ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৯ মার্চ ২০২৪, ১৫ চৈত্র ১৪৩০

নারীর জীবনে অভিবাসন

প্রকাশিত: ০৬:৪৩, ৮ জানুয়ারি ২০১৬

নারীর জীবনে অভিবাসন

তানিয়া আফরিন তন্বী অভিবাসন বলতে সাধারণত বোঝায় জীবিকা নির্বাহের তাগিদে চাকরি নিয়ে একস্থান থেকে অন্যস্থানে যাওয়া। তা হতে পারে দেশের অভ্যন্তরে, হতে পারে এক দেশ থেকে অন্য দেশে। নারী অভিবাসন বলতে বোঝায় জীবিকার উদ্দেশ্যে চাকরি নিয়ে নারীর একস্থান থেকে অন্যস্থানে যাওয়া। বাংলাদেশের নারীরা সাধারণত গ্রাম থেকে শহরে এবং দেশ থেকে বিদেশে অভিবাসন করে থাকে। দেশের অভ্যন্তরে নারী অভিবাসনকে সহজভাবে নিলেও কোন নারীর চাকরি নিয়ে বিদেশে যাওয়ার কথা শুনলে অনেকেই বলেন- নারীরা বিদেশ যাবে কেন? নারী বিদেশ গেলে দেশে সংসার সন্তানসন্ততি দেখবে কে? নারীদের বিদেশ যেতে নেই। বিদেশ ফেরত নারী ভাল হয় না। নারীরা চাকরি করতে বিদেশ গেলে চরিত্র নষ্ট হয়। তাছাড়া নারী বিদেশ গিয়ে ভাল উপার্জনও করতে পারে না। আর নারী বিদেশ গেলেও শুধু গৃহস্থালি কাজেই যেতে পারে। অর্থাৎ নারীকে তথাকথিত পুনঃউৎপাদনমূলক কাজেই আবদ্ধ দেখতে চায় পুরুষশাসিত সমাজব্যবস্থা। দুঃজনক হলেও সত্য যে, বিদেশ থেকে ফিরে আসার পর পুরুষের তুলনায় নারীদের সামাজিক মর্যাদা কমে যায়। অন্যদিকে পুরুষ বিদেশ গেলে তার সামাজিক মর্যাদা বৃদ্ধি পায়। পুরুষের বিদেশ যাওয়াটাকে একটা সুসংবাদ হিসেবে দেখা হয়; যেখানে একজন নারীকে চাকরি নিয়ে বিদেশে যেতে হয় অনেকটা গোপনে। সম্প্রতি বিশ্বের বিভিন্ন দেশে নারী অভিবাসী কর্মীর চাহিদা বেড়েছে। গত পাঁচ বছরে মোট ১ লাখ ৫৮ হাজার ৮৬২ নারী অভিবাসী কর্মী চাকরি নিয়ে বিদেশে গেছেন। ২০১২-১৩ সালে দেশের মোট ৪ লাখ ৩২ হাজার ৬৯ জন অভিবাসী কর্মী চাকরি নিয়ে বিদেশে গেছেন। এর মধ্যে ২০১২-১৩ সালে মোট নারী অভিবাসীর সংখ্যা ৪৭ হাজার ৭শ ৭৯ জন। ২০১২ সালে মোট ৩৭ হাজার ৩০৭ নারী কর্মী চাকরি নিয়ে বিদেশ গেছেন, যা ২০১১ সালের তুলনায় প্রায় ৭ হাজার বেশি। বলার অপেক্ষা রাখে না যে, এই হার দিন দিন বৃদ্ধি পাচ্ছে। বাংলাদেশী নারীদের অভিবাসনের প্রধান কারণ পরিবারের আর্থিক অনটন। এছাড়া বাড়তি আয় রোজগারের জন্য, ভাল ভবিষ্যতের আশায়, সঞ্চয় করার জন্য, ভালভাবে চলার জন্য, সন্তান অথবা পরিবারের ভালর জন্যই নারীরা বিদেশে যায়। অনেক ক্ষেত্রে সামাজিক কোন সমস্যা, যেমন : যৌতুক কিংবা ডিভোর্স অথবা বিশেষ কোন কারণ যেমন : বিয়ে ভেঙ্গে যাওয়া, বিয়ে না হওয়া, স্বামীর বহুবিবাহ ইত্যাদি কারণে সমাজ থেকে দূরে থাকার জন্য নারী বিদেশে যেতে আগ্রহী হয়। আত্মনির্ভরশীল হওয়ার জন্যও নারীরা চাকরি নিয়ে বিদেশে যেতে চায় এবং চাকরি নিয়ে বিদেশ যাওয়াটা একটি বিশেষ আকর্ষণ হিসেবে কাজ করে বলে নারীরা বিদেশে যায়। একটু লক্ষ্য করলে দেখা যায়, নারী