ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৯ মার্চ ২০২৪, ১৫ চৈত্র ১৪৩০

পদ্মায় ওঠে ঢেউ

প্রকাশিত: ০৫:৩৭, ১২ জানুয়ারি ২০১৬

পদ্মায় ওঠে ঢেউ

ইতিহাসের কতই না উত্থান-পতন-সৃজনের সাক্ষী সতত প্রবহমান পদ্মা। প্রতিনিয়ত একূল-ওকূল ভাঙ্গাগড়ার জন্য খ্যাত প্রমত্তা পদ্মা। যার আরেক নাম তাই কীর্তিনাশা। কত কীর্তি, কত স্থাপনা, কত জনপদ, কত চাষাবাদের জমিকে সে গ্রাস করেছে তার ইয়ত্তা নেই। রবীন্দ্রনাথের বোট বয়ে চলা পদ্মা। নজরুলের পদ্মার ঢেউ কবির শূন্য হৃদয় পদ্ম নিয়ে যায়। কত কবিতা, কত গান এই পদ্মাকে নিয়ে আজও রচিত হয়। পদ্মার ইলিশের খ্যাতি প্রবহমান। সেই পদ্মা বাধা পড়ছে মানুষের করতলে, প্রযুক্তির যাঁতাকলে। তাতে পদ্মার মহিমা, ইতিহাস ও ঐতিহ্য মলিন হয়ে যাবে, তা নয়। মহাকালের সাক্ষী হয়ে সে সগৌরবে, স্বমহিমায় এগিয়ে নিয়ে যাবে সভ্যতাকে। আর এখানেই নিহিত পদ্মা নদী এবং তার ওপর নির্মীয়মাণ বিশাল পদ্মা সেতু। বাঙালীর স্বপ্নের পদ্মা সেতু নির্মাণের কাজ এগিয়ে চলছে দ্রুত গতিতে। নির্ধারিত সময়ের আগেই নির্মাণ কাজ সম্পন্ন করাকে দৃশ্যত চ্যালেঞ্জ হিসেবেই নেয়া হয়েছে। পদ্মা বহুমুখী সেতু মানেই দক্ষিণাঞ্চলের ২১টি জেলার মানুষের দীর্ঘদিনের স্বপ্ন বাস্তবায়ন। ১৯৯৮-৯৯ সালে এই সেতুর সম্ভাব্যতা যাচাই হয়েছিল শেখ হাসিনার সরকারের আমলে। দ্বিতীয় দফা ক্ষমতায় আসার পর তারা আবার সেতুটি নির্মাণে উদ্যোগী হয়। শুরুতেই পদ্মা সেতু নিয়ে দেশী-বিদেশী নানা ষড়যন্ত্রের মধ্যে আটকে যায় বিদেশী বিনিয়োগ। ষড়যন্ত্রের মুখে একে একে সরে যেতে থাকে দাতা সংস্থাগুলো। এই প্রকল্পে বিশ্বব্যাংক ১০ হাজার কোটি টাকার ঋণ সহায়তার প্রস্তাব দেয়। টাকা ছাড় না দিয়েই দুর্নীতির ষড়যন্ত্রের অভিযোগ আনে বিশ্বব্যাংক। প্রকল্প ঝুলে যাওয়ার অবস্থা যেন তখন। সেতু নির্মাণের জন্য প্রাক-যোগ্যতা দরপত্র মূল্যায়ন পূর্বক পাঁচ দরদাতাকে বাছাই করে তা বিশ্বব্যাংকের অনাপত্তির জন্য পাঠানো হলেও সংস্থাটি তা ঝুলিয়ে রাখে। অজুহাত হিসেবে দাঁড় করায় সম্ভাব্য দুর্নীতির অভিযোগ। যে প্রকল্পে তারা কোন অর্থ দেয়নি, সেই অর্থ নিয়ে দুর্নীতি কিভাবে হয়, সেই প্রশ্ন তুলে সরকারের