ঢাকা, বাংলাদেশ   বুধবার ২৪ এপ্রিল ২০২৪, ১১ বৈশাখ ১৪৩১

যুদ্ধাপরাধী বিচার

সাঈদীর মামলার পূর্ণাঙ্গ রায় প্রকাশ

প্রকাশিত: ০৬:২৪, ১ জানুয়ারি ২০১৬

সাঈদীর মামলার পূর্ণাঙ্গ রায় প্রকাশ

আরাফাত মুন্না ॥ একাত্তরে মানবতাবিরোধী অপরাধের দায়ে সুপ্রীমকোর্ট থেকে আমৃত্যু কারাদ-প্রাপ্ত জামায়াত নেতা দেলাওয়ার হোসাইন সাঈদীর আপীলের রায়ের পূর্ণাঙ্গ অনুলিপি প্রকাশ করেছে সুপ্রীমকোর্ট। শুনানি গ্রহণকারী আপীল বেঞ্চের পাঁচ বিচারপতি রায়ে স্বাক্ষর করার পর বৃহস্পতিবার সকালে ৬১৪ পৃষ্ঠার এ রায়টি প্রকাশ করা হয়। রায়ে দেখা গেছে- বেঞ্চের পাঁচ বিচারপতির মধ্যে তিন বিচারপতি সাঈদীকে আমৃত্যু কারাদ- দিয়েছেন। এছাড়া এক বিচারপতি মৃত্যুদ- এবং অন্য বিচারপতি কুখ্যাত এই যুদ্ধাপরাধীকে অভিযোগ থেকে অব্যাহতি দিয়ে খালাস দিয়েছেন। রায়ে আরও দেখা যায়, বিচারপতি এএইচএম শামসুদ্দিন চৌধুরী মানিক দুটি অভিযোগে দেলাওয়ার হোসাইন সাঈদীকে মৃত্যুদণ্ড দিয়েছেন। ৬১৪ পৃষ্ঠার রায়ে তিনি লিখেছেন ২১৮ পৃষ্ঠা। রায়ে তিনি বলেছেন, ইতোপূর্বে একই ধরনের (মানবতাবিরোধী অপরাধ) যে সমস্ত আপীল এ আদালতে এসেছে, অভিযোগ প্রমাণিত হওয়ার পর তাদের সবারই মৃত্যুদ- হয়েছে। এখানে দেলাওয়ার হোসাইন সাঈদীকে দোষী সাব্যস্ত করার পর অন্যকোন সাজা দিলে তা হবে সম্পূর্ণরূপে বৈষম্যমূলক। রায়ে তিনি আরও বলেন, দেলাওয়ার হোসাইন সাঈদী কোন অপরাধ করেনি- আমরা যদি এমন দাবি মেনে নেই, তাহলে ১৯৭১ সালে পাকি বাহিনী এবং তাদের দোসরা গণহত্যা, গণধর্ষণের মতো অভিযোগ করেনি- এটাও মেনে নেয়া হবে। এটা হবে গোটা মানবজাতির সঙ্গে প্রতারণা করা। এদিকে তৎকালীন প্রধান বিচারপতি মোঃ মোজাম্মেল হোসেন, বিচারপতি সুরেন্দ্র কুমার সিনহা (বর্তমান প্রধান বিচারপতি) ও বিচারপতি হাসান ফয়েজ সিদ্দিকী দেলাওয়ার হোসাইন সাঈদীকে তিনটি অভিযোগে দোষী সাব্যস্ত করে আমৃত্যু কারাদ- দিয়েছেন। ৬১৪ পৃষ্ঠার মূল রায়ে আমৃত্যু কারাদ- দেয়ার পক্ষে ১৫২ পৃষ্ঠা লিখেছেন বর্তমান প্রধান বিচারপতি সুরেন্দ্র কুমার সিনহা। অন্য দুই বিচারপতি তাকে সমর্থন করেছেন। বিচারপতি সুরেন্দ্র কুমার সিনহা লিখেছেন- ইব্রাহিম কুট্টি হত্যার ঘটনায় আসামিপক্ষ যে দালিলিক ফটোকপি দাখিল করছে, সেটা ভুয়া তা রাষ্ট্রপক্ষ প্রমাণ করতে ব্যর্থ হয়েছে- যার ‘বেনিফিট