ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৯ মার্চ ২০২৪, ১৫ চৈত্র ১৪৩০

জঙ্গীর পরিবারেও ঘৃণা, বিদ্বেষ ধিক্কার!

কেউ আসছে না লাশ নিতে, বেওয়ারিশ হিসেবে দাফন

প্রকাশিত: ০৫:৪০, ৩০ ডিসেম্বর ২০১৫

কেউ আসছে না লাশ নিতে, বেওয়ারিশ হিসেবে দাফন

শংকর কুমার দে ॥ বেওয়ারিশ লাশ হিসেবে দাফন করা হচ্ছে জঙ্গীর লাশ। বেওয়ারিশ লাশ হওয়া জঙ্গীদের নিয়ে দেখা দিয়েছে নানা প্রশ্ন। পরিচয় না পাওয়া এই জঙ্গীরা কি পার্শ্ববর্তী দেশ ভারতের পশ্চিমবঙ্গ থেকে পালিয়ে এসেছে? নাকি নিহতের পরিবারগুলো জঙ্গী খাতায় নাম লেখানোর কারণে ঘৃণা, বিদ্বেষ, নিন্দা, ধিক্কার, লজ্জা, ভয়ে লাশ গ্রহণ করছে না? জঙ্গী হওয়ার কারণে পরিবার-সমাজের কাছ থেকে হারিয়ে যাচ্ছে তাদের প্রকৃত পরিচয়। জঙ্গী হয়ে নিহত হওয়ায় প্রিয় সন্তানের মুখ পর্যন্ত দেখতে আসছেন না পরিবারের কেউ। গাজীপুর, রাজশাহী, চট্টগ্রামে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর হাতে নয়ত আত্মঘাতী হামলায় নিহত অন্তত ৬ জঙ্গীর মৃতদেহ বেওয়ারিশ লাশ হিসেবে পড়ে রয়েছে মর্গে। তারপরও যদি কেউ লাশ না গ্রহণ করে তবে লাশ দাফন হবে বেওয়ারিশ হিসেবে। পুলিশের উর্ধতন কর্মকর্তাদের সঙ্গে আলাপ হলে তারা বলেন, এই তো জঙ্গী হওয়ার ভাগ্য, জঙ্গী জীবন! পুলিশ সদর দফতর সূত্রে এ খবর জানা গেছে। পুলিশ সূত্র জানায়, গাজীপুর ভোগড়া এলাকায় চট্টগ্রাম বাইপাস সড়কের পাশে জুগিতলার একটি পরিত্যক্ত বাড়িতে তৈরি জঙ্গী আস্তানায় অভিযান চালানোর সময়ে পুলিশের গুলিতে দুই জঙ্গী নিহত হন রবিবার রাতে। মঙ্গলবার রাতে এই রিপোর্ট লেখা পর্যন্ত তিন দিন ধরে দুই জঙ্গীর লাশ পড়ে আছে হাসপাতাল মর্গে। এদের পরিচয় পায়নি পুলিশ, লাশ গ্রহণ করতে আসেনি পরিবারের কেউই। অগত্যা যদি কেউ লাশ নিতে না আসে তাহলে আঞ্জুমান মুফিদুল ইসলাম বা পুলিশের পক্ষ থেকে বেওয়ারিশ লাশ হিসেবে দাফন করা হবে বলে জানিয়েছে পুলিশ কর্তৃপক্ষ। পুলিশের একটি সূত্র জানায়, রবিবার কাশিমপুর কেন্দ্রীয় কারাগারের ফটক থেকে মিনহাজুল ও মাহবুব নামে দুই জঙ্গী মুক্তি পায়। এরপর কারাফটক থেকেই তাদের র‌্যাব পরিচয়ে ধরে নিয়ে যায় আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্যরা। তবে পুলিশ বা র‌্যাব কর্তৃপক্ষ থেকে দুই জঙ্গী বা কাউকে কাশিমপুর কারাগার ফটক থেকে ধরে নিয়ে যাওয়ার খবর নিশ্চিত করেননি। গাজীপুরে দুই জঙ্গীর মতো একই অবস্থা রাজশাহীর বাগমারায় আহমদিয়া সম্প্রদায়ের মসজিদে আত্মঘাতী বোমা হামলায় নিহত জঙ্গীর। পরিচয় না পাওয়ায় তার লাশ দাফন হয়েছে বেওয়ারিশ হিসেবে। বেওয়ারিশ হিসেবে দাফন করার আগে সুরতহাল রিপোর্ট, ময়নাতদন্ত, আলামত সংগ্রহ করা হয়। লাশ হস্তান্তরের জন্য অপেক্ষার পালা শেষ হয়। পরিবারের পক্ষ থেকে কেউ পরিচয় দিয়ে গ্রহণ করেননি নিহত জঙ্গীর লাশ। তারপর লাশ দাফন করা হয় বেওয়ারিশ হিসেবে। গত শুক্রবার জুমার নামাজের সময় বাগমারা উপজেলার মচমইল সৈয়দপুর এলাকার চকপাড়ায় আহমদিয়া সম্প্রদায়ের মসজিদে আত্মঘাতী বোমা হামলা চালায় অজ্ঞাত এই যুবক। ঘটনাস্থলেই বোমা বিস্ফোরণে ওই যুবক নিহত হন। ময়নাতদন্তের পর জঙ্গীর লাশ রাজশাহী মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালের হিমঘরে রাখা ছিল। রবিবার দুপুরের দিকে লাশ দাফনের জন্য কোয়ান্টাম ফাউন্ডেশনের কাছে হস্তান্তর করা হয়। কোয়ান্টাম ফাউন্ডেশনই রবিবার দুপুরে বেওয়ারিশ হিসেবে লাশটি দাফন করে। পুলিশ সূত্র জানায়, গত ৫ অক্টোবর চট্টগ্রাম নগরীর কর্ণফুলী থানার খোয়াজনগর থেকে গ্রেনেড-বিস্ফোরক-অস্ত্র-গুলিসহ গ্রেফতার হওয়ার পর আত্মঘাতী হামলায় নিহত হন জেএমবির চট্টগ্রাম অঞ্চলের সামরিক শাখার প্রধান মোহাম্মদ জাভেদ। টেক্সটাইল প্রকৌশল নিয়ে পড়ালেখা করা জাবেদের লাশ হাসপাতাল মর্গে পড়েছিল দুই দিন। কিন্তু পরিবারের কেউ তার লাশ গ্রহণ করতে আসেনি। তারপর বেওয়ারিশ হিসেবে লাশ দাফন করা হয়। গ্রেনেড বিস্ফোরণে নিহত জাবেদের বাড়ি চট্টগ্রামের মীরসরাই উপজেলায়। গ্রাম বা পরিবারের কেউই তার লাশ গ্রহণ করেননি। এর আগে গত ২৩ সেপ্টেম্বর সদরঘাটের বাংলাবাজারে ছিনতাইয়ের সময় নিজেদের ছোড়া গ্রেনেড বিস্ফোরণে নিহত দুই জেএমবি সদস্যকেও বেওয়ারিশ হিসেবে দাফন করেছিল আঞ্জুমান মুফিদুল ইসলাম। সেদিন সদরঘাটের বাংলাবাজারের জনতা ব্যাংকের সামনে গুলি করে ছিনতাইকালে জনতার প্রতিরোধে গ্রেনেড বিস্ফোরণ করে পালিয়ে যাওয়ার সময় নিহত হয় দুই জেএমবি সদস্য। দুই দিন লাশ মর্গে পড়ে থাকার পর গত ২৫ সেপ্টেম্বর তাদেরও বেওয়ারিশ হিসেবে আঞ্জুমান মুফিদুল ইসলাম দাফন করে। ওই সময় তাদের নাম পরিচয় জানা গেলেও কেউ নিতে আসেনি লাশ। চট্টগ্রাম মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালের মর্গ থেকে আঞ্জুমান মুফিদুল ইসলামকে মরদেহ হস্তান্তর করা হয়। পুলিশের অনুরোধে আঞ্জুমান মুফিদুল ইসলামের মাধ্যমে নিহত জঙ্গীর দাফন হয় বেওয়ারিশ হিসেবে। পুলিশের এক কর্মকর্তা বলেন, জঙ্গীদের বেওয়ারিশ লাশের মিছিল বেড়ে চলেছে। কারণ তারা হয়ত বা পার্শ¦বর্তী দেশগুলো থেকে এখানে এসেছে, নয়ত বা নিহত জঙ্গীর পরিবার, সমাজ পরিচয় আড়াল করছে লজ্জা, ঘৃণা, ভয়ে। এই তো জঙ্গী জীবন!
×