ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৯ মার্চ ২০২৪, ১৪ চৈত্র ১৪৩০

গোয়েন্দা লাগিয়ে কূটনীতিকদের হয়রানির অভিযোগ

পাকিস্তান ভিয়েনা কনভেনশন লঙ্ঘন করছে

প্রকাশিত: ০৫:৫৩, ১৪ জানুয়ারি ২০১৬

পাকিস্তান ভিয়েনা কনভেনশন লঙ্ঘন করছে

কূটনৈতিক রিপোর্টার ॥ ইসলামাবাদ ও করাচীর বাংলাদেশ মিশনের কূটনীতিকদের বিরুদ্ধে এবার নতুন করে ষড়যন্ত্রে মেতেছে পাকিস্তান। দেশটি সেখানের বাংলাদেশ মিশনের কূটনীতিকদের বিরুদ্ধে মিথ্যা অভিযোগ আনার চেষ্টা করছে। বাংলাদেশী কূটনীতিকদের বিরুদ্ধে অপরাধ খোঁজার চেষ্টা করছে দেশটি। এ বিষয়ে ঢাকার পক্ষ থেকে ইতোমধ্যেই ইসলামাবাদের নিকট কড়া প্রতিবাদ জানানো হয়েছে। পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় সূত্র এসব তথ্য জানায়। বাংলাদেশী কূটনীতিক মৌসুমী রহমানকে পাকিস্তান থেকে প্রত্যাহারের পর ইসলামাবাদ ও করাচীর বাংলাদেশ মিশনের কূটনীতিকদের বিরুদ্ধে দেশটি এখন ষড়যন্ত্র শুরু করেছে। বাংলাদেশী কূটনীতিকদের বিরুদ্ধে অপরাধ খোঁজার চেষ্টা করছে পাকিস্তান। সে কারণে বাংলাদেশের ওই দুই মিশনের কর্মকর্তাদের বিরুদ্ধে রীতিমতো গোয়েন্দা কর্মকর্তা নিয়োগ দেয়া হয়েছে। বাংলাদেশের কূটনীতিকরা যেখানেই যাচ্ছেন সেখানেই তাদের পিছে পিছে গোয়েন্দাদের গাড়ি যাচ্ছে। আবার বাংলাদেশী কূটনীতিকদের বাড়ির আশপাশেও গোয়েন্দা নজরদারি বাড়িয়েছে পাকিস্তান। বাংলাদেশের পক্ষ থেকে এ বিষয়ে পাকিস্তানের কাছে কড়া প্রতিবাদ জানানো হয়েছে। পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় সূত্র জানায়, ঢাকায় নিযুক্ত পাকিস্তানের হাইকমিশনার সুজা আলমকে পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে তলব করে এ বিষয়ে কড়া প্রতিবাদ জানানো হয়েছে। সোমবার রাতে পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে সুজা আলমকে তলব করে কড়া প্রতিবাদ জানায় বাংলাদেশ। প্রতিবাদপত্রে বলা হয়, পাকিস্তান ভিয়েনা কনভেনশন লঙ্ঘন করছে। ইসলামাবাদ ও করাচীর মিশনে গোয়েন্দাদের মাধ্যমে বাংলাদেশের কূটনীতিকদের হয়রানি করা হচ্ছে। কোনভাবেই যেন বাংলাদেশের কূটনীতিকদের হয়রানি না করা হয়, সে বিষয়ে পাকিস্তানকে সতর্ক করে দেয়া হয়েছে। সূত্র জানায়, ভিয়েনা কনভেনশন অনুযায়ী যে কোন দেশে কূটনীতিকরা স্বাধীনভাবে চলাফেরা করতে পারে। তাদের কোনভাবেই হয়রানি করার নিয়ম নেই। তবে পাকিস্তান এখন বাংলাদেশী কূটনীতিকদের বিরুদ্ধে নতুন করে ষড়যন্ত্র শুরু করেছে। তারা বাংলাদেশী কূটনীতিকদের বিরুদ্ধে মিথ্যা অভিযোগ দায়ের করার চেষ্টা করছে। এটা কূটনৈতিক