ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৯ মার্চ ২০২৪, ১৪ চৈত্র ১৪৩০

মাজেদুল হক

পল্লীতীর্থের অনন্য রূপকার কবি জসীমউদ্দীন

প্রকাশিত: ০৬:৩৬, ৮ জানুয়ারি ২০১৬

পল্লীতীর্থের অনন্য রূপকার কবি জসীমউদ্দীন

আধুনিক যুগের অন্যতম কবি জসীমউদ্দীন ১ জানুয়ারি ১৯০৩-১৪ মার্চ ১৯৭৬, অম্বিকাপুর, ফরিদপুর) বাংলা কাব্যের ইতিহাসের প্রেক্ষিত ও কালের বিবেচনায় একটি স্বতন্ত্র কণ্ঠস্বর। পল্লীর সাধারণ মানুষের সমাজ মনস্ককতার যে চিত্ররূপ, জসীমউদ্দীনের আন্তরিকতা, অগ্রবর্তী অভিজ্ঞতা, অভিনব দৃষ্টিভঙ্গি, অসাধারণ ভাষা নৈপুণ্য, প্রখর কাল চেতনা, অনুভূতির তীব্রতা, বিশ্লেষণধর্মিতা, সৌন্দর্যবোধ এ সবকিছু মিলে পল্লীজীবন পেয়েছে আধুনিক সাহিত্যে নতুন মাত্রা। পল্লীসাহিত্যের রতœ ভা-ার খুবই সমৃদ্ধ হয়েছে। এই রতœ ভা-ার থেকে জসীমউদ্দীন শব্দ, উপমা, অলঙ্কার, আঙ্গিক, বাকভঙ্গি ও ছন্দভঙ্গি গ্রহণ করেছেন এবং উন্নতর ছন্দের সুষমা ও কলাকৌশল প্রয়োগে তাঁকে আধুনিক কাব্যে শিল্পসম্মত করেছেন। আর এ স্বভাবগত কারণেই পল্লীপ্রকৃতির সঙ্গে এক প্রগাঢ় বন্ধুত্বের বন্ধন সৃষ্টি হয়েছে। তাঁর মতো এতো কাছ থেকে এতো সুনিপুণভাবে এতো নিবিষ্ট হয়ে পল্লীপ্রকৃতির স্নিগ্ধতা ও সৌন্দর্যের মহিমাম্বিত রূপ কেউ অবলোকন করতে পারেননি। তাঁর সমস্ত কবি মানসজুড়ে বিস্তৃত ছিল পল্লীপ্রকৃতির উদার সবুজ শ্যামল রূপ নদী-নালা খাল-বিল, মাঝির দরাজ কণ্ঠের ভাটিয়ালি সুর, অমোঘ প্রকৃতির যে ব্যঞ্জনা ও চিত্রকল্প প্রস্ফুটিত তা সত্যি বিরল। পল্লী যেন তাঁর পরম আত্মার আত্মীয়। এ সুবাদে অকৃত্রিম জীবনের আবহমান পল্লীর রূপ এসে ধরা দিয়েছে তাঁর নিজের মহিমায়। এরূপ বিচিত্র অভিজ্ঞতা পল্লী জীবনকে আরও কাছ থেকে বহুমাত্রিক দৃষ্টিতে দেখার এক অপূর্ব সুযোগ করে দিয়েছেন তিনি। এজন্য পল্লী জনগোষ্ঠীর জীবন ও চরিত্র সম্পর্কে সুগভীর অন্তর্দৃষ্টির অধিকারী হতে পেরেছে। সে কারণেই জসীমউদ্দীন কোনো একটা বিশেষ শ্রেণীর কবি হয়ে থাকেননি। এক গভীর অপ্রতিরোধ্য আবেদন নিয়ে তিনি যেতে পেরেছেন বাংলার সকল শ্রেণীর মানুষের কাছে এই বৃহত্তর জনগোষ্ঠীর জীবন ভাবনা নিয়ে। গ্রাম বাংলার প্রকৃতি, পল্লীর মায়ের জীবনবোধ, পল্লীবাসীর সুখ-দুঃখ, শোষণ-নিপীড়িত বঞ্চনার কথা, স্বপ্ন ও স্বপ্ন ভঙ্গের বাক প্রতিমা, পৌরাণিক অনুষঙ্গ, পূজা-পার্বণ, জেলে-জেলেনি, বৈরাগী-বোষ্টমী, গ্রামীণ অন্ত্যজ নারী, গাহারিয়া, কৃষক দুলালী, শাকতুলুনী, গহীন গাঙ্গের নাইয়া, কিশোর-কিশোরী, সোজন-দুলি, রূপাই-সাজুর প্রেমের উপাখ্যান ও আসমানী, সখিনার কথা তার কাব্যে একের পর এক কাব্যে স্থান পেয়েছে বলেই তিনি হতে পেরেছেন গণমানুষের কবি, পল্লীর সংস্কারক, পল্লীচিত্রকর, পল্লীমায়ের কবি, পল্লীকবি জসীমউদ্দীন। কবি মনে প্রাণে ছিলেন একজন অসম্প্রদায়িক ব্যক্তি, হিন্দু মুসলমান, নিম্নস্তরের মানুষের মধ্যে সর্বত্র তাঁর ছিল অবাধ বিচরণ। জীবনবোধে পল্লীকবি জসীমউদ্দীন আধুনিক শিক্ষায় শিক্ষিত ছিলেন বলেই গ্রামীণ বাংলা ও নগর বাংলার সংস্কৃতির বৈষম্যের একটা রূপরেখা তাঁর মননে সব সময় এসেছে। সেই প্রভাব তাঁর কাব্যরীতিতে সুস্পষ্ট হয়ে উঠেছে। এদেশের মধ্যযুগের