ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৯ মার্চ ২০২৪, ১৫ চৈত্র ১৪৩০

মোস্তফা তোফায়েল

সৈয়দ হকের ॥ প্রণীত জীবন ॥ আত্মপ্রকৃতি ও আধুনিকতাবাদ

প্রকাশিত: ০৬:৪৭, ৮ জানুয়ারি ২০১৬

সৈয়দ হকের ॥ প্রণীত জীবন ॥ আত্মপ্রকৃতি ও আধুনিকতাবাদ

‘প্রণীত জীবন’ সৈয়দ শামসুল হকের আত্মজৈবনিক উপন্যাস। ঝড়হং ধহফ খড়াবৎং যে বৈশিষ্ট্য ও আবেদনে উ.ঐ. খধৎিবহপব -এর আত্মজৈবনিক উপন্যাস, ‘প্রণীত জীবন’ও সৈয়দ হকের তা-ই। ঝড়হং ধহফ খড়াবৎং এ খধৎিবহপব তাঁর জন্ম, শৈশব, কৈশোর ও বয়োপ্রাপ্ত হয়ে ওঠার তুল্য-মূল্য বর্ণনা দিয়েছেন পল মোরেল নামক এক চরিত্রের আখ্যানে। ‘চেতনাপ্রবাহ তত্ত্ব’ নামে যা বাংলায় অনূদিত- ইংরেজিতে ঝঃৎবধস ড়ভ ঈড়হংপরড়ঁংহবংং- তার প্রয়োগ সৈয়দ হকের ‘প্রণীত জীবনে’ আছে লেখকের উত্তম পুরুষে। সৈয়দ হকের আরও একটি কনফেশনাল সাহিত্য প্রকৃতির উপন্যাসের নাম ‘বনবালা কিছু টাকা ধার নিয়েছিল’। ‘খেলারাম খেলে যা’ একই ধাঁচে লেখা উপন্যাস। এটি তিনি লিখেছেন পঞ্চাশ দশকের শেষ প্রান্তে, রংপুর জেলা পরিষদ ডাকবাংলার দুই নম্বর কক্ষে এক সপ্তাহ অবস্থানকালে। তাঁর হাত ফলবান; তিনি মাটিতে হাত কচ্লালেই ফল ধরে- ‘খেলারাম খেলে যায়’। এটাও আত্মজৈবনিক, আধুনিক। আপাত অশ্লীল ইঙ্গিতপূর্ণ ও কৌতূহল উদ্দীপকে নামকরণটি লেখক পেয়েছিলেন তাঁর আল্মাম্যাটার কুড়িগ্রাম হাই স্কুলের সেকালের ‘সার্ভিস ল্যাট্রিনে’র দেয়ালে, লাল ইটের ভাঙা টুক্রোয় লেখা। আমিও ওই একই হাই স্কুলের ছাত্র ছিলাম, সৈয়দ হকের আঠারো বছর পরে। কুড়িগ্রাম তাঁর ‘স্বর্গাদপী গরীয়সী, অধ্যয়নং তপঃ’। এ গুণে গুণান্বিত তিনি, বাংলা সাহিত্যে আর এক মধুসূদন- ‘সতত হে নদ তুমি, পড়ো মোর মনে’। ‘প্রণীত জীবনে’র শুরুতেই লেখক স্মরণ করেন তাঁর জন্মস্থল কুড়িগ্রাম এবং আবে কাওসার ধরলা নদী। এই ধরলা তাঁর কাছে কখনও ধরলা, কখনও জলেশ^রী। তিনি জলেশ^রীর পাড়ে জীবনযাপন করেন না, জীবনযাপন করেন ঢাকার গুলশানে। কিন্তু জলেশ^রী- ধলেশ^রী নদী তীরের পিসির মেয়ে, ‘ঘরেতে এলো না সে তো, মনে তার নিত্য যাওয়া আসা।’ তিনি শে^তপ্রভা-ধল্লা-ধবলা-ধরলাকে জলেশ^রী নামে ডাকেন, মীথ্ সৃষ্টি করেন। তিনি লেখেন, “১৯৩৭ সালের দিকের কথা, ধরলা তখন ভাঙতে শুরু করেছে ভোগডাংগা, পাটেশ^রীর দিক্টা। পেছনের দিকে হাঁটতে হাঁটতে প্রথম যে স্মৃতি-ছবিটি স্পষ্ট দেখে উঠি, হিসাব করে দেখি সে আমার বছর আড়াই বয়সের। বাবার সঙ্গে দাঁড়িয়ে আছি ধরলা নদীর পাড়ে। বিকেল হয়ে এসেছে। লাল রঞ্জন ধরেছে আকাশে। নদীর পানি বেগুনী। নদী একটি বাঁক নিয়েছে। ফুলে উঠেছে বর্ষার পানিতে। কল্কল্ খল্খল্ করে দুরন্ত স্রোত বয়ে যাচ্ছে নদীর বুকে। আমরা দুজন স্থির দাঁড়িয়ে আছি বর্ষার উম্মত্ত ধরলার পাড়ে। ধরলা গ্রাস করছে মাটি। পাড় ছোটাছুটি করছে। কিন্তু বাবা-ছেলে আমরা দুটি স্থির এবং বিষণœ। কেন বিষণœ? আজ রাতেই আমরা ধরলাপাড়ে আমাদের বাড়ি ছেড়ে চলে যাচ্ছি দক্ষিণে, তখনকার কুড়িগ্রাম শহরের শেষ প্রান্তে। বাড়িটি এখন নদীর কামড়ে থরথর করে কাঁপছে।” দ্বিতীয় মহাযুদ্ধ হয়েছিল ১৯৩৯-৪৫ সালে। কুড়িগ্রামে পড়েছে এই যুদ্ধের অভিঘাত। তিনি লেখেন, “তখন দ্বিতীয় মহাযুদ্ধের কাল। কুড়িগ্রাম ছেয়ে গেছে গোরা সৈনিকে। চারদিকে তাদের ছাউনি, ট্রেঞ্চ; পোস্টাপিস, রেলস্টেশন সবখানেই তারা; স্টেশনমাস্টার বসে আছেন টুলে, আর তাঁরই টেবিলের ওপর পা তুলে সিগারেট ফুঁকছে সাহেব সোলজার; পোস্টাপিসে টেলিগ্রাফের টরেটক্কা চালাচ্ছে গোরা; ডাকবাংলো দখল করে নিয়েছে, ফুলবাগানে তাদের ট্রাউজার শুকোচ্ছে। আমাদের বাড়ির পাশের রাস্তা দিয়ে চলছে মিলিটারি কনভয়; মাথার ওপর বিন্দুর মতো উড়োজাহাজ উড়ে যাচ্ছে। যুদ্ধের জন্য আসাম বরাবর রাস্তা বানানোর ঠিকা পেয়ে নসর মিঞা বড় মানুষ হয়ে পড়েছেন। বাতাসে উড়ছে টাকা।” সেই কুড়িগ্রাম, জলেশ^রী, সৈয়দ শামসুল হকের ‘দেশ’। সৈয়দ হক স্মরণ করেন তাঁর পিতাকে। তাঁর পিতারও পরম প্রিয় পীঠস্থান ছিল ধরলাতীরের কুড়িগ্রাম। তিনিও চিরনিদ্রা যাপন করছেন সেই মাটিতে। “সেই কুড়িগ্রাম যেখানে পরবর্তী জীবনের সবটুকু তিনি কাটিয়েছেন; যার নদী, নিসর্গ, মানুষকে তিনি গভীর ভালোবেসেছেন, যে কুড়িগ্রামে তাঁর পুত্রকন্যা সবার জন্ম হয়েছে, যেখানে তিনি তাঁর বড় ও ছোট ভাইকে এনে বসত করিয়েছেন, মৃত্যুর পূর্বমুহূর্তে আমরা যখন তাঁকে চিকিৎসার জন্য ঢাকা নিয়ে যেতে চেয়েছি, তিনি বারবার বলেছেন, এখান থেকে আমাকে তোরা নিয়ে যাস না, আমরা টিকিটও করে