ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ২৮ মার্চ ২০২৪, ১৪ চৈত্র ১৪৩০

মিথ্যা তথ্যে আইপিও অনুমোদন পেল সোয়েটার কোম্পানি

প্রকাশিত: ০৭:১৩, ১১ জানুয়ারি ২০১৬

মিথ্যা তথ্যে আইপিও অনুমোদন পেল সোয়েটার কোম্পানি

অপূর্ব কুমার ॥ গত এক বছরে বেশ কিছু কোম্পানির আইপিও অনুমোদন দিয়ে সমালোচিত বাংলাদেশ সিকিউরিটিজ অ্যান্ড একচেঞ্জ কমিশন আরও একটি কোম্পানির আইপিও অনুমোদন দিয়েছে আর্থিক প্রতিবেদনে বড় ধরনের অসঙ্গতি থাকা স্বত্ত্বেও। আগামী ১৭ জানুয়ারি থেকে আইপিও আবেদন শুরু করতে যাওয়া বস্ত্র খাতের এই কোম্পানির নাম ড্রাগন সোয়েটার অ্যান্ড স্পিনিং। ২০১৬ সালের প্রথম আইপিও আবেদনের মাধ্যমে ৪০ কোটি টাকা উত্তোলন করতে যাওয়া এই কোম্পানিটি শেয়ার প্রতি আয়ে ভুল তথ্য দিয়ে আইপিও অনুমোদন নিয়েছে। একইসঙ্গে ক্যাশফ্লোতেও বড় ধরনের বিভ্রান্তি রয়েছে। সম্প্র্রতি আইপিও অনুমোদন পেতে কোম্পানির জমা দেওয়া প্রসপেক্টাস যাচাই-বাছাই করে কোম্পানির ইপিএস গণনায় ৫ বছরের মধ্যে তিন বছরেই অসঙ্গতি দেখা গেছে। এ ছাড়া রয়েছে পৃষ্ঠাভেদে ভিন্ন ভিন্ন তথ্য। এছাড়া কোম্পানির নগদ ক্যাশফ্লোতেও রয়েছে নানা সমস্যা। বাংলাদেশ এ্যাকাউন্টিং স্ট্যান্ডার্ড (বিএএস)-৩৩ অনুযায়ি, বোনাস শেয়ার বছরের যে সময়ই ইস্যু করা হোক না কেনো, ইপিএস গণনায় পূর্ণবছরের ধরে হিসাব করতে হয়। কিন্তু কোম্পানি কর্তৃপক্ষ ২০১৩ সালে শেয়ারহোল্ডারদের বোনাস শেয়ার দিলেও তা বাদ দিয়ে ইপিএস গণনা করেছেন। কোম্পানি কর্তৃপক্ষ এভাবে ইপিএস হিসাবের মাধ্যমে ২০১৩ সালে ০.৬৩ টাকা করে ইপিএস বেশি দেখিয়েছেন। দেখা গেছে, ২০১৩ সালে ড্রাগনের ওয়েটেড শেয়ার ছিল ৪ কোটি ১৪ লাখ ৭৭ হাজার ৮৩০টি ও কর পরবর্তী মুনাফা ছিল ৮ কোটি ৬৭ লাখ ৭৬ হাজার ৭৯৫ টাকা। এ হিসাবে বেসিক ইপিএস হয় ২.০৯ টাকা করে। কিন্তু কোম্পানি কর্তৃপক্ষ ২.৭২ টাকা করে ইপিএস দেখিয়েছেন। ২০১১ সালেও বোনাস শেয়ারকে বাদ দিয়ে ইপিএস গণনা করে ড্রাগন কর্তৃপক্ষ। এ বছর ১৯ কোটি ১৪ লাখ ৪০ হাজার টাকার বোনাস শেয়ার দিলেও ইপিএস গণনায় তা বিবেচনায় নেয়নি। যাতে ওই বছরে কোম্পানি কর্তৃপক্ষ ৪.