ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৯ মার্চ ২০২৪, ১৫ চৈত্র ১৪৩০

সাইফুল ইসলাম রিপন

‘তিতাস একটি নদীর নাম’ ও অদ্বৈত মল্লবর্মণ চর্চা

প্রকাশিত: ০৬:৩৬, ৮ জানুয়ারি ২০১৬

‘তিতাস একটি নদীর নাম’ ও অদ্বৈত মল্লবর্মণ চর্চা

অদ্বৈত মল্লবর্মণ ঔপন্যাসিক, সাংবাদিক, অনুবাদক ও কালজয়ী উপন্যাস ‘তিতাস একটি নদীর নাম’ এর স্রষ্টা। ১ জানুয়ারি অদ্বৈত মল্লবর্মণের ১০২তম জন্মবার্ষিকী । বাংলা কথাসাহিত্যে যে ক’জন গুণী শিল্পী নিজের প্রতিভাগুণে স্মরণীয় হয়ে আছেন তাঁদের অন্যতম অদ্বৈত মল্লবর্মণ। অদ্বৈত মল্লবর্মণ। তার জন্ম ১৯১৪ সালের ১ জানুয়ারি ব্রাহ্মণবাড়িয়া শহর থেকে দক্ষিণ-পশ্চিমে পাঁচ-ছয় কিলোমিটার দূরের তিতাসপাড়ের গোকর্ণ গ্রামে জন্ম। যার পাশেই প্রবহমান তিতাস নদী। তাঁর বাবার নাম অধরচন্দ্র মল্লবর্মণ, মায়ের নাম সারদা। অদ্বৈতরা ছিলেন তিন ভাই ও এক বোন। বোন সবার বড়। ভাইবোনদের মধ্যে তিনি ছিলেন দ্বিতীয়। শৈশবেই অদ্বৈতর পিতামাতার ও তার কিছুকাল পরে দুই সহোদরের মৃত্যু হয়। ১৯৩৪-এ তিনি কলকাতা যাওয়ার পূর্বেই তাঁর বোনটিও মারা যায়। মালোজীবনের এক বিরুদ্ধ ও বৈরী পরিবেশে তাঁর লেখাপড়া শুরু হয়েছিল। প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষা শুরু হয় ব্রাহ্মণবাড়িয়া শহরের প্রথম মাইনর স্কুল (বর্তমানে ব্রাহ্মণবাড়িয়া উচ্চ বিদ্যালয়) থেকে। এরপর ভর্তি হন অন্নদা উচ্চ বিদ্যালয়ে। ১৯৩৩ সালে ম্যাট্রিকুলেশন পরীক্ষায় প্রথম বিভাগে পাস করেন। তারপর ভর্তি হন কুমিল্লা ভিক্টোরিয়া কলেজে উচ্চ মাধ্যমিক শ্রেণীতে। মেধাবী ছাত্র হওয়া সত্ত্বেও আর্থিক সঙ্কটের কারণে ১৯৩৪ সালের মে জুন মাসে তাঁর প্রাতিষ্ঠানিক পড়াশোনা বন্ধ হয়ে যায়। তার পড়ালেখার ইতি টানতে হয়। যতই দিন যাচ্ছে অদ্বৈতচর্চা ততই বৃদ্ধি পাচ্ছে। উভয় বাংলা ছাড়িয়ে অন্য ভাষায়ও অদ্বৈতচর্চা হচ্ছে। ‘তিতাস একটি নদীর নাম’ অনূদিত হয়েছে ইংরেজী ও ফরাসী ভাষায়। তিতাসকে ঘিরে গড়ে ওঠা জেলে সমাজের আশা-আকাক্সক্ষা, চাওয়া-পাওয়া, সংস্কার, সামাজিক আচার-ব্যবহার ও বাঁচার জন্য