মীর নাসিরউদ্দিন উজ্জ্বল, মুন্সীগঞ্জ থেকে ॥ কনকনে শীত! সেই পৌষের সকালেই কেন্দ্রগুলোতে উপচে পড়া ভিড়। তাও আবার ভোট শুরুর আগে! সকাল ৭টা থেকেই ভোটারদের লাইন পড়ে যায় মুন্সীগঞ্জ কিশালয় কিন্ডারগার্টেন কেন্দ্রে। তখনও ভোট শুরুর ক্ষণ ৮টা বাজতে বেশ বাকি। সামান্য আগাতেই মুন্সীগঞ্জ উচ্চ বিদ্যালয় কেন্দ্রে আরও লম্বা লাইন। আর শহরের মাঠপাড়া সরকারী প্রাথমিক বিদ্যালয়, হরগঙ্গা কলেজ, গ্রীন লিফ কিন্ডারগার্টেন, দেওভোগ দুই নম্বর প্রাথমিক বিদ্যালয়, বৈখর অনিবার্ণ প্রাথমিক বিদ্যালয়, কোর্টগাঁও প্রাথমিক বিদ্যালয়েও একই চিত্র। চারদিকে যেন ভোট উৎসব। যানবান নেই, এরই মধ্যে হেঁটে শিশিরভেজা পথ পাড়ি দিয়ে লম্বা লাইনে দাঁড়াচ্ছে নারী-পুরুষসহ নানা বয়সী মানুষ। আর নতুন ভোটারদের মধ্যে যেন বাড়তি আনন্দ। এভাবেই কেটে যাচ্ছিল দলীয় প্রতীকে নির্বাচনের ইতিহাসে প্রাচীন জনপথ মুন্সীগঞ্জ পৌর নির্বাচনের সকালটা। কিন্তু বেলা পৌনে ১১টার দিকে এই উৎসে বাধা সৃষ্টি হয়।
ইদ্রাকপুর ১ নম্বর মডেল সরকারী প্রাথমিক বিদ্যালয় কেন্দ্রের কাছেই আকস্মিক হামলায় পড়ে আওয়ামী লীগ প্রার্থী। সেখানে ব্যাপক গুলিবর্ষণে পাঁচজন গুলিবিদ্ধসহ ১২ জন আহত হয়। এদের তিনজনকে ঢাকায় পাঠানো হয়েছে। পরে ভোটারদের মধ্যে আতঙ্ক ছড়িয়ে পড়লে শহরের উত্তরাংশে ভোটার উপস্থিতি কমে যায়।
ইদ্রাকপুর উচ্চ বিদ্যালয় কেন্দ্রে পৌনে ১১টায় নৌকার ফয়সাল বিপ্লব গাড়ি থেকে নামার সঙ্গে সঙ্গে হামলা হয়। আকস্মিক তাকে মারধর শুরু করে। এ সময় তার গাড়িতে গুলি ছোড়া হয়। অল্পের জন্য বেঁচে যান তিনি। কিছু দূরে হামলার শিকার হন তার চাচাত ভাই রাজন। হাটলক্ষ্মীগঞ্জ বেসরকারী প্রাথমিক বিদ্যালয়, ইদ্রাকপুর উচ্চ বিদ্যালয় কেন্দ্রের বাইরে এবং পুরনো বাসস্ট্যান্ট ও কৃষি ব্যাংক চত্বর এলাকায় কয়েক যুবক এলোপাতাড়ি গুলি করতে থাকে। এই সময় দিশেহারা হয়ে লোকজন ছোটাছুটি শুরু করে। একটি প্রাইভেটকার নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে সুপারমার্কেট এলাকায় ডিবি পুলিশের একটি মোটরসাইকেলকে ধাক্কা দিলে কনস্টেবল আব্দুল আলিম গুরুতর আহত হয়। তাকে চিকিৎসার জন্য ঢাকা পাঠানো হয়েছে। পরে বিজিবি, র্যাব ও পুলিশ ঘটনাস্থলে গিয়ে পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আনে। কেন্দ্রগুলোতে ভোটগ্রহণ কার্যক্রম সচল ছিল। তবে ভোটার উপস্থিতি হ্রাস পায়।
এরপর আওয়ামী লীগ প্রার্থী ফয়সাল বিপ্লব জানান, মৃনাল কান্তি এমপির মদদপুষ্ট কমিশনার প্রার্থী মকবুল হোসেন এবং স্বতন্ত্র প্রার্থী রেজাউল ইসলাম সংগ্রামের লোকজন এই হামলা চালায়। তিনি বলেন, আমি গাড়ি থেকে নামতেই আমাকে বাঁশ দিয়ে আঘাত করা হয়। এ সময় মকবুল ও নারায়ণগঞ্জের সেভেন মার্ডার গ্রুপের লোকজন উপস্থিত ছিল। এরপরে পিটিআই কেন্দ্রে আমার চাচাত ভাই রাজনের উপরও হামলা চালানো হয়। এর পূর্বে সকাল ৯টার দিকে যোগিনীঘাট সরকারী প্রাথমিক বিদ্যালয় কেন্দ্রে স্বতন্ত্র প্রার্থী সংগ্রাম গুলি ছুড়ে আতঙ্ক ছড়াতে চেষ্টা করে।