৪৩ টাকা করে ইপিএস বেশি দেখিয়েছেন। প্রসপেক্টাসের তথ্য যাচাই-বাছাই করে দেখা গেছে, ২০১১ সালের কোম্পানিটির ইস্যু করা ওয়েটেড শেয়ার ছিল ২ কোটি ৮৭ লাখ ১৬ হাজার ও কর পরবর্তী মুনাফা ছিল ৬ কোটি ৩৬ লাখ ২৭ হাজার ৫৮৭ টাকা। এ হিসাবে ২০১১ সালে বেসিক ইপিএস হয় ২.২২ টাকা করে। কিন্তু কোম্পানি কর্তৃপক্ষ বোনাস শেয়ারকে বাদ দিয়ে প্রসপেক্টাসের ৯০ পৃষ্টায় ও ২০১১ সালের আর্থিক হিসাবে ৬.৬৫ টাকা করে ইপিএস দেখিয়েছেন। ২০১০ সালেও কোম্পানি কর্তৃপক্ষ ইপিএস গণনায় ভুল করেছে। প্রসপেক্টাসের ১৮ পৃষ্ঠা অনুযায়ি, ২০১০ সালে কোম্পানিটির ইস্যুকৃত ওয়েটেড শেয়ার ছিল ৫৬ হাজার ৪১১টি। ওই বছরে কোম্পানিটির করপরবর্তী মুনাফা হয়েছিল ২ কোটি ৫১ লাখ ৩৭ হাজার ৮৭৫ টাকা। এ হিসাবে ২০১০ সালে বেসিক শেয়ার প্রতি আয় (ইপিএস) হয় ৪৪৫.৬২ টাকা করে। কিন্তু কোম্পানি কর্তৃপক্ষ ভুল হিসাবের মাধ্যমে ১৩৫.১১ টাকা করে দেখিয়েছেন। প্রসপেক্টাসের ১৮ পৃষ্ঠা অনুযায়ী, ২০১০ সালের ৩০ ডিসেম্বর ৯৪ লাখ ৪৪ হাজার শেয়ার ইস্যু করা হয়। এ হিসাবে ২০১০ সালে ৯৪ লাখ ৪৪ হাজার শেয়ার ওয়েটেড করলে ১দিন হিসাবে ২৫ হাজার ৮৭৪টি শেয়ার হয়। কিন্তু কোম্পানি কর্তৃপক্ষ ২০১০ সালের আর্থিক হিসাবে আবার ইপিএস গণনা করতে গিয়ে এই শেয়ারকে ২৬ ডিসেম্বর ইস্যু হিসাবে দেখিয়েছেন। যেখানে ওয়েটেডে ৬দিন হিসাবে ১ লাখ ৫৫ হাজার ২৪৪টি শেয়ার দেখিয়েছেন। অর্থাতে কোম্পানি কর্তৃপক্ষ একই শেয়ার ইস্যুকে প্রসপেক্টাসের পৃষ্ঠাভেদে ভিন্ন তারিখে দেখিয়েছেন। কোম্পানিটি ওয়েটেড শেয়ার গণনায় একেক বছর একেক রকম করেছেন। কোম্পানিটির হিসাব অনুযায়ি, ২০১০ সালের আর্থিক প্রতিবেদনের নোট ২৪এ শেয়ার ওয়েটেড করতে গিয়ে ইস্যু তারিখসহ গণনা করেছেন। কিন্তু ২০১৩ সালে ওয়েটেডে ইস্যু তারিখ বাদ দিয়েছেন। অর্থাত একই বিষয়ে ২০১০ সালে একভাবে তো ২০১৩ সালে ভিন্নভাবে গণনা করেছেন। এ বিষয়ে কোম্পানিটির ব্যবস্থাপনা পরিচালক মোস্তফা গোলাম কুদ্দুসের সঙ্গে যোগাযোগ করলে তিনি বলেন, কোয়ারি নিয়ে মেইল করার জন্য। পরে তাকে ২৯ ডিসেম্বর মেইল করা হয়। পরে তার সঙ্গে আলোচনায় বসলে তিনি জানান, আপনার কোয়ারি অনুযায়ি হিসাবে কিছু ভুল আছে। এর বাইরে তিনি কোন মন্তব্য করেননি। পরে কোম্পানিটির সচিব শাহনেওয়াজ আহমেদ খানের মুঠোফোনে একাধিকবার যোগাযোগের চেষ্টা করেও কোন মন্তব্য পাওয়া যায়নি। উল্লেখ্য, কোম্পানিটি ১০ টাকা অভিহিত মূল্যে ৪ কোটি শেয়ার ছেড়ে পুঁজিবাজার থেকে ৪০ কোটি টাকা সংগ্রহ করবে। পুঁজিবাজার থেকে উত্তোলিত অর্থে কোম্পানিটি কারখানার যন্ত্রপাতি ও যন্ত্রাংশ ক্রয়, ভবন ও আনুষঙ্গিক নির্মাণকাজ, চলতি মূলধন জোগানো এবং আইপিও প্রক্রিয়ার ব্যয় নির্বাহে খরচ করা হবে। কোম্পানিটি ইস্যু ব্যবস্থাপনার দায়িত্বে রয়েছে স্বদেশ ইনভেস্টমেন্ট ম্যানেজমেন্ট লিমিটেড। বাজার সংশ্লিষ্টদের মতে, গত বছরে পুঁজিবাজারে সার্বিকভাবে নেতিবাচক প্রবণতা থাকলেও কমিশন মোট ১১ টি কোম্পানির আইপিও অনুমোদন দিয়েছে। এর মধ্যে কয়েকটি কোম্পানির আইপিও প্রসপেক্টাসে মিথ্যা তথ্য দেওয়ার অভিযোগ ছিল। পরে বিএসইসি সাময়িকভাবে চাঁদা গ্রহণ স্থগিত করে ব্যাখ্যা চায়। ব্যাখ্যা দেওয়ার পরে অবশ্য টাকা উত্তোলন করে কোম্পানিগুলো। লেনদেন চালু হলে অবশ্য কোম্পানিগুলো বিনিয়োগকারীদের নিকট আস্থা হারিয়েছে। ফলে সর্বসান্ত হয়েছে সাধারণ বিনিয়োগকারীরা। এর আগে গত বছরে খুলনা প্রিন্টিং অ্যান্ড প্যাকেজিং লিমিটেড, ফার কেমিক্যাল, সিমটেক্স ইন্ড্রাস্টিজসহ আরও কয়েকটি কোম্পানি মিথ্যা তথ্য দিয়ে আইপিও আবেদন জমা দিয়েছিল। বিভিন্ন গণমাধ্যমে তা প্রচার বা প্রকাশিত হলে সাময়িক স্থগিতাদেশ দেয়ার পরে নিয়ন্ত্রক সংস্থা আইপিও’র চাঁদা গ্রহণের অনুমতি দেয়। অভিযোগ রয়েছে, পুঁজিবাজারে টাকা উত্তোলনের জন্য কোম্পানিগুলোর জমা দেওয়া প্রতিবেদনটি বিএসইসির সংশ্লিষ্ট বিভাগ পর্যাপ্ত তথ্য-উপাত্ত যাচাই-বাছাই না করেই সিদ্ধান্ত নিয়ে থাকে। এর কারণেই ইপিএস গণনা ও ক্যাশফ্লোসহ নানা সমস্যা প্রতিবেদনগুলোতে থেকে গেছে। যা পুঁজিবাজারে বিনিয়োগকারীদের কিছুটা হলেও বিভ্রান্ত করেছে। ওই কোম্পানিগুলো বাজারে আসার পরে শেয়ার দর ধরেও রাখতে পারেনি।
×