ঢাকা, বাংলাদেশ   শনিবার ২০ এপ্রিল ২০২৪, ৭ বৈশাখ ১৪৩১

ড. মোঃ হুমায়ুন কবীর

বই উৎসব-২০১৬

প্রকাশিত: ০৩:৪২, ৩ জানুয়ারি ২০১৬

বই উৎসব-২০১৬

প্রতিবছর জানুয়ারি মাসে প্রাথমিক বিদ্যালয়ের শিশুদের হাতে বই তুলে দেয়া একটি রেওয়াজে পরিণত হয়েছে। সে জন্য নতুন বছরের জানুয়ারি মাসের প্রথম দিনে সরকার বই উৎসবের ঘোষণা দিয়েছে। বাংলাদেশের প্রাথমিক শিক্ষা হলো সর্বজনীন অর্থাৎ বিনা খরচে সব শিশুর জন্য প্রাথমিক বিদ্যালয়ের পঞ্চম শ্রেণী পর্যন্ত লেখাপড়া বাধ্যতামূলক করা হয়েছে। সে জন্য আগে প্রতিবছরের শুরুতে প্রথম থেকে পঞ্চম শ্রেণী পর্যন্ত প্রত্যেকটি ক্লাসের প্রতিটি ছাত্রকে বিনামূল্যে নতুন একসেট বই বিতরণ করা হতো, কিন্তু এখন তা আরও সম্প্রসারিত করে প্রথম থেকে নবম শ্রেণী পর্যন্ত করা হয়ে থাকে। আমরা জানি, প্রাথমিক পর্যায়ের স্কুলগুলোয় অবকাঠামোগত সমস্যা, শিক্ষক স্বল্পতা, শিক্ষকদের যথাযথ প্রশিক্ষণের অভাব, স্কুলের সঙ্গে যোগাযোগ ব্যবস্থা, প্রকৃত মনিটরিং, শ্রেণীকক্ষে সব শিক্ষকের সমানভাবে মনোযোগ না থাকা, সর্বোপরি শিক্ষকদের কোচিং বাণিজ্য ও প্রাইভেট পড়ানোর প্রবণতার কারণে অল্প কিছু স্কুল ছাড়া বাকিগুলোয় মানসম্পন্ন লেখাপড়া হচ্ছে না। সেই সুযোগে শহরাঞ্চলে তো বটেই এমনকি এখন গ্রামাঞ্চলেও বিকল্প হিসেবে বেসরকারী পর্যায়ে হাজারো কিন্ডারগার্টেন স্কুল প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। তবে প্রাথমিক পর্যায়ে সরকারী-বেসরকারী সব প্রতিষ্ঠানেই জাতীয় শিক্ষাক্রম ও পাঠ্যপুস্তক বোর্ডের (এনসিটিবি) বই পড়ানো বাধ্যতামূলক। আর সে জন্যই সরকারী-বেসরকারী সকল পর্যায়ে একই দিনে পাঠ্যবই বিনামূল্যে বিতরণ করা হয়ে থাকে। এবার ২০১৬ সালের বই উৎসব সরকারের তরফ থেকে ঘোষণা করা হয়েছে। বছরের শুরুর দিন থেকে দু’দিনব্যাপী এই উৎসব চলবে। সেই হিসেবে জানুয়ারি মাসের ১ ও ২ তারিখ শুক্র ও শনিবার অনুষ্ঠিত হচ্ছে। দু’দিনের ব্যবস্থা রাখা হয়েছে এ জন্য যে, যদি কোন শিক্ষার্থী ১ জানুয়ারি বই নিতে মিস করে, তাহলে তাদের আবার ২ জানুয়ারিতে বই প্রদান করা হবে। সরকারের শিক্ষা মন্ত্রণালয় থেকে নোটিস জারি করা হয়েছে, যদি জানুয়ারি মাসের ১ তারিখ কোন বন্ধের দিন হয়, তার পরও সেদিনই বই উৎসব অনুষ্ঠিত হবে। যে কারণে সেদিন সব প্রাথমিক বিদ্যালয় খোলা রাখার জন্য নির্দেশনা দেয়া হয়েছে। আওয়ামী লীগের নেতৃত্বাধীন চৌদ্দদলীয় মহাজোটের সরকার ক্ষমতায় আসার পর থেকে প্রতিবছর জানুয়ারি মাসের প্রথম দিনে কোমলমতি শিক্ষার্থীদের হাতে একটি উৎসবের আমেজে সবার হাতে নতুন বই তুলে দেয়া একটি রেওয়াজ হিসেবে দাঁড়িয়েছে। বছরের শুরুতে নতুন ক্লাসে উঠে নতুন বই হাতে পাওয়ার যে কি আনন্দ সেটা ভাবার জন্য সবাইকে একটু পেছনের দিকে নিয়ে যাচ্ছি। আমার জীবনের সেই সময়ের সামান্য স্মৃতিটুকু বিনিময় করলেই হয়ত বেশিরভাগ মানুষের বাস্তবচিত্র ফুটে উঠবে। ছোটবেলায় বাবা-মার কাছে