শিষ্টাচারবহির্ভূত কর্মকা- বলে মনে করছে বাংলাদেশ। বাংলাদেশী কূটনীতিকদের বিরুদ্ধে পাকিস্তানের এমন আচরণে সেখানের কূটনীতিকদের মধ্যে উদ্বেগ দেখা দিয়েছে। কেননা পাকিস্তান ষড়যন্ত্র করে কূটনীতিদের বিপদে ফেলে দিতে পারে। সে কারণে সেখানের বাংলাদেশ মিশনের কূটনীতিকরা সতর্কতা অবলম্বন করছেন। সূত্র জানায়, পাকিস্তানের কূটনীতিক ফারিনা আরশাদের বিরুদ্ধে জঙ্গী অর্থায়নের বিষয়টি প্রমাণিত হয়। সে কারণে তাকে বাংলাদেশ থেকে প্রত্যাহারের অনুরোধ করা হয়েছিল। তবে পাকিস্তান এখন পাল্টা প্রতিশোধ হিসেবে সেখানের বাংলাদেশ মিশনের কূটনীতিকদের বিরুদ্ধে এমন ধরনের একটি মিথ্যা অভিযোগ আনার চেষ্টা করছে। বাংলাদেশী কোন কূটনীতিকের বিরুদ্ধে এমন ধরনের কোন মিথ্যা অভিযোগ এনে তাকে সেখান থেকে প্রত্যাহার করতে চায় পাকিস্তান। সে অনুযায়ী দেশটির বিভিন্ন গোয়েন্দা সংস্থা বাংলাদেশী কূটনীতিকদের বিরুদ্ধে অভিযোগ আনার চেষ্টা করছে। সূত্র জানায়, গত বছর ২৯ নবেম্বর পাকিস্তানী নাগরিক ইদ্রিস শেখ ঢাকায় গ্রেফতার হন। গ্রেফতারের পর ইদ্রিস শেখ আদালতে দেয়া জবানবন্দীতে বাংলাদেশে জঙ্গী তৎপরতায় ঢাকার পাকিস্তান হাইকমিশনের কর্মকর্তা ফারিনা আরশাদ ও পাকিস্তানের গোয়েন্দা কর্মকর্তা অসীমের জড়িত থাকার বিষয়টি উঠে আসে। ইদ্রিস ১৯৮৫ সালে পাকিস্তানে যান। ১৯৯০ সালে পাকিস্তানী এক নারীকে বিয়ে করে সেখানেই বসবাস করছিলেন। ২০০২ সালে দেশটির ‘পাক-মুসলিম এ্যালায়েন্স’ নামে একটি রাজনৈতিক দলের হয়ে জাতীয় নির্বাচনে অংশ নিয়ে পরাজিত হন। রাজনীতি করার কারণে পাকিস্তানের বিভিন্ন জঙ্গীগোষ্ঠী ও রাষ্ট্রীয় গোয়েন্দা সংস্থাগুলোর সঙ্গে তার যোগাযোগ হয়। পাকিস্তানের রাষ্ট্রীয় গোয়েন্দা সংস্থার কতিপয় উচ্চপদস্থ কর্মকর্তার সঙ্গে বিশেষ সখ্যতাও গড়ে ওঠে। এরপর ২০০৭ সালে বাংলাদেশে এসে ইদ্রিস জেএমবির সঙ্গে যোগ দেন। বাংলাদেশে আসার পর পাকিস্তান হাইকমিশনের কর্মকর্তা ফারিনা আরশাদের সঙ্গে পরিচয় হয় ইদ্রিসের। এরপর তিনি গত দুই বছরে ৪৮ বার বাংলাদেশ-পাকিস্তান যাতায়াত করেছেন। তার প্রধান কাজ ছিল বাংলাদেশে জেএমবির কার্যক্রম বৃদ্ধি করা। জেএমবি সদস্যদের ছোট ছোট দলে পাকিস্তানে পাঠিয়ে উচ্চতর প্রশিক্ষণ দিয়ে আবার বাংলাদেশে ফেরত আনা। মূলত বাংলাদেশে জঙ্গীবাদের বিস্তার ঘটানোর লক্ষ্যেই কাজ করেছিলেন ইদ্রিস। সেই সঙ্গে বাংলাদেশের অর্থনৈতিক মেরুদ- ভেঙ্গে দিতে এবং ভারতের সঙ্গে বাংলাদেশের সুদীর্ঘ দিনের সুসম্পর্ক নষ্ট করতেই পাকিস্তানে তৈরি জালমুদ্রা বাংলাদেশে আনতেন। এসব জালমুদ্রা বাংলাদেশ-ভারত সীমান্ত পথে ভারতে পাঠানো