ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ১৯ এপ্রিল ২০২৪, ৬ বৈশাখ ১৪৩১

ইসিতে দফায় দফায় দিনভর নানা অনিয়মের অভিযোগ

প্রকাশিত: ০৫:৩৬, ৩১ ডিসেম্বর ২০১৫

ইসিতে দফায় দফায় দিনভর নানা অনিয়মের অভিযোগ

স্টাফ রিপোর্টার ॥ পৌর নির্বাচনে কেন্দ্র দখল, অনিয়ম, আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর পক্ষপাতিত্বসহ নানা অভিযোগ ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ, বিরোধী দল জাতীয় পার্টিসহ বিএনপির। বুধবার দিনভর বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের পক্ষ থেকে নির্বাচন কমিশন কার্যালয়ে দফায় দফায় অভিযোগ দেয়া হয়। প্রতিকার চেয়ে ইসি কর্মকর্তাদের সঙ্গে বৈঠক করেন বিভিন্ন দলের নেতারা। তবে অভিযোগ যতই থাক প্রথমবারের মতো দলীয় প্রতীকে অনুষ্ঠিত পৌর নির্বাচনে সন্তুষ্টি কমিশনের। এদিকে অনিয়মের সঙ্গে যুক্ত থাকায় পাঁচ এসআইকে সাময়িক বরখাস্ত করতে পুলিশের আইজি বরাবর চিঠি দেয়া হয়েছে কমিশনের পক্ষ থেকে। ভোটের পরেও নির্বাচন কমিশনে গিয়ে পাল্টাপাল্টি অভিযোগ করা হয় আওয়ামী লীগ ও বিএনপির পক্ষ থেকে। ইসি সন্তুষ্ট ॥ দলীয় মার্কায় প্রথমবারের মতো আয়োজিত পৌর নির্বাচনে কিছু এলাকায় বিক্ষিপ্ত সংঘর্ষ, কেন্দ্র দখলের চেষ্টা ও অনিয়মের অভিযোগ এলেও আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি নিয়ে সন্তুষ্ট নির্বাচন কমিশন। নির্বাচন কমিশনার মোঃ আবু হাফিজ বলেছেন, ভোটার উপস্থিতি নিয়েও তারা সন্তুষ্ট। তবে দুপুর পর্যন্ত প্রায় ২০টি পৌরসভায় গোলযোগের খবর পাওয়া গেছে। সাতকানিয়া পৌরসভায় ভোটকেন্দ্রের দেড় কিলোমিটার দূরে দুই কাউন্সিলর প্রার্থীর সমর্থকদের সংঘর্ষে নিহত হয়েছেন একজন। এর বাইরে অধিকাংশ এলাকায় ‘শান্তিপূর্ণ’ ভোট হয়েছে মন্তব্য করে মোঃ আবু হাফিজ বলেন, প্রধান দুই দলের পাল্টাপাল্টি অভিযোগের চেয়ে আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি স্বাভাবিক রাখাটাকেই তারা ‘বড়’ হিসেবে দেখছেন। তিনি বলেন, আমরা কোন অভিযোগ পাওয়ার পর সঙ্গে সঙ্গে ব্যবস্থা নিচ্ছি। প্রথম চার ঘণ্টায় কত শতাংশ ভোট পড়েছে জানতে চাইলে এ নির্বাচন কমিশনার বলেন, এবার দলীয় ভোট হচ্ছে, ভোটার উপস্থিতি একটু বেশিই থাকবে। সাধারণ ও সংরক্ষিত কাউন্সিলর পদেও প্রার্থীরা আছেন। ভোটের হার ভালই হবে। নারী ভোটারের উপস্থিতিও