ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৯ মার্চ ২০২৪, ১৫ চৈত্র ১৪৩০

জনসংখ্যার ঝুঁকি বাড়ছে নগর জীবনে;###;১৫ বছরে ঢাকা হবে বিশ্বের ৬ষ্ঠ জনবহুল শহর

গ্রাম ছেড়ে শহরে ছুটছে মানুষ

প্রকাশিত: ০৫:২৬, ৪ ফেব্রুয়ারি ২০১৬

গ্রাম ছেড়ে শহরে ছুটছে মানুষ

হামিদ-উজ-জামান মামুন ॥ শহরে কর্মসংস্থানের সুযোগ, স্বাস্থ্য-শিক্ষাসহ বিলাসবহুল নাগরিক জীবনে আকৃষ্ট হচ্ছে মানুষ। সেই সঙ্গে নানা দুর্যোগে গৃহহারা-নিঃস্ব মানুষরাও পাড়ি জমাচ্ছে শহরে। ফলে ধারণ ক্ষমতার চেয়ে বেশি মানুষের পদভারে ন্যুব্জ হচ্ছে দেশের শহরগুলো। বিশেষ করে রাজধানী ঢাকা। বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর (বিবিএস)-এর সর্বশেষ জরিপে দেখা গেছে ২০১৪ সালে গ্রাম ছেড়ে শহরে আসা মানুষের সংখ্যা দাঁড়িয়েছে ২৮ দশমিক ২ শতাংশে, যা ২০১০ সালে ছিল ২৪ দশমিক ৫ শতাংশ। ফলে জনসংখ্যার ঝুঁকি বাড়ছে শহরগুলোতে। অন্যদিকে বিশ্বব্যাংক বলেছে আগামী ১৫ বছরের মধ্যেই বিশ্বের ষষ্ঠ জনবহুল শহরে পরিণত হবে ঢাকা। ২০১৪ সালে জনসংখ্যার হিসাবে রাজধানী ঢাকা বিশ্বে এগারতম। গ্রামের মানুষ শহরমুখী হওয়ার কারণে ২০৩০ সাল নাগাদ ঢাকা শহরে জনসংখ্যা ২ কোটি ৭৪ লাখে দাঁড়াবে। ২০১৪ সালের তথ্যানুযায়ী ঢাকার জনসংখ্যা ছিল ১ কোটি ৭০ লাখ। ওয়াশিংটনভিত্তিক সংস্থাটির ওয়ার্ল্ড আরবানাইজেশন প্রসপেক্টাস শীর্ষক প্রতিবেদনে এ চিত্র উঠে এসেছে। মঙ্গলবার বিশ্বব্যাংকের ওয়েবসাইটে প্রতিবেদনটি প্রকাশ করা হয়। এ বিষয়ে পরিকল্পনামন্ত্রী আহম মুস্তফা কামাল জনকণ্ঠকে বলেন, গ্রামে অর্থনৈতিক উন্নয়ন করে গ্রামীণ অর্থনীতিকে শক্তিশালী করার প্রচেষ্টা অব্যাহত রয়েছে। মানুষ যাতে কাজ পায়, শিক্ষা, স্বাস্থ্য ও যোগাযোগসহ অন্যান্য সুবিধা পায় সে বিষয়ে সরকার কাজ করে যাচ্ছে। গ্রামীণ উন্নয়নে ইতোমধ্যেই বিভিন্ন প্রকল্প বাস্তবায়ন শুরু হয়েছে। পরিসংখ্যান দিয়ে তিনি বলেন, ১৯৫০ সালে যেখানে ২৭ থেকে ২৮ শতাংশ মানুষ শহরে বসবাস করত, সেখানে আগামী ২০৫০ সালে ৬৫ শতাংশ মানুষ শহরে বসবাস করবে। বাংলাদেশের চিত্রও একই। মানুষকে জোর করে শহরে আসা আটকানো যাবে না। সূত্র জানায়, বাংলাদেশ পরিসংখ্যার ব্যুরোর মনিটরিং দি সিচুয়েশন অব ভাইটাল স্ট্যাটিসটিকস অব বাংলাদেশ-২০১৪ এর প্রতিবেদনটি সম্প্রতি প্রকাশ করা হয়। এতে বলা হয়েছে, পল্লী অঞ্চল হতে শহরে মানুষের স্থানান্তরের হার বাড়ছে। ২০১৪ সালে এ হার ২৮ দশমিক দুই শতাংশ, যা ২০১৩ সালে ছিল ২৭ দশমিক দুই শতাংশ, ২০১২ সালে ছিল ২৬ দশমিক দুই শতাংশ, ২০১১ সালে ছিল ২৩ দশমিক সাত শতাংশ, ২০১০ সালে ছিল ২৪ দশমিক পাঁচ এবং ২০০৯ সালে ছিল ২১ দশমিক নয় শতাংশ। নগর পরিকল্পনাবিদ ড. নজরুল ইসলাম এর আগে জনকণ্ঠকে বলেন, গ্রাম থেকে শহরে বিশেষ করে ঢাকা, চট্টগ্রাম ও সিলেটের মতো শহরে মানুষ আসা কমাতে হলে সামগ্রিক বিকেন্দ্রীকরণ করতে হবে। প্রথমত রাজনৈতিক বিকেন্দ্রীকরণ, যেমন স্থানীয় সরকার ব্যবস্থাকে শক্তিশালী করতে হবে। দ্বিতীয়ত প্রশাসনিক বিকেন্দ্রীকরণ, যেমন জেলা প্রশাসনকে শক্তিশালী করতে হবে। সেই সঙ্গে বিভাগীয় শহরগুলোতে নানা সুযোগ সুবিধা সৃষ্টি করতে হবে। যাতে মানুষকে যে কোন কাজের জন্য শহরমুখী হতে না হয়। তৃতীয়ত অর্থনৈতিক বিকেন্দ্রীকরণ একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। এক্ষেত্রে উপজেলা পর্যায়ে কর্মসংস্থানের সৃষ্টি করতে হবে। শিল্পায়ন গড়ে তুলতে হবে। চতুর্থত মানসম্মত শিক্ষা ও স্বাস্থ্যসেবা উপজেলা পর্যায়ে ব্যাপকভাবে সম্প্রসারণ করতে হবে। উদাহরণ হিসেবে তিনি বলেন, ইউনিয়ন তথ্য সেবা কেন্দ্র গ্রামীণ জীবন উন্নত করতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখছে। এক জায়গায় বসে মানুষ বিভিন্ন বিষয়ে সেবা পাচ্ছে। এরকম বড় ধরনের উদ্যোগ আরও নিতে হবে। তিনি আরও বলেন, গ্রাম থেকে মানুষ শহরে আসবে এটি স্বাভাবিক বিষয়। কিন্তু আমাদের দেশের জন্য তা উদ্বেগজনক। কেননা ঢাকা ও চট্টগ্রামে যদি বেশি লোক বাড়ে তাহলে ভবিষ্যতে ব্যবস্থাপনায় ব্যাপক সমস্যা দেখা দেবে। তাছাড়া নির্মাণ ও পরিবহন শ্রমিক, রিকশা চালক ও ছোট ছোট দোকানদারের এক কথায় অশিক্ষিত বা স্বল্প শিক্ষিত মানুষের কর্মসংস্থান হয়ত হবে। কিন্তু শিক্ষিত মানুষ যারা যে কোন কাজও করতে পারবে না আবার তাদের উপযোগী কর্মসংস্থানের অভাবে শহরে শিক্ষিত বেকারের সংখ্যা বেড়ে যাবে। এটি একটি বড় নগর সমস্যা হিসেবে দেখা দেবে। বিবিএসের প্রতিবেদনে দেখা গেছে, শহর হতে পল্লী অঞ্চলে স্থানান্তরের হার অপরিবর্তিত রয়েছে। এ হার ২০১৪ সালে ৫ দশমিক ১ শতাংশই রয়েছে, যা ২০১৩ সালে ছিল একই, ২০১২ ও ১৩ সালে ছিল ৫ দশমিক ৩ শতাংশ। ২০১০ সালে শহর হতে পল্লীতে স্থানান্তরের হার ছিল সবচেয়ে বেশি ৬ শতাংশ, তার আগের বছর অর্থাৎ ২০০৯ সালে ছিল ৪ দশমিক ৯ শতাংশ। বিশ্বব্যাংকের প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, বিশ্বের দ্রুততম জনসংখ্যা বৃদ্ধির শহর ভারতের রাজধানী নয়াদিল্লী। ২০৩০ সালে জনসংখ্যায় জাপানের টোকিওকে স্পর্শ করবে শহরটি। বিশ্বের ২৩৩টি দেশের তথ্য নিয়ে