অব ডাউট’ সাঈদী পেতে পারে। অন্যদিকে বিচারপতি আবদুল ওয়াহ্হাব মিয়া কুখ্যাত যুদ্ধাপরাধী দেলাওয়ার হোসাইন সাঈদীকে প্রসিকিউশনের আনা সমস্ত অভিযোগ থেকে অব্যাহতি দিয়ে বেকসুর খালাস দিয়েছেন। মূল রায়ে খালাসের পক্ষে মত দিয়ে তিনি ২৪৪ পৃষ্ঠা লিখেছেন। রায়ে তিনি লিখেছেন, দেলাওয়ার হোসাঈন সাঈদীর পক্ষে সাফাই সাক্ষীদের অবিশ্বাস করার কোন কারণ নেই। সাফাই সাক্ষ্যে এসেছিল ১৯৭১ সালে যুদ্ধচলাকালীন পুরো সময় দেলাওয়ার হোসাইন সাঈদী ছিলেন রাজশাহীতে, আর প্রসিকিউশনের অভিযোগে এসেছে দেলাওয়ার হোসাইন সাঈদী পিরোজপুরে অপরাধ সংঘঠিত করেছেন। সাঈদী ঘটনাস্থলে ছিলেন না এবং ঘটনার সঙ্গে জড়িতও ছিলেন না- এমনটাই রায়ে লিখেছেন বিচারপতি আবদুল ওয়াহ্্হাব মিয়া। গত বছরের ১৭ এপ্রিল সুপ্রীমকোর্টের আপীল বিভাগ সংক্ষিপ্ত রায় ঘোষণার মাধ্যমে সাঈদীর সাজা শোনান। রায় ঘোষণার দেড় বছরেরও বেশি সময় পার হওয়ার পর পূর্ণাঙ্গ রায় প্রকাশ করা হলো। এর আগে বিচারিক আদালত (আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল) কুখ্যাত এ যুদ্ধাপরাধীকে মৃত্যুদ- দিয়েছিল। তবে সুপ্রীমকোর্টে এসে পাঁচ বিচারপতির আপীল বেঞ্চে সংখ্যাগরিষ্ঠতার মতের ভিত্তিতে এ যুদ্ধাপরাধীর সাজা কমে। এদিকে রায়ে একাধিক মত আসায় মুক্তিযুদ্ধে মানবতাবিরোধী ভূমিকার কারণে ‘দেইল্যা রাজাকার’ খ্যাত সাঈদীর মৃত্যুদ-ের বিষয়ে রাষ্ট্রপক্ষের এবং আসামিপক্ষে তার (সাঈদী) খালাসের বিষয়ে রায় রিভিউ (পুনর্বিবেচনার) চেয়ে আবেদন করারও সুযোগ তৈরি হয়েছে। যদিও রায় পর্যালোচনা করে রিভিউ আবেদন করার বিষয়ে সিদ্ধান্ত নেয়ার কথা জানিয়েছেন সংশ্লিষ্টরা। এ বিষয়ে ভারপ্রাপ্ত এ্যাটর্নি জেনারেল মুরাদ রেজা সাংবাদিকদের বলেন, পূর্ণাঙ্গ রায় প্রকাশিত হয়েছে। রায়টি পর্যালোচনার পর তথ্যউপাত্ত বিশ্লেষণ করে রিভিউ করার সিদ্ধান্ত নেয়া হবে এবং সেটা রিভিউ করার জন্য নির্ধারিত সময়ের মধ্যে করা হবে। আইন অনুসারে রিভিউ করতে হলে রায় প্রকাশের ১৫ দিনের মধ্যে আবেদন করতে হয়। আপীল বিভাগের পূর্ণাঙ্গ রায় ॥ পূর্ণাঙ্গ রায়ে বিচারপতি এএইচএম শামসুদ্দিন চৌধুরী মানিক বলেন, যুক্তরাষ্ট্রসহ পৃথিবীর বেশির ভাগ দেশে এখনও মৃত্যুদ- বলবত এবং সংখ্যাগরিষ্ঠ জনসংখ্যা এখনও মনে করে যে, কিছু অপরাধ এতই জঘন্য, যেগুলো রোধকল্পে মৃত্যুদ- বলবত রাখা অপরিহার্য। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের দৃষ্টান্ত টেনে তিনি বলেন, যুক্তরাষ্ট্রের মতো একটি উন্নত দেশও ফাঁসির দ- দেয়া দেশসমূহের তালিকায় পাঁচ নম্বরে অবস্থান করছে। এমন আরও অনেক দেশ আছে যেখানে খুন ছাড়া অন্যান্য অপরাধেও মৃত্যুদ- দেয়া হয়। মানবতাবিরোধী অপরাধের বিচারে নুরেমবার্গ ট্রাইব্যুনালসহ উন্নত বিশে^র কয়েকটি দেশের উদাহারণ দিয়ে বিচারপতি শামসুদ্দিন চৌধুরী বলেন, মৃত্যুদ- দেয়াটা সবক্ষেত্রে প্রতিশোধমূলক নয়, এটি অত্যন্ত সুফল প্রতিরোধ্য শক্তি হিসেবেও কাজ করে। সাঈদীর মৃত্যুদ- প্রসঙ্গে বিচারপতি মানিক উল্লেখ করেন, যে ধরনের অপরাধের জন্য এবং পরিস্থিতিতে মৃত্যুদ- দেয়া যায়, সে ধরনের পরিস্থিতি ও অপরাধের চেয়েও অনেক জঘন্য অপরাধ করেছে সাঈদী। গণহত্যা, ধর্ষণ, লুট, অগ্নিসংযোগসহ এমন কোন অপরাধ নেই যা সাঈদী করেনি। সাক্ষ্যপ্রমাণে এটাও প্রমাণিত যে, সাঈদী ও তার পরিবারের লোকদের ভয়ে বহুলোক সাক্ষী দিতে আসেনি এবং বাড়ি থেকেও পালিয়ে গেছে। তার মতো একজন জঘন্য কুলাঙ্গারকে বাঁচিয়ে রাখার অর্থ হবে তার এবং তার পরিবারকে এ ধরনের অপরাধ পুনরাবৃত্তি করার সুযোগ করে দেয়া। তার মৃত্যুদ- কোনভাবেই অযৌক্তিক হবে না। রায়ে বিচারপতি শামসুদ্দিন চৌধুরী আরও বলেন, মানবতাবিরোধী অপরাধের মামলায় এর আগেও আপীল বিভাগ জগন্য অপরাধীদের মৃত্যুদ- বহাল রেখেছেন। সেসব অপরাধীর চেয়ে সাঈদীর অপরাধ কোন অংশেই কম নয়। যে অপরাধ বিবেচনায় অন্যদের যেখানে মৃত্যুদ- বহাল রাখা হয়েছে, সেই একই অপরাধ বিবেচনায় সাঈদীকে মৃত্যুদ- না দেয়া হবে সম্পূর্ণ বৈষম্যমূলক। বিচারপতি চৌধুরী উল্লেখ করেন, নুরেমবার্গ ট্রাইব্যুনালে বক্তব্য উপস্থাপনের সময় ট্রাইব্যুনালের প্রধান প্রসিকিউটর বিচারপতি জ্যাকসন বলেছিলেন, আমরা যদি ডিফেন্সের কথা স্বীকার করি যে, তারা এসব অপরাধ করেনি। তাহলে এ ধরনের যুক্তি মেনে নিতে হবে যে, দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় কোন গণহত্যা হয়নি। বিচারপতি মানিক বলেন, বিচারপতি জ্যাকসনের সঙ্গে কণ্ঠ মিলিয়ে আমাকেও বলতে হবে আমরা যদি সাঈদীর এ উক্তি মেনে নেই যে সাঈদী এই অপরাধ করেনিÑ তাহলে তার অর্থ হবে এটা মেনে নেয়া, ১৯৭১ সালে পাকি বাহিনী এবং তাদের দোসর রাজাকার আলবদররা