প্রতিনিয়ত সংগ্রামের কাহিনী খ- খ- চিত্রের মাধ্যমে ১৯৭৩ সালে ঋত্বিক ঘটক চলচিত্রে রূপ দেন যা দর্শকদের মধ্যে আলোড়ন তোলে। ভারতীয় গণনাট্য সংঘ ‘তিতাস একটি নদীর নাম’ এর নাট্যরূপ দিয়ে তা মঞ্চস্থ করেছে। বাংলাদেশে শান্তনু কায়সার ‘তিতাস একটি নদীর নাম’ এর নাট্যরূপ দিয়েছেন। ব্রাহ্মণবাড়িয়ার সাংস্কৃতিক ব্যক্তিত্ব মনজুরুল আলমও ‘তিতাস একটি নদীর নাম’ এর নাট্যরূপ দিয়েছেন। ত্রিপুরার ননীগোপাল চক্রবর্তী ২০০২ সালে তিতাসের নাট্যরূপ দেন। এ ছাড়াও তিতাস একটি নদীর নাম নিয়ে যাত্রাপালা রচনা করেন ও নির্দেশনা দেন শ্যামল ঘোষ। ভারতের ত্রিপুরা সরকারের তফসিলী জাতি কল্যাণ দফতর ১৯৯৫ সালের ১১ নবেম্বর গঠিত করে ‘অদ্বৈত মল্লবর্মণ স্মৃতি রক্ষা কমিটি এবং ঘোষণা করেছে ‘অদ্বৈত পুরস্কার’। ত্রিপুরা রাজ্য সরকার ১৯৯৬ সাল থেকে বিভিন্ন স্থানে অদ্বৈত জন্মোৎসব পালন ও নানা আয়োজনে তাঁকে স্মরণ করে। ত্রিপুরার সোনমুড়া মহকুমার জলজীবী অধ্যুষিত এলাকা কেমতলীতে ‘অদ্বৈত মল্লবর্মণ স্মৃতি সাহিত্য সংস্কৃতি বিকাশ কেন্দ্র ও পাঠাগার স্থাপন করা হয় এবং কেমতলী উচ্চ বিদ্যালয়টির নামকরণ করা হয় ‘অদ্বৈত মল্লবর্মণ স্মৃতি উচ্চ বিদ্যালয়’। সোনামুড়া মহকুমার দুর্লভনারয়ণ গ্রামে রয়েছে অদ্বৈতর আবক্ষমূর্তি ও ‘অদ্বৈত কমিউনিটি হল’। ২০১৩ সালে আগরতলা অফিস লেনে তফসিলী জাতি কল্যাণ দফতরের উদ্যোগে করা হয়েছে দ্বিতল ‘অদ্বৈত অতিথি শালা’। অদ্বৈত মল্লবর্মণের এই কালজয়ী উপন্যাস বাংলাদেশ টেক্সবুক বোর্ড উচ্চ মাধ্যমিক পর্যায়ে পাঠ্যসূচীর অন্তর্ভুক্ত করেছে। ত্রিপুরা বিশ্ববিদ্যালয়ে ‘তিতাস একটি নদীর নাম’ পাঠ্যসূচীর অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে। কলকাতায় প্রতিষ্ঠিত হয়েছে ‘অদ্বৈত মল্লবর্মণ কালচারাল এ্যান্ড এডুকেশনাল সোসাইটি’। এই উপন্যাসের বিভিন্ন দিক নিয়ে লেখা হচ্ছে প্রবন্ধ, প্রকাশিত হচ্ছে বই, তাঁকে নিয়ে করা হচ্ছে উচ্চতর ডিগ্রী। ব্রাহ্মণবাড়িয়ার সন্তান মার্কিন প্রবাসী ওবায়েদুল্লাহ মামুন ২০০৬-এ তিতাস একটি নদীর নামকে ভিত্তি করে ফটো এ্যালবাম তিতাস: ছবি