এ প্রতিবেদন তৈরি করেছে সংস্থাটি। ২০১৪ সালের তথ্যের ভিত্তিতে করে ২০৩০ সালের জনসংখ্যার পূর্বাভাস জানানো হয়েছে এতে। তথ্য অনুযায়ী ২০১৪ সালে জনসংখ্যায় বৃহত্তম শহর ছিল টোকিও (৩ কোটি ৭৮ লাখ)। ২০৩০ সালে এর জনসংখ্যা কিছুটা কমলেও প্রথম স্থানে থাকবে। প্রতিবেদনে ধারণা করা হচ্ছে, সে সময় শহরটির জনসংখ্যা হবে তিন কোটি ৭২ লাখ। তালিকায় দ্বিতীয় অবস্থানে থাকা দিল্লীর জনসংখ্যা আড়াই কোটি থেকে বেড়ে তিন কোটি ৬১ লাখে পৌঁছাবে। ২০৩০ সালে জনবহুল শহরের তালিকায় এর পরে থাকবে যথাক্রমে সাংহাই (৩ কোটি ৮ লাখ), মুম্বাই ২ কোটি ৭৮ লাখ, বেইজিং (২ কোটি ৭৭ লাখ)। এর পরেই থাকবে ঢাকার অবস্থান। ঢাকায় নিযুক্ত বিশ্বব্যাংকের প্রধান অর্থনীতিবিদ ড. জাহিদ হোসেন বলেন, ডেমোগ্রাফিক ও জলবায়ু পরিবর্তন এবং অর্থনৈতিক কর্মকা-ের বিকেন্দ্রীকরণের ব্যর্থতার কারণে ঢাকায় জনসংখ্যার চাপ বাড়ছে। শিল্প কারখানাসহ কর্মসংস্থানের সুযোগ ঢাকাতেই বেশি। দেশের অন্যান্য শহরগুলোতেও কর্মসংস্থানের সুযোগ একেবারেই কম। এজন্য সরকারের অর্থনৈতিক কর্মকা- ঢাকার বাইরে স্থানান্তর করা জরুরী। তিনি বলেন, জলবায়ু পরিবর্তনের ফলে উপকূলীয় অঞ্চলের যে মানুষগুলো বাস্তুহারা হচ্ছে, তারা কর্মসংস্থানের জন্য ঢাকাকেই একমাত্র ভরসাস্থল মনে করে। এ অবস্থা থেকে উত্তরনে সরকারের গৃহীত ১০০টি অর্থনৈতিক অঞ্চল প্রতিষ্ঠা এবং পদ্মা সেতু ছাড়াও গৃহীত অন্যান্য অবকাঠামো উন্নয়ন প্রকল্পগুলো দ্রুত বাস্তবায়নের তাগিদ দেন তিনি। এতে একদিকে রাজধানীর বাইরে কর্মসংস্থানের সুযোগ তৈরি হবে। অন্যদিকে অবকাঠামো উন্নয়নের ফলে রাজধানীর বাইরে থেকে এসে কাজ শেষ করে আবার ফিরে যেতে পারবে। পরিসংখ্যান ব্যুরোর প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, এক শহর থেকে আরেক শহরে মানুষের স্থানান্তরের হারও বৃদ্ধি পেয়েছে। ২০১৪ সালে এ হার দাঁড়িয়েছে ৪৮ দশমিক নয় শতাংশ, যা ২০১৩ সালে ছিল ৪০ দশমিক নয় শতাংশ এবং ২০০৯ সালে ছিল ২৮ দশমিক তিন শতাংশ। অন্যদিকে পল্লী থেকে পল্লীতে মানুষের স্থানান্তরের সংখ্যাও বাড়ছে। কিন্তু সেটি খুব বেশি নয়। ২০১৪ সালের হিসাবে এ হার দাঁড়িয়েছে ২৪ দশকি তিন শতাংশ, যা ২০১০ সালে ছিল ১৬ দশমিক দুই শতাংশ এবং ২০০৯ সালে ছিল ১৪ দশমিক ছয় শতাংশ। শহরমুখী মানুষের স্রোত কমাতে বিশেষ পরিকল্পনা রয়েছে সপ্তম পঞ্চবার্ষিক পরিকল্পনায়। এতে আগামী পাঁচ বছরে দেশের সবগুলো গ্রামে বিদ্যুত পৌঁছে দেয়ার পরিকল্পনা নেয়া হয়েছে। ফলে গ্রামগুলোতে তৈরি হবে