খাওয়ার এটা-সেটা চেয়ে বায়না ধরতাম। তারপর একে একে জামা-জুতা ইত্যাদি ইত্যাদি। সবকিছু যখন সহজেই পেয়ে যেতাম তখন আবার নতুন মলাটের সুন্দর ছবিযুক্ত কোন বইয়ের জন্য বায়না ধরে কান্না শুরু করে দিতাম। সেই বই পেয়ে কী যে আনন্দ পেতাম তা আর বলে বোঝাতে পারব না। ঠিক একই রকমভাবে একটি ক্লাসের বার্ষিক পরীক্ষায় পাস করে তখন নিজের আত্মীয়স্বজন, প্রতিবেশী সিনিয়র বড় ভাই-বোনের কাছ থেকে নতুন ক্লাসের বই সংগ্রহ করে সেগুলো কিছুদিন খুব যতœ করে নতুন মলাট লাগিয়ে রেখে দিতাম। মনে পড়ে, সম্ভবত ১৯৮০-৮১ সালের কথা, তখন স্কুলের বোর্ডের বই পোস্ট অফিসের মাধ্যমে আসত এবং তা সরাসরি ছাত্রছাত্রীদের গ্রহণ করতে হতো। তখন ৪-৫ বছর পর পর বই নতুন করে সংশোধিত সংস্করণ ছাপানো হতো, তাও আবার কেবল বাংলা কিংবা ইংরেজী বই। সে জন্য এক বছরের পুরনো বই বেশ কয়েক বছর চালানো যেত। স্কুলে তখন এভাবে বিনামূল্যে নতুন বই বিতরণের নিয়ম ছিল না। প্রতিবছরই নতুন ক্লাসের জন্য যাদের প্রয়োজন তাদের নতুন বই কিনতে হতো। কিন্তু এখন প্রতিবছরই সরকার থেকেই প্রত্যেকটি স্কুলের ছাত্রছাত্রীর জন্য সরকারী ব্যবস্থাপনায় বিনামূল্যে নতুন বই বিতরণ করা হয়ে থাকে। প্রথমদিকে সেটি আসলে সরকারী প্রাথমিক বিদ্যালয় দিয়ে শুরু হলেও এখন সব স্কুল ও মাদ্রাসায় তা বিতরণ করা হচ্ছে। এবারে (২০১৬) শিক্ষা মন্ত্রণালয় এবং প্রাথমিক ও গণশিক্ষা মন্ত্রণালয় দুটির পক্ষ থেকে জানা গেছে যে, প্রাক-প্রাথমিক, প্রাথমিক, এবতেদায়ী, মাধ্যমিক, দাখিল, এসএসসি, এসএসসি ভোকেশনাল, দাখিল ভোকেশনাল সব প্রতিষ্ঠান মিলিয়ে মোট ৪ কোটি ৪৪ লাখ ১৬ হাজার ৭২৮ শিক্ষার্থীকে ৩৩ কোটি ৩৭ লাখ ৬২ হাজার ৭৬০টি বই বিনামূল্যে বিতরণ করা হবে। এবারে দেশী প্রকাশক দিয়ে বই ছাপানোর জন্য সরকারের একটি বড় চ্যালেঞ্জ ছিল। আর সে কারণে দাতা সংস্থা বিশ্বব্যাংকের সঙ্গে বইয়ের ছাপার মান নিয়ে একটু সংশয়ের প্রেক্ষিতে প্রাথমিক পর্যায়ে সিদ্ধান্ত নিয়ে ছাপার কাজ শুরু করতে কিছুটা দেরি হয়েছে। আর সে জন্য গণমাধ্যমের কল্যাণে আমরা দেখেছি যে, এ বই সময়মতো ছাপানোর জন্য শিক্ষামন্ত্রী নিজে তার টিম নিয়ে প্রেসে প্রেসে গিয়ে বই ছাপানো তদারকি করেছেন। সম্প্রতি বই ছাপার কাগজের মান নিয়ে গণমাধ্যমে সচিত্র প্রতিবেদনের প্রেক্ষিতে শিক্ষামন্ত্রী মহোদয় বলেছেন যে, এ বিষয়ে সুনির্দিষ্ট নীতিমালা রয়েছে। আমরা কোন পর্যায়েই মানের সঙ্গে কোন রকম আপোস করব না। বই বুঝে নেয়ার পর পরীক্ষা-নিরীক্ষা করে যদি দেখা যায় যে, সে বইয়ের ছাপা, কাগজ, সংখ্যা ইত্যাদি মানসম্পন্ন নয়, তবে সেসব প্রতিষ্ঠানের বিরুদ্ধে আইনানুযায়ী যথাযথ ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে। বর্তমান সরকার প্রতিবছরই শিক্ষার্থীদের কাছে সুষ্ঠু, সুন্দর ও সময়মতো বই বিতরণ করে ইতিহাস সৃষ্টি করেছে। কারণ দেখা গেছে, ২০১৩ সালে বর্তমান সরকারের একটি মেয়াদ শেষ হচ্ছিল এবং তারপর