ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ১৮ এপ্রিল ২০২৪, ৫ বৈশাখ ১৪৩১

কাল মুদ্রানীতি ঘোষণা

অলস টাকার ব্যবহার ও কর্মসংস্থানের বিষয় গুরুত্ব পাচ্ছে

প্রকাশিত: ০৫:৩৪, ১৩ জানুয়ারি ২০১৬

অলস টাকার ব্যবহার ও কর্মসংস্থানের বিষয় গুরুত্ব পাচ্ছে

রহিম শেখ ॥ বিনিয়োগ ও কর্মসংস্থান বাড়িয়ে প্রবৃদ্ধি জোরালো করার ওপর বিশেষ গুরুত্ব দিয়ে চলতি অর্থবছরের দ্বিতীয়ার্ধের (জানুয়ারি-জুন) মুদ্রানীতি ঘোষণা করতে যাচ্ছে বাংলাদেশ ব্যাংক। নতুন মুদ্রানীতিতে ব্যাংকে অলস পড়ে থাকা টাকার সর্বোত্তম ব্যবহার এবং কর্মসংস্থানের বিষয়টিও গুরুত্ব পাচ্ছে। একই সঙ্গে মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণ ও ঋণের সুদ হার কমানোর ইঙ্গিত আসতে পারে নয়া মুদ্রানীতিতে। বিশেষ করে ক্ষুদ্র-মাঝারি এবং কৃষি খাতে ঋণের প্রবাহ বাড়াতে চায় কেন্দ্রীয় ব্যাংক। আগামীকাল বৃহস্পতিবার কেন্দ্রীয় ব্যাংক গবর্নর ড. আতিউর রহমান নতুন এ মুদ্রানীতি ঘোষণা করবেন। জানা গেছে, নিয়মানুসারে কেন্দ্রীয় ব্যাংক প্রতি ছয় মাস অন্তর আগাম মুদ্রানীতি ঘোষণা করে থাকে। প্রতিবছরে জানুয়ারি এবং জুলাই মাসে এটি ঘোষণা করা হয়। দেশের আর্থিক ব্যবস্থাপনায় মুদ্রানীতি খুবই গুরুত্বপূর্ণ। এর মাধ্যমে পরবর্তী ছয় মাসে অভ্যন্তরীণ ঋণ, মুদ্রা সরবরাহ, অভ্যন্তরীণ সম্পদ, বৈদেশিক সম্পদ কতটুকু বাড়বে বা কমবে তার একটি পরিকল্পনা তুলে ধরা হয়। মুদ্রানীতি চূড়ান্ত করতে অন্যান্য বছরের মতো এবারও বিশিষ্ট অর্থনীতিবিদ, বিশিষ্ট ব্যাংকার, সাবেক গবর্নর, সাবেক মন্ত্রী, বিশিষ্ট সাংবাদিক ও কলামিস্ট, সাবেক অর্থ উপদেষ্টা, সাবেক সচিবসহ মুদ্রানীতি সংশ্লিষ্টদের সঙ্গে পরামর্শ করেছে কেন্দ্রীয় ব্যাংক। আগামীকাল ১৪ জানুয়ারি বৃহস্পতিবার সকাল সাড়ে ১১টায় কেন্দ্রীয় ব্যাংকের জাহাঙ্গীর আলম কনফারেন্স হলে এক সংবাদ সম্মেলনে গবর্নর ড. আতিউর রহমান (জানুয়ারি-জুন) ছয় মাসের মুদ্রানীতির বিষয়ে বিস্তারিত তুলে ধরবেন। এ প্রসঙ্গে বাংলাদেশ ব্যাংকের প্রধান অর্থনীতিবিদ বিরূপাক্ষ পাল জনকণ্ঠকে বলেন, বেসরকারী ও উৎপাদনশীল খাতে ঋণ প্রবাহ গতিশীল করার পাশাপাশি মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণে রাখার কৌশল নেয়া হয়েছে। তিনি জানান, চলতি অর্থবছরের বাজেটের সঙ্গে সঙ্গতি রেখে এই নীতি ঘোষণা করা হচ্ছে। বাজেটে বিনিয়োগ বাড়ানোর নানামুখী যেসব প্রস্তাবনার কথা উল্লেখ করা হয়েছে অর্থ প্রবাহের মাধ্যমে এগুলো উৎসাহিত করা হবে। নতুন মুদ্রানীতিতে বাজারে ঋণের চাহিদা বাড়াতে ঋণের সুদহার কমানোর পদক্ষেপ থাকবে। এর ধারাবাহিকতায় কমবে আমানতের সুদহার। ঋণের চাহিদা সৃষ্টিতে এসএমইর মতো আরও কিছু খাতকে এবার বেছে নেয়া হবে। যেগুলো হবে ফোকাস পয়েন্ট। দেশী-বিদেশী বিনিয়োগ বাড়াতে বিনিময় হারের প্রণোদনা দেয়া হবে। বাংলাদেশ ব্যাংক সূত্রে জানা গেছে, ইতোমধ্যে দেশের ব্যাংকগুলোর প্রধান নির্বাহীরা সম্প্রসারণমুখী মুদ্রানীতি দাবি করেছেন। গত ৫ জানুয়ারি ব্যাংকার্স সভায় তারা তাদের হাতে থাকা অতিরিক্ত তারল্য বিনিয়োগের জন্য সম্প্রসারণমূলক মুদ্রানীতির পক্ষে মত দিয়ে ওই দাবি জানান। তবে বাংলাদেশ ব্যাংক বড় গ্রাহকদের দিকে না তাকিয়ে ছোট উদ্যোক্তাসহ কৃষি খাতে বিনিয়োগের পরামর্শ দিয়েছে ব্যাংকগুলোকে। চলতি অর্থবছরের প্রথমার্ধের মুদ্রানীতিতে বাংলাদেশ ব্যাংক বেসরকারী খাতে ঋণ প্রবৃদ্ধি ১৫ শতাংশ হবে বলে প্রক্ষেপণ করেছিল। তবে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের এই প্রত্যাশা পূরণ হয়নি। বাংলাদেশ ব্যাংকের সর্বশেষ তথ্যানুযায়ী, অক্টোবর শেষে বেসরকারী খাতে ঋণ প্রবৃদ্ধি দাঁড়িয়েছে ১৩ দশমিক ২২ শতাংশ। নবেম্বর এবং ডিসেম্বরেও এই প্রবৃদ্ধি একইরকম বলে জানিয়েছেন বাংলাদেশ ব্যাংকের সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা। তারা বলছেন, বর্তমানে ব্যাংকিং খাতে এক লাখ কোটি টাকার বেশি উদ্বৃত্ত তারল্য রয়েছে। সরকার চলতি অর্থবছরে অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি ৭ শতাংশে উন্নীত করার পাশাপাশি মূল্যস্ফীতি ৬ দশমিক ২ শতাংশে রাখার ঘোষণা দিয়েছে। সর্বশেষ মুদ্রানীতিতে বেসরকারী খাতের রফতানিমুখী শিল্পের জন্য দীর্ঘমেয়াদী ঋণ ব্যবস্থা করতে বাংলাদেশ ব্যাংক ৫০ কোটি ডলারের একটি তহবিল গঠনের ঘোষণা দেয়। সে ঘোষণা অনুযায়ী কেন্দ্রীয় ব্যাংক পুরোটা না পারলেও বিশ্বব্যাংকের সহযোগিতায় ৩৫ কোটি ডলারের একটি তহবিল গঠন করেছে। বাংলাদেশ ব্যাংকের এক উর্ধতন কর্মকর্তা বলেন, এবার নীতি সুদহারে পরিবর্তন আনবে বাংলাদেশ ব্যাংক। রেপো (বাংলাদেশ ব্যাংক থেকে বাণিজ্যিক ব্যাংকের স্বল্পমেয়াদে ধার নেয়ার পদ্ধতি) এবং রিভার্স রেপোর (বাণিজ্যিক ব্যাংক তার অতিরিক্ত তারল্য যে