কর্মসংস্থানের বিভিন্ন ধরনের সুযোগ। মানুষ শহরে আসছে নিরুসাহিত হবে। এ বিষয়ে ড. আলম বলেন, আগামী পাঁচ বছরে পরিকল্পনার মেয়াদে গ্রামগুলোতে শতভাগ বিদ্যুত পৌঁছে দিতে বিশেষ গুরুত্ব দেয়া হয়েছে। যাতে করে গ্রামভিত্তিক ছোট ছোট শিল্প কারখানা গড়ে উঠতে পারে, মানুষের জীবনযাত্রার মান বৃদ্ধি পায়। গ্রামীণ অর্থনীতিকে আরও বেশি চাঙ্গা করতে নানা বিষয় রয়েছে এ পরিকল্পনায়। এ বিষয়ে পরিকল্পনা কমিশনের সাধারণ অর্থনীতি বিভাগের সদস্য (সিনিয়র সচিব) ড. শামসুল আলম জনকণ্ঠকে বলেন, গ্রাম থেকে শহরে বিশেষ করে ঢাকা, চট্টগ্রাম ও সিলেটের মতো শহরে মানুষ আসা কমাতে হলে সামগ্রিক বিকেন্দ্রীকরণ করতে হবে। এক্ষেত্রে যেটি প্রয়োজন তা হচ্ছে, অর্থনৈতিক বিকেন্দ্রীকরণ একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। এক্ষেত্রে উপজেলা পর্যায়ে কর্মসংস্থানের সৃষ্টি করতে হবে, শিল্পায়ন গড়ে তুলতে হবে। রাজনৈতিক বিকেন্দ্রীকরণ হিসেবে স্থানীয় সরকার ব্যবস্থাকে শক্তিশালী করতে হবে। প্রতিবেদন বিষয়ে এমএসভিএসবি প্রকল্পের পরিচালক এ কে এম আশরাফুল হক বলেন, এ প্রকল্পের মূল উদ্দেশ্য হচ্ছে প্রতি দশ বছর পর পর যে আদমশুমারি হয় তার মধ্যবর্তী বছরগুলোতে জনসংখ্যা বৃদ্ধির উপাদানসমূহ যথা-জন্ম, মৃত্যু, বিবাহ, আগমন, বহির্গমন এবং আর্থ-সামাজিক তথ্য সংগ্রহ, প্রক্রিয়াকরণ এবং নিয়মিতভাবে প্রকাশের মাধ্যমে পরিকল্পনাবিদ ও নীতি নির্ধারকগণকে সুষ্ঠু ও তথ্যভিত্তিক জনসংখ্যা পরিকল্পনায় সহায়তা করা। সূত্র জানায়, সময় সময় শহর থেকে মানুষকে গ্রামে যেতে উৎসাহিত করতে সরকার বিভিন্ন প্রকল্প হাতে নিলেও কার্যকর কোন ফল পাওয়া যায়নি। এর মধ্যে অন্যতম হচ্ছে ঘরে ফেরা কর্মসূচী, ভিক্ষুক পুনর্বাসন প্রকল্প অন্যমত। এ অবস্থায় শহরের ওপর চাপ কমাতে গ্রামের মানুষদের শহরের সুবিধা পৌঁছানোর নতুন করে উদ্যোগ নিয়েছে বর্তমান সরকার। এটি হচ্ছে গ্রামে শহরের নাগরিক জীবনের স্বাদ পৌঁছানোর জন্য সমবায়ভিত্তিক বহুতল ভবন পল্লী জনপদ নির্মাণ সংক্রান্ত প্রকল্প। এটি বাস্তবায়নে মোট ব্যয় ধরা হয়েছে ৪২৪ কোটি ৩৩ লাখ ৭৮ হাজার টাকা। এর মধ্যে সরকারের নিজস্ব তহবিল থেকে ৩৬২ কোটি ৯৮ লাখ এবং সুবিধাভোগীদের ৬১ কোটি ৩৫ লাখ ৭৮ হাজার টাকা। ২০১৪ সালের জুলাই থেকে ২০১৭ সালের জুনের মধ্যে এটি বাস্তবায়নের লক্ষ্য নির্ধারণ করা হয়েছে। পরীক্ষামূলকভাবে ঢাকা, রাজশাহী, চট্টগ্রাম, খুলনা, বরিশাল, সিলেট এবং রংপুর বিভাগের একটি করে মোট ৭টি এলাকায় প্রকল্পটি বাস্তবায়িত হচ্ছে।
×