শেষ পর্যন্ত চাকরি করতে বিদেশে যাবে কি যাবে না সে সিদ্ধান্ত দেয় পরিবারের পুরুষ। অধিকাংশ ক্ষেত্রেই এ সিদ্ধান্ত নেয় নারী অভিবাসীর স্বামী, পিতা অথবা ভাই। বিয়ের পর পারিবারিক অসচ্ছলতার কারণে নারীকে বিদেশ যেতে বাধ্য করা হয় কখনও কখনও। অনেক সময় স্ত্রীকে বিদেশে পাঠিয়ে তার পাঠানো টাকায় সচ্ছলভাবে জীবন কাটানোর স্বপ্ন দেখেন পুরুষ, এমনকি স্ত্রীকে বিদেশে পাঠিয়ে স্বামীর পুনরায় বিবাহ করার মতো ঘটনা ঘটছে অহরহ। বিদেশ ফেরত অভিবাসী নারী কর্মীর সংসার ভেঙ্গে যাচ্ছে, এমনকি তাকে একঘরে করে রাখাও হয়। প্রতারিত অর্থাৎ বিদেশে গিয়ে চাকরি না পেয়ে সর্বস্বান্ত হয়ে যেসব নারী দেশে ফিরে আসছেন পরিবার ও সমাজ তাদের সহজভাবে নিচ্ছে না। নারীর বিদেশ থেকে পাঠানো টাকার খরচের নিয়ন্ত্রণও থাকে পুরুষের হাতে। বিদেশ থেকে ফিরে আসার পর নারীর অর্জিত অর্থ নিয়ন্ত্রণ বা ব্যবস্থাপনায়ও নারী একক সিদ্ধান্ত নিতে পারেন না। অভিবাসনের বিভিন্ন ধাপে নারীরা নানা ধরনের সমস্যায় পড়েন শুধু মাত্র নারী হওয়ার কারণেই। যৌন নির্যাতন তার সবচেয়ে বড় উদাহরণ। অভিবাসনে আগ্রহী নারীরা পাচারের শিকার হচ্ছেন অথবা তাদের বাধ্যতামূলক শ্রমে নিয়োজিত করা হচ্ছে। বিদেশে যাওয়ার পথে ট্রানজিট অতিক্রমকালে নানা ধরনের হয়রানির শিকার হচ্ছেন। সুতরাং নারীদের ক্ষেত্রে অভিবাসন ঝুঁকি পুরুষের তুলনায় অনেক। অভিবাসী নারীদের তুলনায় পুরুষ কম নির্যাতিত হয়। নারীদের অভিবাসন-বিষয়ক তথ্য পাওয়ার সুযোগ পুরুষের তুলনায় কম। নারী অভিবাসীদের জন্য প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা কম। বিদেশে গৃহকর্ম পেশা ছাড়া অন্য চাকরিতে নারীদের সুযোগ কম। যে কাজে শ্রমমূল্য বেশি সেই কাজে পুরুষ অভিবাসন বেশি হয় এবং অভিবাসনের ক্ষেত্রে পুরুষের তুলনায় নারীর সুযোগ কম। ফলে পুরুষের তুলনায় নারী অভিবাসনের হার কম। নারী অভিবাসনের হার বৃদ্ধি এবং নারীর জন্য নিরাপদ অভিবাসন নিশ্চিত করার লক্ষ্যে কিছু সুপারিশ উপস্থাপন করা হলো : নারীই শুধু সংসার দেখাশোনা করবে, সন্তান লালন পালন করবে এ ধারণা থেকে বের হয়ে আসতে হবে। বিদেশ গেলেই নারীরা খারাপ হয়, এ ধারণা থেকে বের হতে হবে এবং বুঝতে হবে নারীরাও বিদেশ গিয়ে সংসার ও সমাজের অর্থনৈতিক পরিবর্তনে ইতিবাচক ভূমিকা রাখতে পারে। সমাজে নারী ও পুরুষের সমান অংশীদারিত্ব নিশ্চিত করতে হবে। শুধু পুরুষ নয় নারী অভিবাসী কর্মীকেও সমান সামাজিক মর্যাদা প্রদান করতে হবে। সমাজের সব স্তরে নারী-পুরুষ উভয়ের অংশগ্রহণ নিশ্চিত করতে হবে। নির্দিষ্ট বিষয়ে প্রশিক্ষণ প্রদান করা হলে গৃহস্থালি ছাড়া অন্য পেশাতেও নারী কাজ করতে পারে। ভাল প্রশিক্ষণ ও দক্ষতা অর্জন করে বিদেশ গেলে নারীরা ভাল উপার্জন করতে পারে। নারীদের দক্ষতাভিত্তিক পেশায় কাজ করার সুযোগ বৃদ্ধি করতে হবে। সরকারী