ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ০২ মে ২০২৪, ১৮ বৈশাখ ১৪৩১

বিচ্ছিন্ন ঘটনা ছাড়া শান্তিপূর্ণ, নিরপেক্ষ ভোট

পৌর নির্বাচন নিয়ে সব আশঙ্কাই ভুল প্রমাণিত

প্রকাশিত: ০৬:০৮, ১ জানুয়ারি ২০১৬

পৌর নির্বাচন নিয়ে সব আশঙ্কাই ভুল প্রমাণিত

স্টাফ রিপোর্টার ॥ পৌর নির্বাচনে বিভিন্ন মহল থেকে ব্যাপক অনিয়মের অভিযোগ করা হলেও নির্বাচন ছিল অনেকটাই সুষ্ঠু ও শান্তিপূর্ণ। বর্তমান কমিশনের অধীনে আগের নির্বাচনগুলো পর্যালোচনা করলে দেখা যাবে যে, এ নির্বাচন শান্তিপূর্ণ পরিবেশে সম্পন্ন হয়েছে। বিচ্ছিন্ন যেসব ঘটনা ঘটেছে তা আগের যে কোন নির্বাচনের চেয়ে অনেক কম। এছাড়া কেন্দ্র দখল, ভোট কারচুপি এমনকি ব্যালট পেপারে সিল মারার ঘটনা ছিল না বললেই চলে। যেটুকু বিচ্ছিন্ন ঘটনা ঘটেছে তা কেন্দ্রের বাইরে। আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর তৎপরতার কারণে সঙ্গে সঙ্গে পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আনা সম্ভব হয়েছে। এছাড়া যেসব কেন্দ্রে অনিয়মের অভিযোগ পাওয়া গেছে সঙ্গে সঙ্গে সেগুলোর ভোটগ্রহণ বন্ধ করে দেয়া হয়েছে। নিরাপত্তামূলক ব্যবস্থা নেয়ায় নির্বাচনে ভোটও পড়েছে গড়ে প্রায় ৭৪ শতাংশ। প্রশাসনের কঠোর মনোভাবের কারণে ভোটারদের মধ্যে ভোট প্রদানে স্বস্তিও লক্ষ্য করা গেছে। পৌর নির্বাচনে মোট ৩ হাজার ৫৫৫টি কেন্দ্রে ভোটগ্রহণ করা হয়েছে। অথচ বিভিন্ন দলের পক্ষ থেকে অনিয়মের অভিযোগ করা হয়েছে মাত্র কয়েকশ কেন্দ্রের বিরুদ্ধে। সংশ্লিষ্টরা বলছেন দু-একটি বিচ্ছিন্ন ঘটনা নির্বাচনে ঘটে থাকে। এসব ঘটনা সার্বিক নির্বাচনের ফলে প্রভাব ফেলে না। অথচ আগের নির্বাচনের সঙ্গে বিশ্লেষণ করলে দেখা যাবে সহিংসতার ঘটনা যে কোন নির্বাচনের চেয়ে কম ছিল। এ নির্বাচনে দু-এক জায়গায় সহিংসতার ঘটনা ঘটলেও বেশিরভাগ কেন্দ্রে ভোটগ্রহণ হয়েছে অবাধ, সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ। এ কারণে নির্বাচনী ফলে আওয়ামী প্রার্থীরা বেশি জয়লাভ করলেও নির্বাচন ছিল প্রতিদ্বন্দ্বিতাপূর্ণ। পাশাপাশি বিএনপি, জামায়াত, জাতীয় পার্টি স্বতন্ত্র ছাড়া আওয়ামী লীগ ও বিএনপির বিদ্রোহী প্রার্থীরা জয়লাভ করতে সমর্থ হয়েছেন। সংশ্লিষ্টরা বলছেন নির্বাচন সুষ্ঠু না হলে তাদের পক্ষে জয়লাভ করা সম্ভব হতো না। তুলনামূলক বিচারে পৌরসভা নির্বাচনে বিভিন্ন মহল থেকে যে আশঙ্কার কথা বলা হয়েছিল নির্বাচনে তা ছিল না বললেই চলে। বিভিন্ন কেন্দ্রে বিক্ষিপ্ত কিছু ধাওয়া-পাল্টাধাওয়ার ঘটনা ঘটলেও বড় ধরনের সহিংসতার কোন অভিযোগ পাওয়া যায়নি। শুধু চট্টগ্রামের সাতকানিয়ায় দুই কাউন্সিলর প্রার্থীর সমর্থকদের মধ্যে