ও কবিতায় প্রকাশ করেন। গোকর্ণঘাট গ্রামে তার পৈতৃক ভিটেবাড়ি খুঁজে পাওয়া একটু কঠিন। কিন্তু ২০১২ সালে ব্রাহ্মণবাড়িয়ার তৎকালীন জেলা প্রশাসক মোঃ আবদুল মন্নানের উদ্যোগে অদ্বৈতের জন্মভিটা সংলগ্ন একটি আবক্ষ ভাস্কর্য স্থাপন করা হয়। অদ্বৈতর জন্মস্থানে রয়েছে অদ্বৈত মল্লবর্মণ স্মৃতি পাঠাগার ও অদ্বৈত স্মৃতি পরিষদ। ব্রাহ্মণবাড়িয়ায় অদ্বৈত মল্লবর্মণের জন্মবার্ষিকীতে (১ জানুয়ারি) তার জন্মভিটায় অনুষ্ঠানের আয়োজন করা হয়। ব্রাহ্মণবাড়িয়ার স্থানীয় সাংস্কৃতিক সংগঠন সাহিত্য একাডেমির উদ্যোগে ১৯৯০ সাল থেকে প্রতিবছর এ অনুষ্ঠানের আয়োজন করে আসছে। অদ্বৈত মল্লবর্মণের জন্মভিটায় দিনব্যাপী অদ্বৈত মেলার আয়োজন করা হয়। অদ্বৈতর প্রতিকৃতিতে পুষ্পস্তবক অর্পণের মাধ্যমে মেলা শুরু হয়। মেলা ছাড়াও আলোচনা সভা, স্বরচিত কবিতা পাঠ, কবিত। আবৃত্তি, নাটক, সঙ্গীতানুষ্ঠান, স্কুল কলেজের ছাত্রছাত্রীদের মধ্যে ক্রীড়া ও সাংস্কৃতিক প্রতিযোগিতা এবং জেলেদের মধ্যে সাঁতার, মাছধরা ও নৌকাবাইচ প্রতিযোগিতা প্রভৃতির মধ্য দিয়ে দিনব্যাপী অনুষ্ঠান উদযাপিত হয়। ২০১৪ সাল ছিল অদ্বৈত মল্লবর্মণের জন্মশতবর্ষ। এ উপলক্ষে অদ্বৈতর জন্মভূমি ব্রাহ্মণবাড়িয়ায় ২০১৩-এর জানুয়ারি থেকে স্থানীয় সংগঠন সাহিত্য একাডেমি ও তিতাস আবৃত্তি সংগঠন নানা অনুষ্ঠানের আয়োজন করে। সাহিত্য একাডেমির উদ্যোগে স্মারক বক্তৃতাসহ বছরব্যপী অদ্বৈতকে স্মরণ ও মূল্যায়ন করে। ‘তিতাস একটি নদীর নাম’ বাঙালী মানসকে এতটাই আলোড়িত করেছে যে, অনেক বাব-মা তাদের সন্তানের নাম রেখেছেন তিতাস। ১৯৫১ সালের ১৬ এপ্রিল মাত্র ৩৭ বছর বয়সে অদ্বৈত মল্লবর্মণ দুরারোগ্য যক্ষ্মায় আক্রান্ত হয়ে মারা যান। বাংলা সাহিত্যের একটি গর্ব ক্ষণজন্মা অদ্বৈত মল্লবর্মণ। মাত্র সাঁইত্রিশ বছরের সৃষ্টিকর্মে তাঁর প্রতিভার যে স্ফূরণ ঘটেছিল তা স্থায়ী খ্যাতির আসনে সুপ্রতিষ্ঠিত। তাঁর জন্মবার্ষিকীতে তাঁকে শ্রদ্ধাভরে স্মরণ করছি। তথ্য সূত্র: জন্ম শতবর্ষে অদ্বৈত মল্লবর্মণ: শান্তনু কায়সার অদ্বৈত মল্লবর্মণ জন্ম শতবার্ষিকী স্মারকগ্রন্থ
×