ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৬ এপ্রিল ২০২৪, ১২ বৈশাখ ১৪৩১

৬৪ জেলার শিল্পের আলোয় উদ্ভাসিত বাংলাদেশ সাংস্কৃতিক উৎসব

প্রকাশিত: ০৫:৪৮, ২ জানুয়ারি ২০১৬

৬৪ জেলার শিল্পের আলোয় উদ্ভাসিত বাংলাদেশ সাংস্কৃতিক উৎসব

স্টাফ রিপোর্টার ॥ ডুবে গেল বছরের প্রথম দিনের সূর্যটা। নেমে এলো সন্ধ্যার অন্ধকার। জ্বলে উঠল চৌষট্টি জেলার প্রতীকী ৬৪টি রঙিন বাতি। অন্তরীক্ষের উদ্দেশ্যে ছাড়া হলো একঝাঁক বর্ণিল বেলুন। এরপর আতশবাজির ঝরনাধারায় গোধূলিবেলার আকাশটাও ভরে গেল অজস্র রঙের তারায়। ইতোমধ্যেই আলোড়িত দর্শককে আরও বেশি মুগ্ধ করতে জলাধারবেষ্টিত নন্দন মঞ্চে উঠল একঝাঁক নৃত্যশিল্পী। লাল-নীল-সবুজ-হলুদ-সাদা পোশাকের শিল্পীরা মুদ্রা ও অভিব্যক্তির মেলবন্ধনে উপস্থাপন করল ষড়ঋতুর বাংলাদেশকে। শুক্রবার পৌষের সন্ধ্যায় এমন মনমাতানো আনুষ্ঠানিকতায় সূচনা হয় ৬৪ জেলা শিল্পকলা একাডেমির অংশগ্রহণে বাংলাদেশ সাংস্কৃতিক উৎসব। ৫৬ হাজার বর্গমাইলের বাংলাদেশে শিল্পের আলো ছড়ানোর উদ্যোগ নিয়েছে বাংলাদেশ শিল্পকলা একাডেমি। সংস্কৃতির শাণিত শক্তিতে নির্মিত হবে সৃজনশীল বাংলাদেশ। সেই সুবাদে দেশের ৬৪ জেলায় শিল্পকলা একাডেমির অংশ্রগ্রহণে অনুষ্ঠিত হচ্ছে বিশাল এ উৎসব। আবহমান বাংলার শেকড়ের গভীরে প্রোথিত শিল্প-সংস্কৃতিকে মেলে ধরার লক্ষ্যে ১৮ দিনের এ উৎসবের আয়োজন। একাডেমির নন্দন মঞ্চে শুক্রবার থেকে শুরু হওয়া উৎসবটি চলবে ১৮ তারিখ পর্যন্ত। প্রতিদিন বিকেল থেকে রাত অবধি চলবে সারা দেশের চার হাজার শিল্পীর অংশগ্রহণে বৈচিত্র্যময় অনুষ্ঠানমালা। সকল জেলা শিল্পকলা একাডেমির শিশুদল ও বড়দের পরিবেশনায় উপস্থাপিত হবে সমবেত সঙ্গীত, সমবেত নৃত্য, একক সঙ্গীত, আবৃত্তি ও অভিনয়। সেই সঙ্গে থাকবে জেলার বৈশিষ্টপূর্ণ বিশেষ পরিবেশনা। সম্মেলক কণ্ঠে জাতীয় সঙ্গীত পরিবেশনের মাধ্যমে শুরু হয় উদ্বোধনী আয়োজন। পৌষের বিকেলে উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে প্রধান অতিথি ছিলেন সংস্কৃতিমন্ত্রী আসাদুজ্জামান নূর। বিশেষ অতিথির বক্তব্য রাখেন সব্যসাচী লেখক সৈয়দ শামসুল হক। একাডেমির মহাপরিচালক লিয়াকত