সহিংসতায় একজনের মৃত্যু হয়েছে। জানা গেছে, তারা দুজনই ছিল আওয়ামী লীগ দলীয়। এর বাইরে পৌর নির্বাচনে ফল বিশ্লেষণ, মাঠের পরিস্থিতি সব মিলিয়ে শান্তিপূর্ণ পরিবেশ বজায় ছিল সকাল থেকেই ভোট গণনা পর্যন্ত। এ কারণে বিএনপির পক্ষ থেকে মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর ফল গণনা পর্যন্ত এজেন্টদের কেন্দ্র না ছাড়ার ঘোষণা দেন। তার এই ঘোষণা প্রমাণ করে বিএনপির বেশিরভাগ কেন্দ্রেই এজেন্ট ছিল। এজেন্ট বের করে দেয়ার ঘটনা এ নির্বাচনে ঘটেনি। সংশ্লিষ্টরা বলছেন, এ কমিশনের অধীনে আগের যে কোন নির্বাচনের চেয়ে পৌর নির্বাচন সুষ্ঠু ছিল। দু-একটি বিচ্ছিন্ন ঘটনা সব নির্বাচনেই হয়ে থাকে। বিশেষ করে যারা ক্ষমতাসীন থাকে তাদের পক্ষ থেকে প্রতিপক্ষের বিরুদ্ধে হুমকি-ধমকি দেয়া সব সরকারের সময়েই হয়েছে। সে তুলনায় এসব ঘটনা পৌর নির্বাচনে কমই ঘটেছে। অনেকেই বলছেন, টিভি মিডিয়া একই ঘটনা সারাদিন ধরে বারবার প্রচারের কারণে মনে হয়েছে পৌর নির্বাচনে ব্যাপক সহিংসতার ঘটনা ঘটেছে। কিন্তু নিরপেক্ষ দৃষ্টিতে বিশ্লেষণ করলে দেখা যাবে মুষ্টিমেয় কিছু কেন্দ্রে এসব ঘটনা ঘটেছে। সারাদেশে ৩ হাজার ৫৫৮ ভোট কেন্দ্রের মধ্যে কয়েকটি কেন্দ্রে এ ধরনের ঘটনায় ভোটের ফলাফলে কোন প্রভাব ফেলে না। বেশিরভাগ কেন্দ্রে নিরাপত্তায় আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর তৎপরতা ছিল চোখে পড়ার মতো। যেখানে সহিংস পরিস্থিতি সৃষ্টি হয়েছে সেখানে ত্বরিত ব্যবস্থা নেয়া হয়েছে। এসব ঘটনায় প্রার্থী বা দলকে বিবেচনায় নেয়া হয়নি। ফলে ক্ষমতাসীন দলের বিরুদ্ধে অভিযোগ পাওয়ার সঙ্গে সঙ্গে শাস্তিমূলক ব্যবস্থা নেয় হয়েছে। এ কারণে বরগুনায় ক্ষমতাসীন দলের মেয়র প্রার্থীও ভোট বর্জনের ঘোষণা দিয়েছেন। আওয়ামী লীগের পক্ষ থেকে এইচটি ইমাম নির্বাচন কমিশনে গিয়ে অভিযোগ করেন আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর বাড়াবাড়ির কারণে কিছু বিচ্ছিন্ন ঘটনা ঘটেছে। এছাড়া ভোট চলাকালে কোন দলের এজেন্টদের কেন্দ্র থেকে বের করে দেয়ার অভিযোগ পাওয়া যায়নি। সকাল থেকে ভোট গণনা পর্যন্ত স্ব স্ব দলের প্রায় সব এজেন্টকেই দেখা গেছে। তবে দু-একটি কেন্দ্রে বিএনপি এজেন্টের উপস্থিতি না থাকার যে দাবি করা হয়েছে তা দলের অভ্যন্তরীণ কারণেই হয়েছে বলে জানা গেছে। জানা গেছে, আগের কয়েকটি আন্দোলনে তৃণমূলে বিএনপির অধিকাংশ নেতাকর্মীর নামেই রয়েছে একাধিক মামলা। মামলা বা গ্রেফতারের ভয়েই অনেকে কেন্দ্রে এজেন্ট হিসেবে দায়িত্ব পালন করেননি। ফল বিশ্লেষণে দেখা গেছে, অনেক কেন্দ্রে পরাজিত বিএনপির প্রার্থীর ভোট ছিল প্রতিদ্বন্দ্বী জয়ী প্রার্থীর কাছাকাছি। এমনকি ১০ ভোট কম পেয়ে বিএনপির প্রার্থীর পরাজিত হওয়ার ঘটনা ঘটেছে। এছাড়া ২৩৩ পৌরসভায় এখন পর্যন্ত সর্বোচ্চ ভোট পাওয়ার প্রার্থীর তালিকায় রয়েছে বিএনপির প্রার্থীর নাম। বগুড়া সদরে বিএনপি প্রার্থী এ্যাডভোকেট মাহবুবুর রহমান ১ লাখ ৬ হাজার ৩৮৮ ভোট পেয়ে নির্বাচিত হয়েছেন। এবারের পৌরসভা নির্বাচনে তার প্রাপ্ত ভোটই মেয়রদের মধ্যে সর্বোচ্চ। অথচ এ পৌরসভায় তার নিকটতম প্রতিদ্বন্দ্বী আওয়ামী লীগের রেজাউল করিম মন্টু পেয়েছেন ৪৮ হাজার ৭০২ ভোট। ভোটব্যাংক হিসেবে পরিচিতি থাকলেও এ জেলায় বেশিরভাগ বিএনপির প্রার্থীর ভরাডুবির ঘটনা ঘটেছে। বিশ্লেষণে দেখা গেছে প্রার্থী মনোনয়নে ভুল, জামায়াতের সঙ্গে সমঝোতা না হওয়ায় এই ভরাডুবির ঘটনা ঘটেছে। বগুড়ার নন্দিগ্রাম পৌরসভায় বিএনপির বিদ্রোহী কামরুল হাসান সিদ্দিক জুয়েল ৪ হাজার ৪৪৩ ভোট পেয়ে নির্বাচিত হলেও ভুল মনোনয়নের কারণে বিএনপির প্রার্থী সুশান্ত সরকার সেখানে জিততে পারেননি। প্রার্থী মনোনয়নে ভুল বগুড়ায় নয়। বিশ্লেষণে দেখা গেছে, অনেক পৌরসভায় বিএনপির বিদ্রোহী প্রার্থী দলের প্রার্থীর চেয়ে অনেক বেশি ভোট পেয়েছেন। এছাড়া জামায়াতের সঙ্গে সমঝোতা না হওয়ায় বগুড়ার বেশিরভাগ পৌরসভায় বিএনপির প্রার্থীর পরাজিত হয়েছেন। এছাড়া উত্তরের অনেক জেলায় বিএনপির প্রার্থী পরাজয়ের অন্যতম কারণ জামায়াতের সঙ্গে সমঝোতা না হওয়ায়। এ নির্বাচনে জামায়াত দলীয়ভাবে নির্বাচন করতে না পারলেও দুটি পৌরসভায় তাদের প্রার্থীরা জয়লাভ করেছে। অনেক পৌরসভায় নিকটতম প্রতিদ্বন্দ্বী প্রার্থীর রয়েছে জামায়াত। প্রার্থী মনোনয়নে ভুলের খেসারত শুধু বিএনপির নয়। আওয়ামী লীগকে দিতে হয়েছে। ফল বিশ্লেষণে দেখা গেছে, আওয়ামী লীগের ১৮ বিদ্রোহী প্রার্থী নির্বাচনে জয়লাভ করেছেন। অথচ কেন্দ্র থেকে বিদ্রোহী প্রার্থীদের ওপর কঠোর মনোভাব দেখানো হয়েছে। যারা এ নির্বাচনে আওয়ামী লীগের বিদ্রোহী হিসেবে অংশগ্রহণ করেছে তাদের দল থেকেও তাৎক্ষণিক বহিষ্কার করা হয়েছে। অথচ নির্বাচনে তারা ঠিকই জয়লাভ করেছে। সংশ্লিষ্টরা নির্বাচনে ব্যাপক কারচুপি হলে কোনভাবে আওয়ামী লীগের বিদ্রোহী প্রার্থীদের পাস করার কথা নয়। সেখানে ১৮ জনের বেশিরভাগ বিদ্রোহী প্রার্থীর পক্ষে নির্বাচনে জয়লাভ করা সহজ হয়েছে সুষ্ঠু নির্বাচনের কারণেই। এছাড়া এ নির্র্বাচনে ৬ জন স্বতন্ত্র প্রার্থী পাস করেছেন যারা কোন দলের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট নন। অথচ তারা নির্বাচনে জয়লাভ করতে সক্ষম হয়েছে। নির্বাচনে জাতীয় পার্টির দুজন প্রার্থীও জয়লাভ করেছেন। যারা এ নির্বাচনে বিজয়ী হয়েছে তারা এখন পর্যন্ত নির্বাচনে কারচুপি বা