ও বেসরকারী পর্যায়ে নারীদের জন্য প্রশিক্ষণ কেন্দ্র বৃদ্ধি করতে হবে ও নারীকে সর্বাগ্রে প্রশিক্ষণ পাওয়ার সুযোগ দিতে হবে। নারীদের বিদেশী ভাষা শিখে বিদেশ যেতে উদ্বুদ্ধ করতে হবে। এ বিষয়ে নারী অভিবাসীদের জন্য সরকারী ও বেসরকারী সহায়তা বৃদ্ধি করতে হবে। বিদেশে সেবামূলক পেশার পাশাপাশি নারীদের জন্য কারিগরি পেশাগুলোতে চাকরি পাওয়ার সুযোগ তৈরি করতে হবে। সম্ভাব্য নারী অভিবাসীকে নিরাপদ অভিবাসন প্রক্রিয়ার সঠিক তথ্য প্রদান করতে হবে। নিরাপদ অভিবাসন-বিষয়ক সচেতনতা বৃদ্ধি করতে হবে। এ বিষয়ে সামাজিক ও পারিবারিক সচেতনতা বৃদ্ধি করা অত্যন্ত জরুরী। যারা অভিবাসনে যাচ্ছেন তাদের সচেতন করতে হবে এবং একজন নারী অভিবাসী হিসেবে বিদেশ যাওয়ার আগে তাদেরও তথ্য পেতে উদ্যোগী হতে হবে, যেমন গন্তব্য দেশ সম্পর্কে জেনে বিদেশে যেতে হবে। বাংলাদেশী এ্যাম্বাসির সঙ্গে কিভাবে যোগাযোগ করতে হবে তা জেনে বিদেশে যেতে হবে। গন্তব্য দেশের আবহাওয়া, পরিবেশ ও খাদ্যভাস সম্পর্কে জেনে যেতে হবে। সে দেশের পোশাক-আশাক কেমন হবে, কেমন করে আচার ব্যবহার করতে হবে সব জেনে যেতে হবে। নিজের নামে অবশ্যই ব্যাংক একাউন্ট করে বিদেশে যেতে হবে। হুন্ডির মাধ্যমে দেশে টাকা পাঠনো যাবে না। বিদেশ থেকে ফিরে এসে টাকা পয়সা দিয়ে আয়বর্ধনমূলক কাজ বা ব্যবসা করতে হবে। বিদেশের অভিজ্ঞতাকে দেশে এসে কাজে লাগাতে হবে। এছাড়া বিদেশ যাওয়ার আগে নিজের বয়স ও কাজ করার সামর্থ্য বিবেচনায় রাখতে হবে। সম্প্রতি সরকারী উদ্যোগে শেষ হলো চাকরি নিয়ে বিদেশ যেতে আগ্রহী নারীকর্মীদের নাম নিবন্ধন। নিজস্ব ইউনিয়ন ও নগর তথ্যসেবা কেন্দ্রে নাম নিবন্ধন করলেন আগ্রহী নারীরা। এ প্রক্রিয়ার মাধ্যমে নির্বাচিতদের প্রশিক্ষণ দিয়ে চাহিদা অনুযায়ী বিদেশে পাঠানো হবে খুব শীঘ্রই। কারিগরি প্রশিক্ষণের পাশাপাশি বিদেশী ভাষা বিষয়ে প্রশিক্ষণ দেয়া হবে তাদের। তবে অভিজ্ঞতা আর পূর্ব প্রশিক্ষণ যাদের রয়েছে তাদের অগ্রধিকার দেয়া হবে। দেশের সাহসী নারী কর্মীদের চাকরি নিয়ে বিদেশ যাওয়া এবং এ বিষয়ে সরকারী উদ্যোগকে যেমন আমরা সাধুবাদ জানাই তেমনি নারী অভিবাসী কর্মীরা যাতে কোন রকম হয়রানি বা প্রতারণার শিকার না হয়ে নিরাপদে বিদেশে যেতে পারে, বিদেশের কর্মস্থলে এবং বাসস্থানে নিরাপদ থাকতে পারে এবং দেশে ফিরে এসে পুনরায় সহজ স্বাভাবিক জীবনযাপন করতে পারে তা নিশ্চিত করতে হবে। আর এ জন্য প্রয়োজন সরকারী-বেসরকারী সমন্বিত উদ্যোগ। শিক্ষার কোন বিকল্প নেই। সবার জন্য শিক্ষা নিশ্চিত করতে হবে। শিক্ষিত জনগোষ্ঠীকে বিদেশের কাজের উপযুক্ত প্রশিক্ষণ দিলে অভিবাসনের হার ও মান দুটোই বৃদ্ধি পাবে বলে আশা করা যায়। সর্বোপরি নারীদের বিদেশে যাওয়াকে ইতিবাচক হিসেবে নিতে হবে এবং নারী অভিবাসীর প্রতি আমাদের মনোভাবের পরিবর্তন আনতে হবে।
×