ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৯ মার্চ ২০২৪, ১৫ চৈত্র ১৪৩০

ফিরে দেখা ২০১৫

ব্যাংকিং খাতে উন্নয়নের বছর

প্রকাশিত: ০৩:৫৫, ৩১ ডিসেম্বর ২০১৫

ব্যাংকিং খাতে উন্নয়নের বছর

রহিম শেখ ॥ বছরের শুরুতে তিন মাসব্যাপী হরতাল-অবরোধের ধাক্কায় ব্যাংকিং খাতে ছিল অচলাবস্থা। তবে এই তিন মাসের রাজনৈতিক অস্থিরতা বাদ দিলে ২০১৫ সাল ছিল ব্যাংকিং খাতের জন্য উন্নয়নের বছর। উন্নয়নমুখী ও অন্তর্ভুক্তিমূলক কর্মকা-ের অংশ হিসেবে ব্যাংকিং সেবার সঙ্গে সরাসরি যুক্ত হয়েছে ১১১টি সাবেক ছিটের বাসিন্দারা। মোবাইল ব্যাংকিং, এজেন্ট ব্যাংকিং, স্কুল ব্যাংকিং ও বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ ছিল বছরের ইতিবাচক সংবাদ। বাংলাদেশ ব্যাংক বলছে, বর্তমানে প্রায় নব্বই শতাংশ ব্যাংক প্রযুক্তিনির্ভর ব্যাংকিং সেবা দিচ্ছে। অনলাইন সিআইবি, অটোমেটেড ক্লিয়ারিং হাউজ ও ইলেকট্রনিক ফান্ড ট্রান্সফার ব্যবস্থা চালুর পর ব্যাংকিং লেনদেনে গতি বাড়াতে ‘রিয়েল টাইম গ্রস সেটেলমেন্ট (আরটিজিএস)’ সিস্টেম এ বছরই চালু করা হয়েছে। উন্নতির পাশাপাশি নিরাপত্তা নিয়ে শঙ্কা বেড়েছে সভারে কমার্স ব্যাংকে দুর্ধর্ষ ডাকাতির ঘটনায়। বছরের শেষ ভাগে আলোচিত ছিল মূলধন ঘাটতির মুখে রাষ্ট্রায়ত্ত চার ব্যাংক ও বিশেষায়িত একটি ব্যাংকে পর্যবেক্ষক নিয়োগ দেয়ার ঘটনা। এদিকে ব্যাংক ঋণের সুদের হার কমলেও অলস টাকা ও বড় খেলাপিদের জন্য ঋণ পুনর্গঠন বিষয়টি নিয়ে বছরব্যাপী আলোচনায় ছিল ব্যাংকিং খাত। এছাড়া বেসিক ব্যাংক কেলেঙ্কারির ঘটনায় সাবেক চেয়ারম্যান শেখ আব্দুল হাই বাচ্চুকে ছাড়পত্র দেয়ার ঘটনায় ব্যাংকিং খাতের সঙ্গে আলোচনায় ছিল দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক)। ২০১৫ সালকে ব্যাংকিং খাতের উন্নতি ও ঘটনাবহুল বছর হিসেবে আখ্যায়িত করেছেন অর্থনীতিবিদরা। তারা বলেছেন, বছরটিতে খেলাপি ঋণ আদায় সেভাবে বাড়েনি। যার প্রভাবে ব্যাংকিং খাতে মুনাফা কমে আসবে বলে মনে করছেন সংশ্লিষ্টরা। অর্থনীতিবিদদের মতে, গত এক বছরে বেশকিছু কাজ হয়েছে; তবে কাক্সিক্ষত বিনিয়োগের জন্য আরও জোর দেয়া উচিত ছিল। বাংলাদেশ ব্যাংকের বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ বেড়েছে। এটা আর্থিক খাতের ভিত মজবুত করলেও এ অর্থ বিনিয়োগে আনা দরকার। ব্যাংকের নিরাপত্তা নিয়ে শঙ্কা ॥ বাংলাদেশ ব্যাংকের নির্দেশনা সত্ত্বেও ব্যাংকের শাখায় কাঠামোগত ও প্রযুক্তিগত নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে পারছে না সরকারী-বেসরকারী অধিকাংশ ব্যাংক। ফলে ব্যাংকের সুরঙ্গ কেটে ভল্ট ভেঙ্গে এবং শাখার অভ্যন্তরে টাকা লুটের ঘটনা ঘটছে। চলতি বছরের ১৪ এপ্রিল দুপুরে বেসরকারী খাতের কমার্স ব্যাংকের আশুলিয়ার কাঠগড়া শাখায় ৩/৪টি মোটরসাইকেলযোগে ১০/১২ জনের সশস্ত্র ডাকাত দল গ্রাহকবেশে ব্যাংকে প্রবেশ করেই ম্যানেজারকে অস্ত্রের মুখে জিম্মি করে গুলি ও বোমা বর্ষণ শুরু করে। এতে ব্যাংকের শাখা ব্যবস্থাপক, নিরাপত্তা রক্ষী, দোকানি, এলাকাবাসী, গণপিটুনিতে এক ডাকাতসহ ৮ জন নিহত এবং অন্তত ১০ জন গুলিবিদ্ধসহ প্রায় ২০ জন আহত হন। ধারণা করা হচ্ছে ব্যাংকের অভ্যন্তরে সিসিটিভি সচল থাকলেও ব্যাংকের চারপাশে বিভিন্ন ধরনের ক্যামেরা ছিল না। যদিও এমন নির্দেশনা ছিল বাংলাদেশ ব্যাংকের। ৫ ব্যাংকে পর্যবেক্ষক ॥ এদিকে হঠাৎ চলতি বছরের নবেম্বরে সরকারী ৫ ব্যাংকে পর্যবেক্ষক বসিয়েছে বাংলাদেশ ব্যাংক। সোনালী, জনতা, অগ্রণী, রূপালী ও বাংলাদেশ কৃষি ব্যাংকে পর্যবেক্ষক বসানো হয়। ব্যাংক কোম্পানি আইনের ৪৯ ধারা অনুযায়ী, এর আগে সরকারী খাতের বেসিক ব্যাংকেও পর্যবেক্ষক বসানো হয়। এছাড়া ওরিয়েন্টাল ব্যাংক থেকে পরিবর্তিত আইসিবি ইসলামী ব্যাংক, বাংলাদেশ কমার্স ব্যাংক, ন্যাশনাল ব্যাংক, ইসলামী ব্যাংক ও মার্কেন্টাইল ব্যাংকে বসানো হয়েছে পর্যবেক্ষক। সব মিলিয়ে ৫৬টি ব্যাংকের মধ্যে ১১টি ব্যাংকেই পর্যবেক্ষক রয়েছে। কেলেঙ্কারির ঘটনায় দুটি আর্থিক প্রতিষ্ঠানেও পর্যবেক্ষক বসিয়েছে বাংলাদেশ ব্যাংক। আলোচনায় ছিল বেসিক ব্যাংক ॥ বেসিক ব্যাংক কেলেঙ্কারির সময়সীমা ২০১০-২০১৪ সাল পর্যন্ত হলেও ঘটনাটি সব চেয়ে আলোচিত হয় ২০১৫ সালে। এ সময় একের পর এক তদন্ত, মূল হোতাদের বাদ দেয়া, ব্যাংকের সাবেক চেয়ারম্যান শেখ আবদুল হাই বাচ্চুকে দুদকের দায়মুক্তি, ডিএমডিসহ প্রায় ৩০ কর্মকর্তা-কর্মচারীকে বহিষ্কার করা হয়। ২০১০-১৪ সাল পর্যন্ত ঋণ বিতরণের ক্ষেত্রে যত ধরনের অনিয়ম করা যায়, তার প্রায় সবই হয়েছে রাষ্ট্রায়ত্ত বেসিক ব্যাংকে। বাংলাদেশ ব্যাংকের অনুসন্ধ্যানে সাড়ে তিন হাজার কোটি টাকা হাতিয়ে নেয়ার তথ্য বের হলেও প্রকৃত বিচারে পরিমাণ আরও বাড়তে পারে। দুদক ও কেন্দ্রীয় ব্যাংকের একাধিক সূত্র জানিয়েছে, বেসিক ব্যাংক কেলেঙ্কারিতে হাতিয়ে নেয়া অর্থের পরিমাণ চার হাজার কোটি টাকা ছাড়াতে পারে। বাংলাদেশ ব্যাংকের এক পরিদর্শন