হতো। আর এসব কাজে জড়িত ছিলেন ফারিনা আরশাদ। এসব বিষয়ে সুনির্দিষ্ট অভিযোগের প্রেক্ষিতে বাংলাদেশের পক্ষ থেকে ফারিনা আরশাদকে ঢাকার পাকিস্তান হাইকমিশন থেকে প্রত্যাহারের জন্য বলা হয়। সে অনুযায়ী গত ২৩ ডিসেম্বর পাকিস্তান ফারিনা আরশাদকে প্রত্যাহার করে পাকিস্তানে ফেরত পাঠায়। তবে ফারিনা আরশাদের বিরুদ্ধে সুনির্দিষ্টভাবে জঙ্গী অর্থায়নের অভিযোগ থাকলেও মৌসুমীর বিরুদ্ধে কোন অভিযোগ দাঁড় করাতে পারেনি পাকিস্তান সরকার। ফারিনা আরশাদকে প্রত্যাহারের পাল্টা ব্যবস্থা হিসেবে অযাচিতভাবে পাকিস্তান মৌসুমী রহমানকে প্রত্যাহার করতে বলে। তবে কেন প্রত্যাহার করতে হবে সে বিষয়ে পাকিস্তানের কোন বক্তব্য নেই। এর আগেও গত বছর ১২ জানুয়ারি ঢাকার পাকিস্তান হাইকমিশনের কর্মকর্তা মাজহার খান জালটাকা লেনেদেনে অভিযুক্ত হন। ঢাকা-ইসলামাবাদের মধ্যে দীর্ঘদিন ধরে শীতল সম্পর্ক চলে এলেও যুদ্ধাপরাধীদের বিচারকে কেন্দ্র করে নতুন করে টানাপোড়েন শুরু হয়। যুদ্ধাপরাধী বিএনপি নেতা সালাউদ্দিন কাদের চৌধুরী ও জামায়াতে ইসলামীর নেতা আলী আহসান মুজাহিদের মৃত্যুদ-ে নাখোশ হয়ে গত ২২ নবেম্বর তীব্র প্রতিক্রিয়া জানায় পাকিস্তান। পাকিস্তানের ওই প্রতিক্রিয়ার প্রতিবাদে গত ২৩ নবেম্বর দেশটির ঢাকায় নিযুক্ত হাইকমিশনার সুজা আলমকে তলব করে সরকার। সে সময় পাকিস্তানের হাইকমিশনারকে জানিয়ে দেয়া হয়, পাকিস্তান সরকার সরাসরি এখন বাংলাদেশের অভ্যন্তরীণ বিষয়ে হস্তক্ষেপ করছে। তবে বাংলাদেশের অভ্যন্তরীণ বিষয়ে পাকিস্তান সরকার কোনভাবেই যেন আর হস্তক্ষেপ না করে, সে বিষয়ে তাদের সতর্ক থাকতে বলা হয়। এদিকে ৩০ নবেম্বর ইসলামাবাদে নিযুক্ত বাংলাদেশের ভারপ্রাপ্ত হাইকমিশনার মৌসুমী রহমানকে তলব করে পাকিস্তান সরকার। তাকে তলবের পর ১৯৭১ সালের হত্যাকা-ে সম্পৃক্ততার অভিযোগ অস্বীকার করে পাকিস্তান। তলব ও পাল্টা তলব নিয়ে দুই দেশের কূটনৈতিক সম্পর্কে নতুন করে টানাপোড়েন শুরু হয়। এরই মধ্যে গত ২৩ ডিসেম্বর ঢাকা থেকে পাকিস্তানের কূটনীতিক ফারিনা আরশাদকে প্রত্যাহার করে নেয় দেশটি। ফারিনা আরশাদের বিরুদ্ধে সুনির্দিষ্টভাবে জঙ্গী তৎপরতার সঙ্গে সংশ্লিষ্টতার প্রমাণ দেয় বাংলাদেশ। তারই পাল্টা পদক্ষেপ হিসেবে ইসলামাবাদ থেকে বাংলাদেশের কূটনীতিক মৌসুমী রহমানকে প্রত্যাহারের দাবি জানায় পাকিস্তান। সে কারণে গত ৫ জানুয়ারি মৌসুমী রহমানকে প্রত্যাহার করে নেয় বাংলাদেশ। মৌসুমী রহমানকে সেখান থেকে প্রত্যাহারের পর এখন ইসলামাবাদ ও করাচী মিশনের বাংলাদেশী কূটনীতিকদের বিরুদ্ধে মিথ্যা অভিযোগ আনার চেষ্টা করছে পাকিস্তান।
×