আলী লাকীর সভাপতিত্বে স্বাগত বক্তৃতা করেন সচিব জাহাঙ্গীর হোসেন চৌধুরী। শুভেচ্ছা বক্তব্য রাখেন একাডেমির সঙ্গীত, নৃত্য ও আবৃত্তি বিভাগের পরিচালক সোহরাব উদ্দীন। বিশেষ অতিথির বক্তব্যে শেকড়ের সংস্কৃতিতে তুলে ধরা আহ্বান জানান সৈয়দ শামসুল হক। বলেন, একটি দেশের রাজনীতি যদি হয় তার শরীর, তবে সংস্কৃতি হচ্ছে তার মুখাবয়ব। এই উৎসবের মাধ্যমে আমরা দেখব আবহমান বাংলার সেই মুখটি। উপলব্ধি করব বিশাল বাংলার সংস্কৃতির শেকড়কে। এই গ্রাম বাংলাই কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরকে দিয়েছে সোনার বাংলা অবলোকনের অনুভব। তাই গ্রামের ভেতর থেকে শিল্পের রস সংগ্রহ করে সেটাকে ছড়িয়ে দিতে হবে শহরে। বরেণ্য এই লেখক ও কবি আরও বলেন, এ উৎসবে এসে পুরনো একটি বিষয় আবারও আবিষ্কার করলাম, আমাদের মুক্তিযুদ্ধজাত বাংলাদেশ সৃজনশীল এবং এটাই সত্য। তৃণমূলের সংস্কৃতিকে কেন্দ্রে মেলে ধরার প্রত্যয়ের কথা উঠে আসে প্রধান অতিথির বক্তব্যে। আসাদুজ্জামান নূর বলেন, সারাদেশের তৃণমূল পর্যায়ের সংস্কৃতিচর্চাকে কেন্দ্রের উপস্থাপনের উদ্যোগ নেয়া হয়েছে। সেই লক্ষ্যে অনুষ্ঠিত হচ্ছে এ উৎসব। এর মাধ্যমে মূল্যায়িত হবে প্রত্যন্ত অঞ্চলের সঙ্গীত, নৃত্য, নাটক কিংবা আবৃত্তিচর্চার সঙ্গে সম্পৃক্ত শিল্পীরা। বিকাশ ঘটবে তাদের প্রতিভার। এদেশের মানুষ সংস্কৃতিবান্ধব হওয়ায় কাজটি কঠিন হলেও অসাধ্য নয়। তিনি আরও বলেন, এক সময় শিল্প-সংস্কৃতি ছিল আমাদের লড়াইয়ের হাতিয়ার। তবে দেশ স্বাধীনতা পরবর্তী সংস্কৃতিচর্চা বাড়েনি, যদিও সুযোগ-সুবিধা বেড়েছে। আগামীর সম্ভাবনার কথা ব্যক্ত করে সংস্কৃতিমন্ত্রী বলেন, বাংলাদেশ অসম্ভব গতিতে সামনের দিকে এগিয়ে চলেছে। অনেক উন্নত দেশকেও পেছনে ফেলে এগিয়ে যাচ্ছে এই দেশ। উন্নয়নের এই ভারসাম্য রক্ষা করতে হলে সাংস্কৃতিক ক্ষেত্রেও অগ্রগতি ঘটাতে হবে। শিল্প-সংস্কৃতির প্রতি আকৃষ্ট করতে হবে নতুন প্রজন্মকে। সভাপতির বক্তব্যে লিয়াকত আলী বলেন, এটা শুধু একটি উৎসব নয়, সংস্কৃতির আন্দোলনও। ১৯৭৪ সালে যে স্বপ্নের পথরেখায় বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান শিল্পকলা একাডেমি