শ্রীকৃষ্ণকীর্তন, চন্ডীমঙ্গল, বৈষ্ণবসাহিত্য, রোমান্টিক প্রণয়োপাখ্যান থেকে শুরু“করে ময়মনসিংহ গীতিকা, মঙ্গলকাব্য, অন্নদানমঙ্গল, বাংলার নিঝুম প্রান্তরে ছড়িয়ে থাকা ভাটিয়ালি, লোকগান, জারিসারি, বিচারগান, কবিগান, মুর্শিদী ও লোকজ সংস্কৃতি সবকিছুর সাথে নিবিড় পরিচয় ঘটেছে। জসীম উদ্দীন বাংলা ভাষার একমাত্র কবি যিনি ছিলেন একাধারে লোকায়তিক, আধুনিক, গ্রামীণ স্বদেশিক ও আন্তর্জাতিক। অথচ একালের অনেক কবি তাকে একটু উন্নত ধরনের পল্লীকবির অভিধা থেকে আর বেশি কিছু মনে করেন না। তিনি আধুনিক প্রকরণেই সাহিত্যচর্চা নির্বিঘেœ করেছেন। কবির মৃত্যুর আগে ও পরে কাব্যগ্রন্থের মধ্যেÑ রাখালী (১৯২৭), নকশীকাঁথার মাঠ (১৯২৯), বালুচর ( ১৯৩০), ধানক্ষেত (১৯৩২), সোজন বাদিয়ার ঘাট (১৯৩৩), রঙিলা নায়ের মাঝি (১৯৩৫), হাসু (১৯৩৮), রূপবতী (১৯৪৬), এক পয়সার বাঁশি (১৯৪৯), পদ্মাপার (১৯৫০), মাটির কান্না, মধুমালা (১৯৫১), যাদের দেখেছি, ডালিম কুমার (১৯৫২), গাঙের পার (১৯৫৪), পল্লীবধূ (১৯৫৬), চলো মুসাফির (১৯৫৭), সকিনা গ্রামের মেয়ে (১৯৫৯), বাঙালীর হাসির গল্প ১ম খ- (১৯৬০), ঠাকুরবাড়ির আঙ্গিনায়, সুচয়নী (১৯৬১), মা যে জননী কান্দে (১৯৬৩), জীবন কথা, বোবা কাহিনী, বাঙালীর হাসির গল্প ২য় খ- (১৯৬৪), হলদে পরীর দেশে (১৯৬৫), হলুদ বরণী (১৯৬৬), যে দেশে মানুষ বড়, জারি গান, স্মৃতির পট, ওগো পুষ্পধনু (১৯৬৮), জলের লেখন, পদ্মা নদীর দেশে (১৯৬৯), ভয়াবহ সেই দিনগুলোতে (১৯৭২), জার্মানির শহরে-বন্দরে (১৯৭৫), মাগো জ্বালিয়ে রাখিস আলো (১৯৭৬), মুর্শিদী গান (১৯৭৭), স্মরণের সরণী বাহী (১৯৭৮), আসমান সিংহ, আসমানীর কবিতা (১৯৮৬)। কবি জসীমউদ্দীনের কাব্যগ্রন্থগুলো গ্রামমুখী ধনাত্মক শব্দ প্রয়োগে মাধুর্যপূর্ণ; অন্যদিকে সচেতন, শিল্প প্রকরণ প্রয়াসেও প্রতিটি কবিতা হয়ে উঠেছে যথার্থ শিল্পের স্মারক। শাশ্বত পল্লীজীবন ও প্রকৃতি হয়েছে তাঁর সৃষ্টি কর্মের শ্রেষ্ঠ উপাদান। ‘বাংলা সাহিত্যের ইতিবৃত্ত’ গ্রন্থে সৈয়দ আলী আহসান জসীমউদ্দীনের কাব্য প্রকৃতি সম্পর্কে লিখেছেন, ‘গ্রাম্যজীবন ও গ্রাম্য পরিবেশ তাঁর কাব্যের উপাদান যুগিয়েছে এবং তাঁর কবিতার কলাকৌশলের মধ্যে গ্রাম্য আবহকে আমরা মূর্ত হতে দেখি।’ খ্যাতিমান সাহিত্যিক ড. দীনেশ চন্দ্র সেন জসীমউদ্দীন রচিত ‘কবর’ কবিতাটি পড়ে লিখলেন, ‘দূরাগত রাখালের বংশীধ্বনির মতো তোমার কবিতা আমার অন্তরকে স্পর্শ করেছে। তোমার কবিতা পড়ে আমি কেঁদেছি।’ পরে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রবেশিকা পরীক্ষার বাংলা পাঠ্য গ্রন্থে তালিকাভুক্ত করেন। অবনীন্দ্রনাথ ঠাকুর ‘নকশীকাঁথার মাঠ’ কবিতা পড়ে মন্তব্য করলেন, এই লেখার মধ্য দিয়ে বাংলার পল্লীজীবন আমার কাছে চমৎকার একটি মাধুর্যময় ছবির মতো দেখা দিয়েছে।’ বিশ্ব কবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর তাঁর লেখায় স্বীকার করেছেন, তাঁর লেখনী সুদূরগামী হলেও সর্বত্রগামী হতে পারেনি। জসীমউদ্দীনের মতো সহজ ভাষায় সাধারণ মানুষের কথা আমি বলতে পারিনি। তাই রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর লিখেছেন- ‘সহজ কথা বলতে আমায় বলো যে, ও কথা যায় না বলা সহজে।’
×