পক্ষ থেকে প্রতিবাদও জানানো হয়। কিন্তু বিশ্বব্যাংকের এ ‘রাজনীতি’ সরকারকে হতাশ করার বদলে ইচ্ছা পূরণে সাহসী করে তোলে। বিশ্বব্যাংকের অর্থায়ন প্রত্যাহারে সেতুটির ভবিষ্যতকে অনিশ্চিত করে তোলার ক্ষেত্র তৈরি করা হয়েছিল। কিন্তু সরকার নিজস্ব অর্থায়নে সেতু নির্মাণে উদ্যোগী হয়। নিজেদের অর্থে এটা বাংলাদেশের সবচেয়ে বড় প্রকল্প। তবে প্রায় ২৯ হাজার কোটি টাকার পদ্মা সেতু প্রকল্প শুধু দেশীয় বা নিজস্ব অর্থায়নের বিবেচনাতেই নয়, বৈশ্বিক বিবেচনাতেও একটি বড় প্রকল্প। এ ধরনের একটি প্রকল্পের সুষ্ঠু বাস্তবায়ন, ঠিকাদারদের কাজ পর্যালোচনা ও তদারকি এবং সামগ্রিকভাবে এর ব্যবস্থাপনার কাজটি খুবই জটিল ও কঠিন। দেশে বড় কোন কাজ করতে হলে বিদেশীদের কাছে হাত পাততে হবেÑ এ মানসিকতা থেকে দেশের মানুষ বেরিয়ে এসেছে। বিদেশী অর্থের বদলে নিজেদের অর্থে এই সেতু নির্মাণ অনেক গৌরবের। সরকারের পক্ষে সূচিত রাষ্ট্রীয় তহবিলে অনেক সাধারণ মানুষও অর্থ দিয়েছে। শেষ পর্যন্ত নক্সা অপরিবর্তিত রেখে নিজস্ব অর্থায়নেই সেতু নির্মাণের ঘোষণা দেন শেখ হাসিনা। প্রধানমন্ত্রীর এসব সিদ্ধান্ত তখন অনেকের কাছে ‘উচ্চাভিলাষী’ মনে হলেও এখন দেখা যাচ্ছে সঠিক সময়ে সঠিক কাজটিই করা হয়েছিল। পদ্মা সেতু প্রকল্প বাস্তবায়নের বিভিন্ন পর্যায়ে অভিযোগ, পাল্টা অভিযোগ, ঘরে-বাইরে প্রতিবন্ধকতা, উন্নয়নশীল একটি দেশের আর্থিক সীমাবদ্ধতা প্রভৃতি সত্ত্বেও সেতুর কর্মযজ্ঞ কেবল দেশের যোগাযোগ, অর্থনীতি ও উন্নয়নের পথে মাইলফলক হয়ে থাকবে তা নয়, বাঙালীর সামর্থ্যরে উচ্চ মাপকাঠি হিসেবে সেতুটি প্রমত্তা পদ্মার বুকে সগৌরবে মাথা উঁচু করে থাকবে। ঘোষণা করতে থাকবে, আন্তর্জাতিক নানা হিসাব-নিকাশ ও চড়াই-উতরাই পেরিয়ে স্বাধীনতা ছিনিয়ে আনা বাংলাদেশ চাইলে বড় বড় চ্যালেঞ্জ গ্রহণ করতে পারে, ভবিষ্যতেও পারবে। শেখ হাসিনা তাই বলেছেন, বাঙালী জাতিকে আর যেন কেউ কখনও অবহেলা দেখাতে না পারে। কারণ সেই শিক্ষা তারা পেয়ে গেছে পদ্মা সেতু নিয়ে। সেই শিক্ষাই দিয়েছি যে, আমরাও পারি। বাংলাদেশ আর কারও কাছে মাথা নোয়াবে না। পদ্মা সেতু হবে সেই উন্নত মস্তকধারী, যা শেখ হাসিনা ও বাংলাদেশকে গৌরাবান্বিত করবে।
×