বেশ। আবু হাফিজ বলেন, দুপুর পর্যন্ত আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতিতে আমরা সন্তুষ্ট। দুটি দলও আমাদের কাছে এসেছে, তাদের কথাও শুনেছি; অভিযোগের বিষয়ে তাৎক্ষণিক ব্যবস্থা নিচ্ছি। তারাও ভালভাবে দেখছে। তবে ভালভাবে শেষ করতে পারলেই সন্তুষ্টিটা কাজে আসবে। ইসি কর্মকর্তারা জানান, ২০০৮ সালের ৯ পৌরসভা নির্বাচনে সর্বোচ্চ ৯৩ শতাংশ ভোট পড়েছিল। ২০১১ সালে চার ধাপের পৌর ভোটে বাক্সে পড়েছিল ৬০ থেকে ৬৫ শতাংশ ভোট। দেশের ৩২৩ পৌরসভার মধ্যে ২৩৪টিতে এবারই প্রথম দলীয়ভাবে মেয়র পদের ভোট হচ্ছে। আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারীর বিরুদ্ধে আওয়ামী লীগের অভিযোগ ॥ আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর বিরুদ্ধে পক্ষপাতিত্বের অভিযোগ নিয়ে নির্বাচন কমিশনে আসে আওয়ামী লীগের একটি প্রতিনিধি দল। এ সময় প্রধানমন্ত্রীর রাজনৈতিক উপদেষ্টা এইচটি ইমাম ব্যথিত হয়েছেন বলে সাংবাদিকদের জানিয়েছেন। বুধবার সকালে আগারগাঁওয়ে নির্বাচন কমিশনে তিনি এ কথা বলেন। সকালে এইচটি ইমামের নেতৃত্বে আওয়ামী লীগের একটি প্রতিনিধিদল কমিশনে যায়। অন্য কমিশনারদের সঙ্গে দেখা হলেও প্রধান নির্বাচন কমিশনার (সিইসি) কাজী রকিবউদ্দীন আহমদের সঙ্গে দেখা করতে পারেনি এ প্রতিনিধিদল। এইচটি ইমাম সাংবাদিকদের জানান, সিইসি তাঁর কাছে ক্ষমা চেয়ে জানিয়েছেন তিনি আজ কারও সঙ্গে দেখা করতে পারবেন না। এতে এইচটি ইমাম ব্যথিত হয়েছেন। এ ছাড়া আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী সবার সঙ্গে সমান ব্যবহার করছে না বলেও তিনি অভিযোগ করেন। তিনি বলেন, চৌমুহনীতে জামায়াত-বিএনপির প্রভাবে সেখানে গোলযোগ হচ্ছে। বরগুনার পাথরঘাটায় আওয়ামী লীগের এক প্রার্থীকে বের করে দেয়া হয়েছে। কুড়িগ্রাম, মিঠাপুকুরে বছরের শুরুতে যারা অগ্নি-সন্ত্রাস করেছিল, তারাই নাশকতা চালাচ্ছে। সাংবাদিকদের প্রশ্নের উত্তরে এইচটি ইমাম বলেন, এবারের নির্বাচন অত্যন্ত সুষ্ঠু হচ্ছে। কেন্দ্রীয় হাইকমান্ড থেকেও স্পষ্ট বলে দেয়া হয়েছে নির্বাচন সুষ্ঠু হতে হবে। বিএনপির বিভিন্ন অভিযোগকে ‘মনগড়া’ অভিযোগ বলে উল্লেখ করেন তিনি। এরপর আওয়ামী লীগের প্রতিনিধি দল কমিশনার মোঃ শাহনেওয়াজের কক্ষে বৈঠক করেন। ৬০ কেন্দ্র দখলের অভিযোগ বিএনপির ॥ বিএনপি চেয়ারপার্সনের উপদেষ্টা ওসমান ফারুকের নেতৃত্বে একটি প্রতিনিধিদল ইসিতে গিয়ে দেড় ঘণ্টায় অন্তত ৬০টি কেন্দ্র দখলের অভিযোগ জানিয়ে আসেন। অন্যদিক দুপুরে ধানম-িতে আওয়ামী লীগ সভানেত্রীর রাজনৈতিক কার্যালয়ে সংবাদ সম্মেলন করে ক্ষমতাসীন দলটির যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক মাহবুব-উল-আলম হানিফ বলেন, পরাজয়ের আশঙ্কায়’ বিএনপির প্রার্থীরাই বিভিন্ন স্থানে ব্যালট পেপার ছিনিয়ে নিচ্ছে। পৌরসভা নির্বাচনে সরকার ও নির্বাচন কমিশনের ভূমিকায় হতাশা প্রকাশ করেছে বিএনপি। বুধবার বিকেলে নির্বাচন কমিশন সচিবালয়ে সাংবাদিকদের কাছে এই হতাশা প্রকাশ করেন বিএনপি চেয়ারপার্সনের উপদেষ্টা এ্যাডভোকেট খন্দকার মাহবুব হোসেন। গণমাধ্যমকর্মীদের তিনি বলেন, ‘নির্বাচনের আগে সরকার এবং নির্বাচন কমিশন অবাধ, সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ নির্বাচনের বিষয়ে আমাদের আশ্বস্ত করেছিল। কিন্তু আজ বাস্তবে তার কোন প্রতিফলন হয়নি। সামগ্রিকভাবে আমরা এই নির্বাচন নিয়ে হতাশ। খন্দকার মাহবুব বলেন, নানা প্রতিকূলতা সত্ত্বেও আমরা নির্বাচন বর্জন করিনি। সরকারদলীয় ক্যাডাররা কেন্দ্র দখল করে নিয়েছে। আমাদের এজেন্টদের বের করে দিয়েছে। জোর করে ব্যালটে সিল মেরেছে। অভিযোগ দিয়েও প্রতিকার পাওয়া যায়নি। তিনি এ সময় যেসব পৌরসভায় অনিয়ম হয়েছে সেখানে পুনরায় নির্বাচনের দাবি জানান। তিনি বলেন, বিএনপি গণতান্ত্রিক দল। আওয়ামী লীগের অতীতের ইতিহাস ভুলে গণতন্ত্র রক্ষায় আমরা নির্বাচনে অংশ নিয়েছিলাম। কিন্তু অতীতের নির্বাচনের চেয়ে এ নির্বাচনে সরকার ও তাদের সমর্থকরা বেশি তা-বলীলা চালিয়েছে। ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ এ পর্যন্ত শতাধিক কেন্দ্রে ভোট কারচুপি করেছে। ভোটের নামে প্রহসন ও তা-বে বিএনপি হতাশ। নির্বাচন কমিশনকে অসহায় উল্লেখ করে বিএনপি চেয়ারপার্সনের এই উপদেষ্টা বলেন, ইচ্ছা থাকলেও মাঠপর্যায়ের স্থানীয় প্রশাসনের নিকট নির্বাচন কমিশনে অসহায়ত্ব ফুটে উঠেছে। এ সময় বিএনপির চেয়ারপার্সনের উপদেষ্টা শামসুজ্জামান দুদু তার সঙ্গে ছিলেন। এর আগে বিএনপি চেয়ারপার্সনের উপদেষ্টা ওসমান ফারুক বলেন, নির্বাচনে সহিংসতা বেড়েছে। নির্বাচন কমিশনকে বিভিন্ন কেন্দ্র ধরে ধরে যেসব অনিয়ম হচ্ছে তা জানানো হয়েছে। কমিশন ব্যবস্থা নিলে বিএনপি জিতবে। ২৫ পৌরসভায় অনিয়মের অভিযোগ জাপার ॥ বিএনপি ও আওয়ামী লীগের পর জাতীয় পার্টির (জাপা) পক্ষ থেকে ২৫টি পৌরসভার ১৭৪টি ভোট কেন্দ্রে অনিয়মের অভিযোগ করা হয়েছে। বুধবার জাপার সিনিয়র যুগ্ম মহাসচিব এ্যাডভোকেট রেজাউল ইসলাম ভূঁইয়া একটি লিখিত অভিযোগ ইসির সচিব সিরাজুল ইসলামের দফতরে জমা দেন। এরপর তিনি সাংবাদিকদের বলেন, সারাদেশে ২৩৪ নির্বাচনী পৌরসভার মধ্যে ৭৪টিতে মেয়র প্রার্থী দিয়েছে জাপা। এর মধ্যে ২৫টি পৌরসভার ১৭৪টি কেন্দ্রে তাদের প্রার্থীকে কেন্দ্র থেকে বের করে দেয়াসহ ব্যালটে সিল মারা হয়েছে। এসব কেন্দ্রে আওয়ামী লীগের প্রার্থীরা ভোটডাকাতিসহ কেন্দ্র দখল করে জাল ভোট দিয়েছেন। এ সময় তার সঙ্গে ছিলেন দলের নেতা সাইদুর রহমান টেপা ও ফখরুল ইমাম। পাঁচ এসআইকে বরখাস্তে ইসির চিঠি ॥ পৌরভোটে অনিয়মের অভিযোগে চট্টগ্রামের চন্দনাইশ ও মাদারীপুরের কালকিনির পাঁচ উপ-পরিদর্শককে (এসআই) সাময়িক বরখাস্ত করতে পুলিশপ্রধানকে (আইজিপি) চিঠি দিয়েছে ইসি। তারা হলেন- চন্দনাইশ পৌরসভায় দায়িত্ব পাওয়া নাজমুল হোসেন, আলমগীর ভূঁইয়া ও মোঃ সোলাইমান এবং কালকিনির আব্দুল কুদ্দুস শিকদার ও শরীফ আব্দুর রশীদ। বুধবার বিকেলে ইসির উপসচিব সামসুল আলম বলেন, তাদর বিষয়ে ব্যবস্থা নিতে আইজিপির কাছে চিঠি দেয়া হয়েছে। ইসির এক কর্মকর্তা বলেন, কালকিনির রিটার্নিং কর্মকর্তা মোঃ আলাউদ্দিন ভোটে অনিয়ম এবং এতে দুই পুলিশ সদস্যের সম্পৃক্ততার অভিযোগ ইসিকে জানায়। তাৎক্ষণিকভাবে কাস্টরঘর সরকারী প্রাথমিক বিদ্যালয় ও দক্ষিণ জনারদন্দী সরকারী প্রাথমিক বিদ্যালয় কেন্দ্রে ভোট বন্ধ করে দেয় ও পুলিশ সদস্যদের শাস্তির বিষয়টি অনুমোদন করে ইসি। চন্দনাইশ পৌরসভার সহকারী রিটার্নিং কর্মকর্তা আবদুল লতিফ শেখ ইসির নির্দেশের বিষয়টি নিশ্চিত করেছেন। সাংবাদিকদের কাজে বাধা ॥ রাজধানীর আগারগাঁওয়ে নির্বাচন কমিশন সচিবালয়ে (ইসি) কাজ করতে গিয়ে বাধার মুখে পড়েন গণমাধ্যমের কর্মীরা। বুধবার সকাল থেকে সচিবালয়ের যে ব্লকে প্রধান নির্বাচন কমিশনার (সিইসি) কাজী রকিবউদ্দীন আহমদ, কমিশনার মোহাম্মদ আবদুল মোবারক, মোহাম্মদ আবু হাফিজ ও কমিশনের সচিব সিরাজুল ইসলাম বসেন, সে ব্লকে সাংবাদিকদের ঢুকতে দেয়া হয়নি। ইসিতে দায়িত্ব পালনকারী সাংবাদিকরা বলছেন, এ ধরনের ঘটনা এর আগে আর কখনও ঘটেনি। সচিব সিরাজুল ইসলাম এ বিষয়ে বলেন, কাজে অসুবিধা হবে। এ জন্য সাংবাদিকদের ঢুকতে দেয়া হচ্ছে না।
×