে শুধু শ্রীলঙ্কাকেই হারিয়েছিল বাংলাদেশ। ওয়েস্ট ইন্ডিজকে তিন ম্যাচের ওয়ানডে সিরিজে হোয়াইটওয়াশ করে বাংলাদেশ। তবে সেই ওয়েস্ট ইন্ডিজ দলটি পূর্ণশক্তির দল ছিল। আর সব জয়ই আসে জিম্বাবুইয়ের বিপক্ষে। ২০১৫ সালে যেহেতু ইংল্যান্ড, পাকিস্তান, ভারত, দক্ষিণ আফ্রিকার মতো দলকে হারানোর গৌরব যুক্ত হয়েছে, তাই এ বছরটিকেই সেরা ধরা হচ্ছে। গত বছরটিতো বাংলাদেশের জন্য দুর্দশাময় বছর ছিল। ১৮ ম্যাচের মধ্যে মাত্র ৫টিতে জয় মিলেছে। ২০১৪ সালের শেষদিকে যে জিম্বাবুইয়ের বিপক্ষে ৫টি জয় মিলেছে, এর আগে বছরটিতে কোন জয়েরই দেখা পায়নি বাংলাদেশ। সেই থেকেই বদলে যায় বাংলাদেশ দল। জিম্বাবুইয়ের বিপক্ষে বছরের শেষ সিরিজ থেকে বাংলাদেশ ওয়ানডে দলের নেতৃত্ব পান মাশরাফি। তার হাত ধরে দলের সাফল্যও এসে পড়ে। এরপর থেকে শুধু জয়ই ধরা দেয়। ২০১৫ সালে এসে শুধু জয়ই মিলে। সাফল্যই মিলে। এ বছর ওয়ানডেতে সাফল্যের চূড়ায় ওঠে বাংলাদেশ। মাশরাফি দলের অধিনায়ক হওয়ার আগে ২০১৪ সালে হারই যেন দলের নিয়তি ছিল, সেই দল মাশরাফির নেতৃত্বের ছোঁয়ায় শুধু জিতেই গেছে। এমনকি শেষে যে বিপিএল হলো সেখানেও জয়জয়কার মাশরাফিরই। কুমিল্লা ভিক্টোরিয়ান্স যে চ্যাম্পিয়ন হলো, সেটি মাশরাফির হাত ধরেই হলো। বিপিএলে টানা তিনবারই চ্যাম্পিয়ন অধিনায়ক হলেন মাশরাফি। জাতীয় দলকে যেমন জেতালেন, তেমনি বিপিএলেও চমক দেখালেন মাশরাফি। বছরটিতে ৫ টেস্ট খেলে একটিতে হার ও চারটিতে ড্র এবং ৫ টি২০ ম্যাচ খেলে ২টিতে জয় ও তিনটিতে হার হয়েছে। তবে ওয়ানডেতে এত বেশি সাফল্য মিলেছে যে, টেস্ট ও টি২০তে কি ফল মিলেছে- তা গৌন হয়ে গেছে। বছরটি বাংলাদেশের সঙ্গে মাশরাফিময়ই হয়ে গেছে।
×