প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, প্রায় ১৩ ৫৪ কোটি টাকা একাই আত্মসাৎ করেছেন বেসিক ব্যাংকের সাবেক চেয়ারম্যান শেখ আব্দুল হাই বাচ্চু। তারপরও এত বড় কেলেঙ্কারির ঘটনায় সাবেক চেয়ারম্যানকে দায়মুক্তি দিয়ে ব্যাংকিং খাতের সঙ্গে আলোচনায় ছিল দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক)। ব্যাংকার ও বিশ্লেষক মামুন রশীদ বলেন, ব্যাংকিং খাত কয়েকটি গোষ্ঠীর কাছে জিম্মি হয়ে আছে। এর থেকে বের হতে হবে। সুদের হার কমানোর সুযোগ থাকলেও চলতি বছরে তা সেভাবে কমাতে পারেনি। একযোগে রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংকে পর্যবেক্ষক নিয়োগ প্রসঙ্গে তিনি বলেন, সরকারী ব্যাংকগুলো ভাল চলছে না। তবে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের নিয়ন্ত্রণে নেয়ার সুযোগ সৃষ্টি হয়েছে। বর্তমানে নিয়ন্ত্রক প্রতিষ্ঠান হিসেবে বাংলাদেশ ব্যাংকের ভূমিকা সন্তোষজনক। তবে আরও ভাল করতে হবে। সব মিলিয়ে ব্যাংকিং খাতে আগের তুলনায় সচেতনতা বেড়েছে বলে মনে করেন তিনি। ব্যাংকিং সেবার সঙ্গে যুক্ত সাবেক ছিটের নাগরিকরা ॥ বাংলাদেশ ব্যাংকের উদ্যোগে মূলধারার অর্থনীতির সঙ্গে সম্পৃক্ত করা হয়েছে প্রায় ১৭ হাজার ১৬০ একর আয়তনের ১১১টি ছিটমহলের ৩৭ হাজার নাগরিককে। সাবেক এ ছিটমহলে অন্তর্ভুক্তিমূলক আর্থিক সেবার আওতায় বাড়ানো হয়েছে ব্যাংকিং সেবার পরিধি। ছিটমহলে বসবাসকারী মানুষের সার্বিক অর্থনৈতিক উন্নয়ন, অধিকার সুনিশ্চিত করা এবং এসব অঞ্চলে কৃষি কার্যক্রম সম্প্রসারণের লক্ষ্যে কৃষি ঋণ বিতরণের সিদ্ধান্ত নেয়া হয়েছে। এছাড়া বাংলাদেশের মানচিত্রে সদ্য অন্তর্ভুক্ত ছিটমহলগুলোর কুটির, অতি ক্ষুদ্র, ক্ষুদ্র ও মাঝারি উদ্যোক্তাদের গ্রুপভিত্তিক এসএমই ঋণ দিতে ব্যাংকগুলোকে নির্দেশ দিয়েছে বাংলাদেশ ব্যাংক। ছিটবাসীর জীবনযাত্রার মানোন্নয়নে ১০ টাকায় ব্যাংক হিসাব খোলার নির্দেশও দিয়েছে বাংলাদেশ ব্যাংক। একই সঙ্গে সমাজের অবহেলিত জনগোষ্ঠী পতিতা ও হিজরাদের ব্যাংকিং সেবায় আনার উদ্যোগ নিয়েছে বাংলাদেশ ব্যাংক। গলার কাঁটা খেলাপি ঋণ ॥ সহজ শর্তে পুনঃতফসিলসহ নানান সুবিধা দেয়ার পরও ব্যাংক খাতের খেলাপি ঋণ কমানো যায়নি। তিন মাসের ব্যবধানে তা বেড়েছে দুই হাজার ১৯২ কোটি টাকা। ব্যাংক খাতে খেলাপি ঋণ সংক্রান্ত কেন্দ্রীয় ব্যাংকের হালনাগাদ প্রতিবেদনের তথ্য অনুযায়ী, গত জুন প্রান্তিক শেষে ব্যাংকিং খাতে খেলাপি ঋণের পরিমাণ ছিল ৫২ হাজার ৫১৬ কোটি টাকা, যা বিতরণ করা ঋণের ৯ দশমিক ৬৭ শতাংশ। অন্যদিকে সেপ্টেম্বর শেষে তা বেড়ে দাঁড়িয়েছে ৫৪ হাজার ৭০৮ কোটি টাকায় দাঁড়িয়েছে, যা বিতরণ করা ঋণের ৯ দশমিক ৮৯ শতাংশ। অর্থাৎ তিন মাসের ব্যবধানে খেলাপি ঋণের পরিমাণ দুই হাজার ১৯২ কোটি টাকা বা দশমিক ২২ শতাংশ বেড়েছে। সূত্র জানায়, রাজনৈতিক অস্থিরতা ও আন্তর্জাতিক অর্থনৈতিক মন্দার কারণে দেশের ব্যবসায়ীরা ক্ষতিগ্রস্ত হওয়ার কারণে বিশেষ নীতিমালার আওতায় ৫০০ কোটি টাকা ও এর বেশি অঙ্কের খেলাপিদের ঋণ পুনর্গঠনে ছাড় দেয়া হয়। এ সুবিধা পেতে ১৫টি শিল্প গ্রুপ বাংলাদেশ ব্যাংকের কাছে আবেদন করে। এর মধ্যে ১১টি গ্রুপের ১৫ হাজার ২১৮ কোটি টাকার ঋণ পুনর্গঠনের আবেদন বিবেচনায় নেয়া হয়। এর মধ্যে ১০টি প্রতিষ্ঠানের প্রায় ১৪ হাজার কোটি টাকার ঋণ পুনর্গঠনের সুযোগ দেয়া হয়। ব্যাংকে অলস টাকা ও ঋণ-আমানতের সুদহার ॥ ব্যাংকে টাকা থাকবে এটাই স্বাভাবিক। কিন্তু অলস টাকা থাকলেই সমস্যা বলছেন দেশের অর্থনীতিবিদরা। বাংলাদেশ ব্যাংকের এক প্রতিবেদনে বলা হয়, অলস টাকার পরিমাণ ৪ হাজার ২৯৪ কোটি টাকা। অনেকেই বলছেন, এই টাকার বিপরীতে আমানতকারীদের নির্দিষ্ট হারে সুদ গুনতে হলেও ব্যাংকের কোন আয় আসছে না। আমানত ও ঋণের সুদহার কমিয়ে আনার লক্ষ্যে বাংলাদেশ ব্যাংকের নিবিড় নজরদারি এবং ব্যাংকগুলোর ওপর নৈতিক চাপ অব্যাহত রাখায় আমানত ও ঋণের গড় সুদহার কমে অক্টোবর ২০১৫ শেষে দাঁড়িয়েছে যথাক্রমে ৬.৫৮ ও ১১.৩৫ শতাংশ। আমানত ও ঋণের সুদহারের স্প্রেড দাঁড়িয়েছে ৪.৭৭ শতাংশ। এই স্প্রেড মূল্যস্ফীতি নিম্নগামী হওয়ার সাথে সঙ্গতিপূর্ণভাবে ও ক্রমান্বয়ে কমছে। রিজার্ভ ॥ কেন্দ্রীয় ব্যাংকের বৈদেশিক মুদ্রার মজুদে নতুন রেকর্ড সৃষ্টি হচ্ছে বছরের শুরু থেকে। সর্বশেষ বাংলাদেশের ইতিহাসে বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ প্রথমবারের মতো ২৭ বিলিয়ন (২ হাজার ৭০০ কোটি মার্কিন ডলার) অতিক্রম করেছে। বাংলাদেশ ব্যাংকের বর্তমান রিজার্ভ সার্কভুক্ত দেশগুলোর মধ্যে দ্বিতীয় সর্বোচ্চ। রিজার্ভের দিক দিয়ে প্রতিবেশী দেশগুলোর মধ্যে ভারতের পরই বাংলাদেশের অবস্থান, যা পাকিস্তানের তুলনায় প্রায় দ্বিগুণ। রফতানি আয় বৃদ্ধি ও রেমিটেন্স প্রবাহের ইতিবাচক ধারা, বিদেশ থেকে কর্পোরেট ঋণ গ্রহণ এবং কাক্সিক্ষত হারে আমদানি ব্যয় না হওয়া রিজার্ভ বৃদ্ধিতে অবদান রেখেছে বলে বাংলাদেশ ব্যাংকের সংশ্লিষ্ট বিভাগ সূত্রে জানা গেছে।
×