দিনভর ঘুরে এই পৌরসভার বিএনপি প্রার্থী একেএম ইরাদত মানুকে দেখা যায়নি। তবে তিনি ভোট শেষে ফোনে বলেন, আমি আগে থেকেই বলে আসছি, ২৫টি কেন্দ্রের সবকটিই ঝুঁকিপূর্ণ কিন্তু নির্বাচন কমিশন এ ব্যাপারে কোন ব্যবস্থা গ্রহণ করেনি। জনগণই দেখেছে কি রকম ভোট হয়েছে।
এছাড়া মানিকপুর গ্রীন লিফ কিন্ডারগার্টেন কেন্দ্রে দু’কমিশনার প্রার্থীর সমর্থকদের মধ্যে সংঘর্ষে দুইজন আহত হয়েছে। দেওভোগ ২নং প্রাথমিক বিদ্যালয় কেন্দ্রে কয়েকটি ককটেল বিস্ফোরণ হয়েছে। এই কেন্দ্রে মোবাইলে ভিডিও করার সময় আলমগীর নামে এক যুবককে দুর্বৃত্তরা বেদম প্রহার করে মোবাইল ফোন ছিনিয়ে নেয়। চরশিলমন্দির প্রাথমিক বিদ্যালয় কেন্দ্রের সামনে দৈনিক সকালের খবরের স্থানীয় প্রতিনিধি আরাফাতুজ্জামান বাবুকে (৩০) মারধর করেছে সন্ত্রাসীরা।
ইদ্রাকপুর মডেল সরকারী প্রাথমিক বিদ্যালয়ের প্রিজাইডিং অফিসার মোঃ নজরুল ইসলাম দুপুর আড়াইটার দিকে বলেন, আমার ভোটকেন্দ্রে ২ হাজার ৪০ ভোট। বেলা ১১টা পর্যন্ত প্রায় ১১শ’ ভোট পড়ে। কিন্তু ওই ঘটনার পরে সব ভোটাররা আতঙ্কিত হয়ে চলে যায়। এরপরের সাড়ে তিন ঘণ্টায় মাত্র পৌনে দুই শ’ ভোট পড়েছে। তবে দুপুর সাড়ে ১২টায় পাশের পিটিআই কেন্দ্রে গিয়ে দেখা যায় দীর্ঘ লম্বা লাইন। কিছু দূরের পাঁঘরিয়াকান্দি প্রাথমিক বিদ্যালয় কেন্দ্রে দুই নারী-পুরুষের দীর্ঘ লাইন দেখে যে কেই বিস্মিত হবেন। ভর দুপুরেও ভোট দেয়ার জন্য মানুষের উৎসবমুখর উপস্থিতি। এখানে মাঝ বয়সী ভোটার মরিয়ম বেগম বলেন, ‘অনেকদিন পর দেওনের সুযোগ পাইছি, তাই ঘরে কাম সাইরা ছুইট্টা আইলাম, এক ঘণ্টারও বেশিক্ষণ লাইনে দাঁড়াইয়া ভোট দিলাম।
এদিকে স্বতন্ত্র প্রার্থী রেজাইল ইসলাম সংগ্রাম সকাল সাড়ে ১০টায় নির্বাচন থেকে সরে দাঁড়ানোর কথা জানান সাংবাদিকদের। তবে এই বিষয়ে কিছুই জানাননি রিটার্নিং অফিসার এডিসি মোহাম্মদ ফজলে আজিম। এদিকে বিকেলে ভোট শেষ হওয়ার আগে বিভিন্ন কেন্দ্রে জাল ভোট দেয়ার অভিযোগ ওঠে। পিটিআই কেন্দ্রের নৌকার এজেন্ট ওয়াহিদ মাস্টার বলেন, অতি উৎসাহী কিছু লোক এবং কমিশনারা প্রার্থীর লোকজন মিলে এই কাজটি করেছে। পরে ম্যাজিস্ট্রেট এসে ৯৮টি ভোট বাতিল করে দেয়।
মুন্সীগঞ্জের জেলা প্রশাসক মোঃ সাইফুল হাসান বাদল বলেন, উৎসবমুখর পরিবেশে ভোট হয়েছে। যথেষ্ট সংখ্যক নারী ভোটারও এসেছেন। শান্তিপূর্ণভাবে ভোটাররা তাদের পছন্দের প্রার্থীর পক্ষে ভোট প্রদান করছেন। মুন্সীগঞ্জের পুলিশ সুপার বিপ্লব বিজয় তালুকদার বলেন, সকাল বেলায় কিছু গোলযোগের খবর আমরা পেয়েছি। তবে সবই ছিল ভোট কেন্দ্রের বাইরে। পরিস্থিতি সম্পূর্ণই আমাদের নিয়ন্ত্রণে রয়েছে। ভোটার তাদের ভোটাধিকার প্রয়োগে কোন প্রকার সমস্যায় পড়েনি।