প্রতিষ্ঠা করেছিলেন সেই স্বপ্ন বাস্তবায়নেরই অংশ এ উৎসব। বঙ্গবন্ধুর স্বপ্ন ছিল সারা দেশে সংস্কৃতিচর্চাকে ছড়িয়ে দেয়া। ৫৬ হাজার বর্গমাইলের বাংলাদেশকে শিল্পের আলোয় আলোকিত করারই একটি উদ্যোগ এই উৎসব। আলোচনা শেষে বেলুন উড়িয়ে ও আতশবাজির মাধ্যমে উৎসবের উদ্বোধন হয়। এর পর মঞ্চে ছিল ষড়ঋতু বিষয়ক গান, নৃত্য পরিবেশনা। ‘এ কি অপরূপ রূপে মা তোমায়’ গানটি দিয়ে শুরু হয় এ নাচ। ছিল রবীন্দ্রনাথের প্রকৃতিবিষয়ক কয়েকটি গানের খ-াংশের সঙ্গে নাচ। দীপা খন্দকার, এম আর ওয়াসেক ও আইরিন পারভীনের পরিচালনায় এবং বাংলাদেশ ফাইন আর্টসের পরিবেশনায় ও ফারহানা চৌধুরী বেবীর পরিচালনায় পরিবেশিত হয় এই সমবেত নৃত্য। এর পর শুরু হয় ৬৪ জেলার শিল্পের আলোয় উদ্ভাসিত উৎসবটির পরিবেশনা পর্ব। প্রথম দিনের পরিবেশনায় অংশ নেয় জয়পুরহাট, সিলেট, গোপালগঞ্জ ও ময়মনসিংহ জেলা শিল্পকলা একাডেমি। নানা সাংস্কৃতিক পরিবেশনায় অংশ নেয় জয়পুরহাট, সিলেট, গোপালগঞ্জ, ময়মনসিংহ জেলার শিল্পীরা। শুরুতেই জয়পুরহাট শিল্পকলা একাডেমির শিশুশিল্পীদের কণ্ঠে গীত হয় দেশাত্মবোধক ও লোকগান। বগুড়া পরিবেশন করে লোকগীতি ও আধুনিক গান। বাউল সঙ্গীত পরিবেশন করেন রমজান বাউল। জেলার ঐতিহ্যবাহী বিয়ের গান পরিবেশনের মধ্য দিয়ে শেষ হয় জয়পুরহাটের শিল্পীদের পরিবেশনা। সিলেট শিল্পকলা একাডেমির শিশুশিল্পীদের কণ্ঠে শুরুতেই ছিল জেলার পরিচিতিমূলক গানের পরিবেশনা। রাধারমণ ও হাছন রাজার গান গেয়ে শোনায় মালিহা, ভাবনা, সঞ্চিতা, রাখী, অর্পিতা, তন্ময়, সাদিকুল, রানা, সুমন ও অনি। জেলার শিশু নৃত্যশিল্পীদের নূপুরের ঝঙ্কারে পরিবেশিত হয় সিলেটের মরমি কবিদের গান নিয়ে নৃত্যালেখ্য। ছিল মনিপুরী নৃত্যও। ‘গোপালগঞ্জ ঠিকানা আমার’ ও ‘গাছের ডালে কোকিল ডাকে’ গানের সুরে শুরু হয় গোপালগঞ্জ জেলা শিল্পকলা একাডেমির পরিবেশনা। শিশু নৃত্যদল ‘মাটি আমার মা’ ও ‘নবান্নের উৎসবে ঢোল বাজে’ গানের সুরে নৃত্য পরিবেশন করে। বড়দের সঙ্গীত দলের কণ্ঠে গীত হয় ‘হিমালয় থেকে সুন্দরবন’ ও ‘বিজয়ের গান’। নৃত্যদলের পরিবেশনার সূচনা ঘটে ‘যার জন্য দেশ পেলাম তারই নামে গাইবো’ গানের