গণহত্যা, গণধর্ষণ অগ্নিসংযোগ করেনি। তা হবে গোটা মানবজাতির সঙ্গে প্রতারণা করা। কেননা বিশ্ববাসী জানে কি ধরনের জঘন্য হত্যাযজ্ঞ, ধ্বংসযজ্ঞ ওই বাহিনী এবং তাদের দোসররা করেছিল বাংলাদেশে। বিচারপতি মানিক পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে প্রচলিত সাজা দেয়ার আইন ও নীতিমালা উল্লেখ করে বলেছেন, এসব নীতিমালার আলোকে একমাত্র ফাঁসিই হবে সাঈদীর উপযুক্ত শাস্তি। অন্যদিকে সাঈদীকে খালাস দেয়ার সপক্ষে আপীল বিভাগের বিচাপতি মোঃ আবদুল ওয়াহ্হাব মিঞা রায়ে বলেছেন, মুক্তিযুদ্ধ চলাকালে সাঈদী পুরো সময় রাজশাহীতে ছিল, এটা আসামিপক্ষের সাক্ষ্যপ্রমাণে উঠে এসেছে। সাক্ষীদের অবিশ^াস করার মতো কোন কারণ খুঁজে পাওয়া যায়নি। তবে আপীল বিভাগের একই বেঞ্চের অপর তিন বিচারপতি তাদের রায়ে সাঈদীর অপরাধ প্রমাণিত উল্লেখ করে আমৃত্যু কারাদ- দিয়েছেন। রায়ে তারা বলেন, ইব্রাহিম কুট্টি হত্যার ঘটনায় আসামিপক্ষ যে দালিলিক ফটোকপি দাখিল করছে, সেটা ভুয়া, তা রাষ্ট্রপক্ষ প্রমাণ করতে ব্যর্থ হয়েছে। যার ‘বেনিফিট অব ডাউট’ সাঈদী পেতে পারে। যদিও দলিলটা সন্দেহাতীতভাবে ভুয়া বলেই আমরা মনে করি। সার্বিক বিবেচনায় আমরা মনে করি, আমৃত্যু কারাদ-টাই সাঈদীর জন্য উপযুক্ত। এ মামলায় সাঈদী ও রাষ্ট্রপক্ষ পৃথক দুটি আপীল আবেদন দায়ের করেছিল। ট্রাইব্যুনালের রায়ে সাজা ঘোষিত না হওয়া ৬টি অভিযোগে শাস্তির আর্জি জানিয়ে রাষ্ট্রপক্ষ আর সাঈদীর ফাঁসির আদেশ থেকে খালাস চেয়ে আসামিপক্ষ আপীল করেন। আদালত উভয়টির আংশিক মঞ্জুর করেন। রায়ে ১০, ১৬, ১৯ নম্বর অভিযোগে জামায়াতের এই নায়েবে আমিরকে আমৃত্যু সশ্রম কারাদ- দেয়া হয়। আর ৮ নম্বর অভিযোগের একাংশের জন্য সাঈদীকে ১২ বছরের সশ্রম কারাদ- এবং ৭ নম্বরের জন্য ১০ বছর কারাদ- দেয় আপীল বিভাগ। এছাড়া ৮ নম্বর অভিযোগের অপর অংশসহ ৬, ১১ ও ১৪ নম্বর অভিযোগ থেকে তাকে খালাস দেয়া হয়েছে। এর মধ্যে ৮ ও ১০ নম্বর অভিযোগে ইব্রাহিম কুট্টি ও বিসাবালীকে হত্যা এবং হিন্দু সম্প্রদায়ের বাড়িঘরে আগুন দেয়ার দুটি অভিযোগে আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল এই কুখ্যাত রাজাকার সাঈদীকে ফাঁসির সাজা দিয়েছিল। এই যুদ্ধাপরাধীর বিরুদ্ধে ২০টি অভিযোগ থাকলেও চূড়ান্ত রায়ে তার বিরুদ্ধে প্রমাণিত হলো পাঁচটি অভিযোগ।
×