ফেলেছি, যাত্রার সব আয়োজন শেষ, কিন্তু ট্রেন আসার মাত্র আধ ঘণ্টা আগে তিনি, কুড়িগ্রামেই তিনি এখন ঘুমিয়ে আছেন, সেই কুড়িগ্রাম যে কুড়িগ্রাম এখন আমাদের দেশ যে কুড়িগ্রামের মানুষ ও ভূগোল-কাঠামোর ওপর আমি গড়ে তুলেছি আমার গল্প-উপন্যাস-নাটকের প্রধান অঞ্চল-জলেশ^রী।” সৈয়দ হক একটি নাম, বর্তমান বাংলা সাহিত্যের একটি অধ্যায়, একটি ধ্রুবনক্ষত্র। তবে, এই ধ্রুবনক্ষত্র কি শেক্সপিয়ারের জুলিয়াস সিজারের মতোই ধ্রুবনক্ষত্র? ‘অং ভরীবফ ধং ঃযব হড়ৎঃযবৎহ ংঃধৎ?’ তিনি কি উৎধসধঃরপ ওৎড়হু-র জালে নিজেই নিজেকে বন্দী করছেন? হাসনাত আবদুল হাই কালের খেয়ায় মন্তব্য করেছেন, রবীন্দ্রনাথ- নজরুলের পর সৈয়দ শামসুল হকই সেরা। তাঁর সেরা হয়ে ওঠা সার্থক হোক, কামনা করি। আশা করি, রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর যেমন করে নিজ হাতের লেখায় বা শেষ বয়সে তাঁর ব্যক্তিগত সচিবদের হাতে লিখে নিয়ে হাজারো শুভানুধ্যায়ীর কাছে হাজারো চিঠি লিখেছেন, তেমন করে সৈয়দ হকও তাঁর নিজ হাতে অথবা কম্পিউটার যন্ত্রের সাহায্যে চিঠি লিখে ঢাকায় থাকা তাঁর হাজার সমর্থক ও শংসককে ধন্যবাদ জানাতে ভুলবেন না। ফেসবুক নয়; ফেসবুক কোন বুক নয়, সুখও নয়, এ এক অসুখের নাম, সে- অসুখ সময় নষ্ট করার ইষ্টিকুটুম অসুখ। সৈয়দ হক ঢাকা শহরের বড়ো বড়ো বাঘা বাঘা সাংস্কৃতিক ব্যক্তিত্বদের বিশাল বিশাল ব্যানার এবং রাজকীয় বিশেষণে ধন্য হয়েছেন, মহীয়ান গড়িয়ান অজস্র প্রশংসার বন্যায় ভেসেছেন। আমি আশা করি, তিনি শংসা উপহারদাতাদের প্রতি পাল্টা ধন্যবাদের রুমাল উড়িয়ে দিতে ভুলবেন না। ধন্যবাদ জানানোর ভাষাগুলো থেকেই রচিত হবে তাঁর পত্রসাহিত্য, তাঁর ময়ূরপুচ্ছে শোভা পাবে নবতর পাখনাচিত্র। সব্যসাচী তিনি, তাঁর সাহিত্যচর্চার বহুমাত্রিকতায় নতুন মাত্রা যোগ করবে পত্রসাহিত্য, যেমন তাঁর চিত্রকর্ম, অনেকটা রবীন্দ্র অনুসরণে। গ্রাম-বাংলার বহু জেলা ও পল্লীর সঙ্গে তাঁর থাকা উচিত চিত্তযোগ, যেমন আছে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের। সৈয়দ শামসুল হক, জলেশ^রী কুড়িগ্রামের সারস্বত সন্তান। তাঁর আশিতম জন্মদিনে তাঁকে জানাই হাজার হাজার শুভেচ্ছা, লাখো কোটি অর্ঘ ও সম্মান।
×