ব্যবস্থায় কেন্দ্রীয় ব্যাংকে রাখে) সুদ হারকে নীতি সুদহার বলা হয়। বর্তমানে রেপোর সুদহার ৭ দশমিক ২৫ শতাংশ এবং রিভার্স রেপোর সুদহার ৫ দশমিক ২৫ শতাংশ। গত ছয় মাসের বেশি সময় কলমানি রেট ৩ থেকে ৪ শতাংশের মধ্যে থাকায় বাণিজ্যিক ব্যাংকগুলো রেপোর মাধ্যমে কেন্দ্রীয় ব্যাংক থেকে কোন অর্থ নেয়নি। বাংলাদেশ ব্যাংকও সম্প্রতি রিভার্স রেপো নেয়া বন্ধ করেছে। জানা গেছে, এবারের মুদ্রানীতি বিনিয়োগের পরিবেশ চাঙ্গা করে কৌশল নেয়া হচ্ছে নতুন উদ্যোক্তা তৈরির। বিশেষ করে ক্ষুদ্র-মাঝারি এবং কৃষি খাতে ঋণের প্রবাহ বাড়াতে চায় কেন্দ্রীয় ব্যাংক। বিনিয়োগ বাড়ানোর কথা বলা হলেও সব খাতে ঢালাও ঋণ যাক, সেটিও বাংলাদেশ ব্যাংক চায় না। ইতোমধ্যে বাংলাদেশ ব্যাংক বড় গ্রাহকদের দিকে না তাকিয়ে ছোট উদ্যোক্তাসহ কৃষি খাতে বিনিয়োগের পরামর্শ দিয়েছে ব্যাংকগুলোকে। এ প্রসঙ্গে বাংলাদেশ ব্যাংকের প্রধান অর্থনীতিবিদ ড. বিরূপাক্ষ পাল বলেন, অন্যান্য বছর জানুয়ারি মাসের শেষের দিকে মুদ্রানীতি ঘোষণা করা হলেও এবার এগিয়ে আনা হয়েছে। মুদ্রানীতি ঘোষণা দেরি হলে এর একটা প্রভাব পড়ে। এ কারণেই এবার সময় এগিয়েছে। তিনি বলেন, বাংলাদেশে এই মুহূর্তে বিনিয়োগ পরিবেশ বিরাজ করছে। আমরা এই পরিবেশটাকে কাজে লাগাতে চাই। নতুন উদ্যোক্তা সৃষ্টির বিষয়টি মাথায় রেখেই নতুন মুদ্রানীতি প্রণয়নের কাজ চলছে। বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর (বিবিএস) সর্বশেষ প্রতিবেদন অনুযায়ী, পয়েন্ট-টু-পয়েন্ট ভিত্তিতে ডিসেম্বরে সাধারণ মূল্যস্ফীতি ৬ দশমিক ১০ শতাংশে দাঁড়িয়েছে যা নবেম্বরের চেয়ে দশমিক শূন্য ৫ শতাংশ বেশি। কেন্দ্রীয় ব্যাংকের কর্মকর্তারাও মনে করেন, চলতি ২০১৫-১৬ অর্থবছরের লক্ষ্যমাত্রা অনুযায়ী বার্ষিক সাধারণ গড় মূল্যস্ফীতি ৬ দশমিক ২০ শতাংশে রাখা সম্ভব হবে। বিবিএসের তথ্যানুযায়ী, ডিসেম্বরে খাদ্য উপখাতে সাধারণ মূল্যস্ফীতি হয়েছে ৫ দশমিক ৪৮ শতাংশ। নবেম্বরে ছিল ৫ দশমিক ৭২ শতাংশ। ডিসেম্বরে খাদ্যবহির্ভূত উপখাতে সাধারণ মূল্যস্ফীতি ৭ দশমিক ০৫ শতাংশ। নবেম্বরে এটি ছিল ৬ দশমিক ৫৬ শতাংশ। অন্যদিকে উদ্যোক্তাদের মতো বাংলাদেশ ব্যাংকও মনে করে গ্যাস, বিদ্যুত ও অবকাঠামোর পাশাপাশি বিনিয়োগের বড় শত্রু উচ্চ সুদ। সুদের হার কমানোর জন্য বিশেষ গুরুত্ব দেয়া হচ্ছে নতুন মুদ্রানীতিতে। এ সংক্রান্ত নতুন ঘোষণাও আসবে।
×