সুরে। এরপর বঙ্গবন্ধুর ৭ই মার্চের ভাষণের আলোকেও নৃত্য পরিবেশন করেন তারা। জেলার ঐতিহ্যবাহী দিন বদলের জারিগান পরিবেশন করেন প্রণব, আকাশ ও সঞ্চীয়া রায়। প্রথম দিনের পরিবেশনা শেষে মঞ্চে আসে ময়মনসিংহ শিল্পকলা একাডেমির শিল্পীরা। তাদের কণ্ঠে শুরুতেই পরিবেশিত হয় ‘আমাদের দেশটা স্বপ্নপুরী’ ও ‘মাগো তুমি কেন বলোনি মুজিব নামের গল্প’। শিশু নৃত্যদল ‘ধন্য ধন্য বলি তারে’ ও ‘গাও হেলানি দিয়া নাচগো গোলাপী’ গানের সুরে নৃত্য পরিবেশন করে। বড়দের সঙ্গীতদল পরিবেশন করে ‘ময়মনসিংহ সবুজ শোভা, শস্য পরিপাটি’ ও ‘মেন্দী লাল টুকটুক করে’ গান দুটি। বড়দের নৃত্যদল ‘উচাটন মন ঘরে রয়না’ ও ‘নাওয়ে নায়রল লইয়া যায়’ গানের সুরে নৃত্য পরিবেশন করে। সবশেষ পরিবেশনা ছিল মহুয়া গীতি নৃত্যনাট্যের অংশবিশেষ। আজ শনিবার থাকছে হবিগঞ্জ, কুমিল্লা, ফরিদপুর ও রাজশাহী জেলা শিল্পকলা একাডেমির পরিবেশনা। পৌষের সন্ধ্যায় বুলবুল জন্ম উৎসব ॥ জাতীয় নৃত্যশিল্পী নৃত্যাচার্য বুলবুল চৌধুরীর ৯৭তম জন্মবার্ষিকী উপলক্ষে নৃত্যশিল্পী সংস্থা ও শিল্পকলা একাডেমির যৌথ উদ্যোগে শুক্রবার অনুষ্ঠিত হয় বুলবুল জন্ম উৎসব। পৌষের সন্ধ্যায় শিল্পকলা একাডেমির জাতীয় নাট্যশালা মিলনায়তনে অনুষ্ঠিত উৎসবে প্রধান অতিথি ছিলেন সংস্কৃতি সচিব আক্তারী মমতাজ। একাডেমির মহাপরিচালক লিয়াকত আলী লাকীর সভাপতিত্বে অনুষ্ঠানে বিশেষ অতিথি ছিলেন আইন ও সালিশ কেন্দ্রের নির্বাহী পরিচালক এ্যাডভোকেট সুলতানা কামাল। স্বাগত বক্তব্য রাখেন নৃত্যশিল্পী সংস্থার সভাপতি মিনু হক। আলোচনা শেষে ছিল মনোজ্ঞ নৃত্য পরিবেশনা। শিশু একাডেমিতে মান্না উৎসব ॥ প্রয়াত চলচ্চিত্র অভিনেতা মান্না স্মরণে শুক্রবার অনুষ্ঠিত হলো মান্না উৎসব। সন্ধ্যায় শিশু একাডেমিতে এ উৎসবের আয়োজন করে মান্না ফাউন্ডেশন। নাচ, গান ও ফ্যাশন শোর মাধ্যমে সাজানো স্মরণ অনুষ্ঠানে প্রধান অতিথি ছিলেন তথ্যমন্ত্রী হাসানুল হক ইনু। বিশেষ অতিথি ছিলেন ঢাকা দক্ষিণ সিটি কর্পোরেশনের মেয়র সাঈদ খোকন ও এনটিভির ব্যবস্থাপনা পরিচালক মোসাদ্দেক আলী। সাংস্কৃতিক পরিবেশনায় অংশ নেন চলচ্চিত্র শিল্পী মৌসুমী, পপি, অমিত হাসান প্রমুখ।
×