কেন্দ্র দখলের অভিযোগ করেননি। তারা তাদের প্রতিক্রিয়ায় বলেন ভোট সুষ্ঠু হয়েছে বিধায় তাদের পক্ষে পাস করা সম্ভব হয়েছে। এছাড়া এ নির্বাচন কমিশনের অতীতের নির্বাচনের সঙ্গে তুলনা করলে দেখা যাবে আগের নির্বাচনে চেয়ে এ নির্বাচন অনেকটাই সুষ্ঠু ছিল। বিশেষ করে গত বছরের উপজেলায় নির্বাচনের তুলনামূলক বিশ্লেষণ করলে দেখা যাবে সে নির্বাচনে বেশ সহিংসতার ঘটনা ঘটেছে। অথচ সহিংতার মধ্যে বিএনপির ব্যাপকসংখ্যক প্রার্থী নির্বাচন জয়লাভ করেছেন। গত বছরের উপজেলা নির্বাচনে সঙ্গে তুলনা করলে দেখা যাবে ওই নির্বাচনে বেশ সহিংতার ঘটনা ঘটেছে। সহিংসতার মধ্যে উল্লেখযোগ্যসংখ্যক বিএনপি প্রার্থী নির্বাচনে জয়লাভ করেছেন। এমনকি যুদ্ধাপরাধী হিসেবে খ্যাত জামায়াতের প্রার্থীরা আওয়ামী লীগের প্রার্থীর চেয়ে অনেক ক্ষেত্রে আশাজনক ফল লাভ করেছেন। উপজেলায় নির্বাচনে কেন্দ্র দখল, ব্যালট পেপার ছিনতাই ও জাল ভোট দেয়ার ঘটনা ঘটলেও পৌরসভায় ছিল না বললেই চলে। এছাড়া বিশেষজ্ঞদের মতো অনুযায়ী অতীতে অনুষ্ঠিত সব স্থানীয় নির্বাচনের ক্ষেত্রে কিছু কিছু বিচ্ছিন্ন ঘটনা হয়েছে। এমনকি পার্শ্ববর্তী দেশ ভারতের নির্বাচনে এমন ঘটনা অহরহই হয়ে থাকে। পৌর নির্বাচনে ভোট পড়েছে ৭৩.৯১ ভাগ ॥ এদিকে নির্বাচন কমিশন জানিয়েছে পৌর নির্বাচনে ভোটারদের উপস্থিতি ছিল ৭৩.৯১ শতাংশ। এ হিসাব স্থগিত কেন্দ্রে ভোট বাদ দিয়ে। নির্বাচন কমিশনার মোঃ সিরাজুল ইসলাম বৃহস্পতিবার সাংবাদিকদের বলেন, মেয়র পদে ২০৭টি পৌরসভায় গড়ে ৭৩.৯২ শতাংশের বেশি ভোট পড়েছে। কেন্দ্র স্থগিত থাকা পৌরসভাগুলো বাদ দিয়ে বাকি পৌরসভায় মেয়র পদে ৬০ লাখ ৬৩ হাজার ভোটারের মধ্যে ৪৪ লাখ ৮১ হাজারের বেশি ভোট পড়েছে বলে জানান সচিব। ইসির উপ-সচিব সামসুল আলম জানান, এসব পৌরসভায় ৭৮ হাজার ২৯৫টি ভোট বাতিল হওয়ায় বৈধ ভোট পড়েছে ৪৪ লাখ ২ হাজার ৮৩৫টি। মেয়র পদে সর্বোচ্চ ৯২ শতাংশ এবং সর্বনিম্ন ৪৭ শতাংশ ভোট পড়েছে। এদিকে ইসির সহকারী সচিব রাজীব আহসান স্থগিত হওয়া কেন্দ্রের বিষয়ে নির্বাচন কমিশনের অনুমতি নিয়ে ফল ঘোষণার জন্য বৃহস্পতিবার সকালে রিটার্নিং কর্মকর্তাদের চিঠি দিয়েছেন। প্রয়োজন হলে পুনঃভোটের অনুমতির জন্য তাদের ইসিতে চিঠি দিতে বলেছেন। ভোট কেন স্থগিত করতে হলো সে বিষয়ে অন্তত আট পৌরসভায় রিটার্নিং অফিসার, পুলিশ সুপার ও জেলা প্রশাসকের কাছে ব্যাখ্যা চাওয়া হবে বলে তিনি জানান। ইসি জানিয়েছে এ নির্বাচনে সাতজন প্রার্থী বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় নির্বাচিত হয়েছেন। কেন্দ্র স্থগিত হওয়ার কারণে ১৯ পৌরসভার হিসাব করা হয়নি। এক্ষেত্রে মোট ২০৮টি পৌরসভার প্রতিবেদন তৈরি করা হয়েছে।
×