পর সেই ঐতিহাসিক জ্বালাও-পোড়াওয়ের ভেতর দিয়ে ৫ জানুয়ারি ২০১৪ সালের জাতীয় সংসদ নির্বাচনের পরও সে বছর ১ জানুয়ারি সারাদেশে বই উৎসব পালন করা হয়েছিল। ঠিক একইভাবে ২০১৫ সালের জানুয়ারি মাসের প্রথমদিক থেকে লাগাতার অবরোধ কর্মসূচীর ভেতর দিয়ে যাচ্ছিল, কিন্তুসে বছরও বই সময়মতো বিতরণে কোন রকম ব্যত্যয় হয়নি। তারই ধারাবাহিকতায় ২০১৬ সালের বই উৎসব অবশ্যই আরেকটি মাইলফলক, তাতে কোন সন্দেহ নেই। বই বিতরণের বিষয়টি আরও অর্থবহ ও সর্বজনীন করা সরকারের একটি ঐকান্তিক ইচ্ছা। তারই অংশ হিসেবে এবার শিক্ষান্ত্রী বই বিতরণের দিনে সংশ্লিষ্ট এলাকার প্রত্যেকটি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে সেই সব এলাকার গণ্যমান্য ব্যক্তিবর্গ, স্থানীয় ও জাতীয় পর্যায়ের জনপ্রতিনিধি ও রাজনৈতিক ব্যক্তিবর্গ, বিশিষ্ট শিক্ষাবিদবর্গকে ওই উৎসবে উপস্থিত থেকে উৎসাহ প্রদানের জন্য আহ্বান জানিয়েছেন। শিশুদের ব্যাপারে প্রধানমন্ত্রী নিজেও সংবেদনশীল। তিনি জাতীয় শিশু দিবস পালনের এক অনুষ্ঠানে শিশুদের অহেতুক বইয়ের বোঝা না বাড়ানোর পরামর্শ দিয়েছেন সংশ্লিষ্ট সব শিক্ষা প্রতিষ্ঠানকে। তাছাড়া সরকারী স্কুলে ভর্তির ক্ষেত্রে কোন প্রতিযোগিতামূলক পরীক্ষার আয়োজন না করে সংশ্লিষ্ট স্কুলের এলাকাভিত্তিক মেধাক্রম ও কোটা বিবেচনায় ভর্তির পরামর্শ দিয়েছেন। কারণ, দেখা গেছে প্রতিবছরের শুরুতে স্কুলে ভর্তির জন্য কে কোন্ স্কুলে ভর্তি হবে, ভর্তির জন্য আবেদন করবে ইত্যাদি বিষয় নিয়ে একটি হুলস্থূল কা- হয়ে যায়। অপরদিকে আরেকটি বিষয় এখানে উল্লেখ না করলেই নয়। এখন আধুনিক শিক্ষাব্যবস্থায় সৃজনশীল পদ্ধতির প্রবর্তন করা হয়েছে যাতে পাঠ্যবইয়ের মাধ্যমে শ্রেণীকক্ষই লেখাপড়া শেষ করার জন্য যথেষ্ট। কিন্তু দেখা গেছে, পাঠ্যবই বের হওয়ার আগেই সেই বইয়ের গাইড বই বেরিয়ে পড়ছে। গাইডগুলো অনেক মূল্যবান। অভিভাবক মাত্রই মনে করেন যে, যদি তার ছেলেমেয়ের জন্য গাইড বই কিনে দেয়া না যায় তাহলে হয়ত সে পড়ালেখায় পিছিয়ে থাকবে। সে জন্য স্কুল থেকে সরকারী ব্যবস্থাপনায় বিনামূল্যে পাঠ্যবই পেলেও তাদের লেখাপড়া চালিয়ে নেয়ার জন্য পাঠ্যবই থেকে অধিক মূল্যে গাইড বই কিনতে হচ্ছে। তাছাড়া প্রাইভেট পড়ানো কিংবা কোচিং সেন্টার তো রয়েছেই। এ সব বিষয়ে সরকারের তরফ থেকে কার্যকর উদ্যোগ নিয়ে শিক্ষাসংশ্লিষ্ট সকলের ভেতর থেকে ব্যবসা মনোবৃত্তি দূর করতে হবে। অপরদিকে স্কুল পর্যায়ে ড্রপআউট কমিয়ে আনার জন্য স্কুল ফিডিং এবং উপবৃত্তির জন্য পাইলট প্রকল্প ধাপে ধাপে সারাদেশে সম্প্রসারিত করতে হবে। আর বর্তমান শিক্ষাবান্ধব সরকার এগুলো পদক্ষেপ নিয়ে ফি-বছর বই উৎবের আনন্দকে প্রকৃত অর্থে চিরস্থায়ী করবে বলেই সকলের ধারণা ও প্রত্যাশা। লেখক : ডেপুটি রেজিস্ট্রার, জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলাম বিশ্ববিদ্যালয়, ত্রিশাল, ময়মনসিংহ [email protected]
×