ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ২৫ এপ্রিল ২০২৪, ১২ বৈশাখ ১৪৩১

হাকালুকি হাওড়

স্বর্গোদ্যান পরিযায়ী পাখির, প্রকৃতির অপরূপ সাজ

প্রকাশিত: ০৫:৩৯, ৩০ ডিসেম্বর ২০১৫

স্বর্গোদ্যান পরিযায়ী পাখির, প্রকৃতির অপরূপ সাজ

সালাম মশরুর ॥ প্রাকৃতিক সম্পদ ও সৌন্দর্যের ভা-ার বিশাল হাকালুকি হাওড়। মাছ, পাখি, জলজ উদ্ভিদ হাকালুকি হাওড়ের প্রাণ। প্রকৃতির এক অতুলনীয় স্থান হাকালুকি হাওড়। এশিয়ার বৃহত্তম। সিলেট ও মৌলভীবাজার জেলার সীমানায় হাকালুকি হাওড়ের অবস্থান। হাওড়জুড়ে অবস্থিত বিলগুলোতে রয়েছে বিভিন্ন প্রজাতির মাছ। বর্ষাকালে এই হাওড়ের দৃশ্য দেখা যায় ভিন্নরূপে। চারদিকে দিগন্তজুড়ে বিশাল জলরাশি। সে এক অপরূপ দৃশ্য! শীতকালে হাওড়ের সৌন্দর্য কেড়ে নিয়ে সাজে আরেক সাজে। এ সময় অতিথি পাখিরা সারি বেঁধে বিভিন্ন দেশ থেকে আসতে থাকে বিলগুলোতে। এই সব পরিযায়ী পাখির আগমনে হাওড় যেন পরিণত হয় স্বর্গোদ্যানে। আর এ সময়টায় অতিথি পাখিদের মতো মানুষের কলকাকলিও কোন অংশে কম থাকে না। শীত মৌসুমে এশিয়ার উত্তরাংশের সাইবেরিয়া থেকে পরিযায়ী পাখিদের প্রায় ২৫ প্রজাতির হাঁস এবং জলচর পাখি হাওড় এলাকায় ভ্রমণে আসে। তাদের সঙ্গে যোগ দেয় এ দেশের প্রায় ১০০ প্রজাতির পাখি। হাওড়ে পরিযায়ী হাঁসের মধ্যে রয়েছে- রাজসরালী, গরাদমাথা রাজহাঁস, চখাচখী, ধলা বেলেহাঁস, গাডোয়াল, ইউরেসীয় সিথীহাঁস, টিকীহাঁস, পাতিহাঁস প্রভৃতি আরও অসংখ্য প্রজাতির হাঁস। দেশী প্রজাতির হাঁসের মধ্যে রয়েছে- বেগুনি কালেম, পানমুরসী, পাতিকুট, ডাহুক, ইউরেসীয় মুরগি চ্যাগা, রাঙ্গাচ্যাগা, জলাপিপি, ময়ূরলেজা পিপি, পাতি জিরিয়া, হাট্টিটি, ভুবনচিল, শঙ্খচিল, কুড়াল ঈগল, বড়খোঁপা ডুবুরি, ছোট পানকৌড়ি, খয়রা বক, সাদা বক প্রভৃতি অসংখ্য পাখি। এছাড়া হাওড়ের বিলগুলোতে রয়েছে বিভিন্ন প্রজাতির মাছ। তারমধ্যে রয়েছে- আইড়, চিতল, বাউশ, পাবদা, মাগুর, শিং, কৈসহ আরও নানা প্রজাতির। শীতকাল হাকালুকি হাওড় ভ্রমণের সেরা সময়। এ সময়ে পৃথিবীর বিভিন্ন প্রান্ত থেকে পরিযায়ী পাখিদের পাশাপাশি মানুষেরও ঢল নামে। তাই নবেম্বর থেকে ফেব্রুয়ারি এই চার মাসই হাওড় ভ্রমণের সেরা সময় হিসেবে বিবেচিত হয়। বর্ষাকালে হাকালুকির বিল ও নদীগুলো একাকার হয়ে সাগরের রূপ ধারণ করে। এ সময় হাওড় ও বিলের পারসংলগ্ন বন-জঙ্গল পানির নিচে ডুবে মাছের আশ্রয়স্থলে পরিণত হয়। বর্ষাকালে হাওড়পারে বসবাসরত মানুষের মধ্যে সৃষ্টি হয় অন্যরকম উন্মাদনা। যোগাযোগ ব্যবস্থা হয় সহজ। এখানকার স্থানীয় বাজারে যাওয়ার যোগাযোগের বাহন হিসেবে স্থান করে নেয় দেশীয় দাঁড়বাহী পালতোলা ও ইঞ্জিনচালিত নৌকা। জেলেরা মেতে ওঠে মাছ ধরার উৎসবে। হাওর ॥ সিলেট ও মৌলভীবাজার জেলার ১৮.১১৫ হেক্টর জমি নিয়ে হাকালুকি হাওড়ের অবস্থান। বর্ষা এবং শীত দুটি মৌসুমেই বিশাল এই হাওড়াঞ্চল ঘুরে বেড়ানোর জন্য উপযোগী। অন্যান্য দর্শনীয় স্থানগুলোর মতো এখানেও প্রকৃতির উপচেপড়া রূপ হাতছানি দেয়। জীববৈচিত্র্যসমৃদ্ধ প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের অপূর্ব লীলাভূমি এই হাওড় বছরের বিভিন্ন সময় ভিন্ন ভিন্ন রূপ ধারণ করে থাকে। এর পূর্বে পাথারিয়া ও মাধব পাহাড় এবং পশ্চিমে ভাটেরা পাহাড় পরিবেষ্টিত হাকালুকি হাওড় মৌলভীবাজারের বড়লেখা, জুড়ি, কুলাউড়া এবং সিলেট জেলার ফেঞ্চুগঞ্জ ও গোলাপগঞ্জ এই পাঁচটি উপজেলা মিলে বিস্তৃত। ছোট-বড় ২৪০টি বিল ও ছোট-বড় ১০টি নদী নিয়ে গঠিত হাকালুকি হাওড় বর্ষাকালে প্রায় ১৮ হাজার হেক্টর এলাকায় পরিণত হয়। বাংলাদেশের মোট জলজ উদ্ভিদের অর্ধেকের বেশির অবস্থান এবং বিলুপ্ত প্রজাতির প্রাণীও পাওয়া যায় এই হাওড়ে। পাঁচটি উপজেলা ও ১১টি ইউনিয়ন নিয়ে বিস্তৃত হাকালুকি। বিশাল এই হাওড়ের মৌসুমী রূপ দেখে এক সময় একটি প্রবাদবাক্য রচনা হয়েছিল- ‘বেটা বলতে মাবুদ মুনসি বাকি সব পুয়া, হাওড় বলতে হাকালুকি বাকি সব কুয়া।’ জীববৈচিত্র্য ॥ বিলগুলোতে প্রায় সারাবছর পানি থাকে। এর জলরাশির মূল প্রবাহ আসে জুরী ও পানাই নদী থেকে। এই বিলগুলো মৎস্যসম্পদের আধার। বছরে প্রায় ২৫০০ টন মাছ উৎপাদন হয়। তবে যথেচ্ছভাবে মাছ ধরার কারণে দেশী জাতের রানী, তুরাল, রাঁচি, বাতাসি, গলদাচিংড়ি, বাঘমাছ, চিতল ইত্যাদি আর এখন হাওড়ে পাওয়া যায় না। হাওড়ে শীতকালে আগমন ঘটে অতিথি জলচর পাখির। গত শীত মৌসুমে ৪৮ প্রজাতির প্রায় এক লাখ পাখি এসেছিল। নামকরণ ॥ হাকালুকি হাওড়ের নামকরণ নিয়ে নানা জনশ্রুতি রয়েছে। কথিত আছে, ত্রিপুরার মহারাজার সেনাবাহিনীর ভয়ে বড়লেখার কুকি দলপতি হাঙ্গর সিং জঙ্গলপূর্ণ ও কর্দমাক্ত এক বিস্তীর্ণ এলাকায় ‘লুকি দেয়’ অর্থাৎ লুকিয়ে থাকে। কালক্রমে ওই এলাকার নাম হয় ‘হাঙ্গর লুকি বা হাকালুকি। এও বলা হয় যে, প্রায় দুই হাজার বছর আগে প্রচ- এক ভূমিকম্পে ‘আকা’ নামে এক নৃপতি ও তার রাজত্ব মাটির নিচে তলিয়ে যায়। কালক্রমে তলিয়ে যাওয়া নিম্নভূমির নামকরণ হয় আকালুকি বা হাকালুকি। জীববৈচিত্র্য সঙ্কটাপন্ন ॥ মৌলভীবাজার জেলায় ৭৫ ভাগ এবং সিলেট জেলায় ২৫ ভাগ জায়গা নিয়ে অবস্থিত এশিয়ার সর্ববৃহৎ মিঠাপানির হাওড় হাকালুকি। দিন যতই গড়িয়ে যাচ্ছে ততই হাকালুকি হাওড়ের চেহারা পাল্টে যাচ্ছে। হাকালুকি হাওড় থেকে বিভিন্ন প্রজাতির মাছ, প্রাণী এবং উদ্ভিদ শূন্য হয়ে পড়ছে। এ অবস্থা চলতে থাকলে হাকালুকি হাওড়কে অদূর ভবিষ্যতে খুঁজে পাওয়া যাবে না। অথচ সরকারী হিসাবমতে এক হাজার ২০৩ প্রজাতির প্রাণী ও উদ্ভিদ ছিল হাকালুকি হাওড়ে। প্রতিদিন চার লাখের অধিক মানুষের খাবার যোগান হতো এখান থেকে। সম্প্রতি সেভাবে জেলেদের জালে মাছ আসছে না। একটি প্রভাবশালী সিন্ডিকেট হাকালুকি হাওড়ের সম্পদ লুটেপুটে খাচ্ছে। হাকালুকি হাওড় থেকে প্রতিদিন কোটি টাকার মাছ আহরণ করা হচ্ছে। বিভিন্ন পর্যায়ে ভাগ-বাটোয়ারার মাধ্যমে এই লুটপাট প্রক্রিয়া চলছে। রক্ষক হয়ে ভক্ষকের ভূমিকায়ও অবতীর্ণ হয়েছেন অনেকে। হাকালুকি হাওড়ের পাখি নিধন একটি নিয়মিত ঘটনা। বর্তমানে এশিয়া মহাদেশের সবচেয়ে বড় মিঠাপানির হাওড় হাকালুকি। এখানে বিরল প্রজাতির জলজ প্রাণী ও উদ্ভিদ রয়েছে। পরিবেশ অধিদফতরের তথ্যমতে, বাংলাদেশের জলজ প্রজাতির উদ্ভিদের অর্ধেকেরও বেশি এই হাকালুকি হাওড়ে জন্মে। অন্তত ৫২৬ প্রজাতির উদ্ভিদ রয়েছে এই হাওড়ে। এরমধ্যে হিজল, করচ, বরুন, আড়ং ও মাখন উল্লেখযোগ্য। এই হাওড়ে ১১২ প্রজাতির পরিযায়ী ও ৩০৫ প্রজাতির স্থানীয় পাখি রয়েছে। এদের মধ্যে বিরল প্রজাতির স্থানীয় পাখিও রয়েছে। উল্লেখযোগ্য হলোÑ মদনটাক, প্যালাসেস ফিস, ঈগল ইত্যাদি। এই হাওড়ে রয়েছে ১২ প্রজাতির উভচর, ৭০ প্রজাতির সরীসৃপ, ৫৯ প্রজাতির স্তন্যপায়ী প্রাণী, যার বিরাট একটি অংশ আজ বিলুপ্ত হয়ে যাচ্ছে। বিলুপ্তপ্রায় এই প্রাণীগুলোর মধ্যে রয়েছেÑ উদবিড়াল, মেছোবাঘ, বাগডাসাসহ আরও কয়েকটি। এখানকার নদীগুলোতে এখনও মাঝেমধ্যে শুশুক দেখা যায়। পরিবেশ অধিদফতরের হিসাবে ১২ প্রজাতির কচ্ছপের মধ্যে ১১ প্রজাতির কচ্ছপ বিলুপ্ত হয়ে গেছে। ধুম কাছিমের অস্তিত্ব খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না। জীববৈচিত্র্যের অপূর্ব সম্ভার এ হাওড় বিভিন্ন কারণে তার ইকোলজিক্যাল ব্যালান্স হারাচ্ছে। কৃষিজমিতে আগাছানাশক, ছত্রাকনাশক, পতঙ্গ নিবারকের অবাধ ব্যবহার, বিশেষ করে উভচর পাখি, সরীসৃপ প্রভৃতি নিধনে হাওড় প্রাকৃতিক সৌন্দর্য ও বৈচিত্র্যের গুণাবলী হারাচ্ছে। কিভাবে যাবেন ॥ ঢাকা থেকে ট্রেন অথবা বাসে করে যাওয়ার সুবিধা রয়েছে। ভোর থেকে রাত পর্যন্ত বাস যাতায়াত করে। বাসে যেতে সময় লাগবে চার থেকে পাঁচ ঘণ্টা। ট্রেনে কুলাউড়া অথবা ফেঞ্চুগঞ্জের মাইজগাঁও স্টেশনে নেমে সেখান থেকে অটোরিক্সায় সরাসরি হাওড়ে যাওয়া যায়। বাসে হবিগঞ্জ, শ্রীমঙ্গল ও মৌলভীবাজার হয়ে বড়লেখা পৌঁছার পর শহর থেকে ১১ কিলোমিটার দূরে হাকালুকি হাওড় এলাকা, যেখানে রয়েছে পর্যটন কেন্দ্র। রয়েছে ওয়াচ টাওয়ার ও অন্যান্য সুযোগ-সুবিধা। এই স্থান থেকে নৌকা ভাড়া নিয়ে ঘুরে বেড়াতে পারেন পুরো হাওড়।
×