ঢাকা, বাংলাদেশ   বুধবার ২৪ এপ্রিল ২০২৪, ১০ বৈশাখ ১৪৩১

মুনতাসীর মামুন

বঙ্গবন্ধু হত্যাকাণ্ড ॥ সেনা কর্মকর্তাদের বয়ান

প্রকাশিত: ০৩:৫৬, ৫ ফেব্রুয়ারি ২০১৬

বঙ্গবন্ধু হত্যাকাণ্ড ॥ সেনা কর্মকর্তাদের বয়ান

(৩ ফেব্রুয়ারির পর) শফিউল্লাহ আমাকে টেলিফোন করল, হামিদ, এসব কী হচ্ছে? কে এসব নির্দেশ দিচ্ছে? কার হুকুমে সকালে স্টেশন অফিসার জওয়ানদের মিটিং ডাকা হলো? আমি বহু কষ্টে ব্যাপারটা তাকে বুঝিয়ে মাথা গরম না করতে অনুরোধ করলাম। সে দারুণ বিরক্ত ও উত্তেজিত হলো। তবে পরিস্থিতির কারণে সে পরিবর্তন মেনে নিতে বাধ্য হলো। ওই দিন থেকে শফিউল্লাহ আর অফিসেই এলো না। এভাবে সেনাবাহিনীর নতুন চিফ অব স্টাফের ঝটিকা স্টাইলে গদিটি দখলপর্ব সম্পন্ন হলো। কোনো বিদায় সংবর্ধনা, কোন আনুষ্ঠানিক ডিনার, কোন কিছুরই আয়োজন করা হলো না। জিয়াউর রহমানের সেনাবাহিনীপ্রধান হওয়ার সুবাদে ভবিষ্যতে তার আকাশে ওঠার সোপান তৈরি হয়ে গেল। আলাদিনের যে চেরাগের স্বপ্ন এতদিন ধরে লালন করে আসছিল, আজ তা হাতে এসে ধরা দিল। ১৫ আগস্ট জেনারেল জিয়ার জন্য সৌভাগ্য কাঠি বয়ে আনল। আগস্ট অভ্যুত্থান না ঘটলে জিয়াউর রহমানের উত্থান হতো না। বাংলাদেশের ইতিহাসও অন্যভাবে লেখা হতো। ফারুক-রশীদকে ধন্যবাদ, তারা জিয়ার জন্য খুলে দিল ভবিষ্যতের অবারিত দ্বার।” [পৃ. ১১২-১১৩] শফিউল্লাহ কিন্তু লিখেছেন, তাকে আগেই জিয়ার নিয়োগের কথা জানান হয়েছিল। সুতরাং ধরে নিতে পারি এ বক্তব্য হামিদের অতিরঞ্জন। রাষ্ট্রপতি হওয়ার পর জিয়া হামিদকে বলেছিলেন, “আমি ওদের [রাজনীতিবিদদের] নাকে দড়ি দিয়ে ঘোরাব।” [পৃ. ১২৩] এরপর তিনি একটি বোয়িং বিমান কিনে দেয়ার ঠিকাদারি পান। কিন্তু বিমানের দুই ডিরেক্টর [সেনাবাহিনীর] ও একজন এয়ার মার্শালকে ঘুষ দিতে রাজি না হওয়ায় ডিলটি করতে পারেননি। মূল দামের চেয়ে ১৫% বেশি দামে এরাই বিমান কেনে। জিয়া সব দেখেও কিছু করেননি। এরশাদকে জিয়া সেনাপ্রধান বানাবেন। তার অদক্ষতা, নারীর ও টাকার প্রতি দুর্বলতা সব জানা সত্ত্বেও তাকে সেনাপ্রধান বানান জিয়া। হামিদ এর কারণ জিজ্ঞেস করলে বলেন, “তুই এসব বুঝবি না। এদের মাথায় লাথি মেরে কাজ নিতে সুবিধা হয়। বাঙালিকে লাথি মেরেই কাজ করাতে হয়। মিষ্টি কথায় তারা কাজ করে না। মাথায় চড়ে।” [পৃ. ১৩১] জেনারেল ওসমানীর পেনশন ও অন্য সুযোগ-সুবিধা জিয়া আটকে রেখেছিলেন। হামিদ লিখেছেন, “শফিউল্লাহ, খালেদ মোশাররফও তাকে খুব শ্রদ্ধা করত কিন্তু জিয়া তাকে মোটেই পছন্দ করত না। সেনাবাহিনীর বেশিরভাগ মুক্তিযোদ্ধা সিনিয়র অফিসার ওসমানীকে পছন্দ করতেন না, এর প্রধান কারণ হলো, মুক্তিযুদ্ধের পর পরই এসব অফিসার যেভাবে মুক্তিযুদ্ধের জন্য পদক, সিনিয়রিটি ও লাগামহীন প্রমোশন ইত্যাদি নিয়ে কামড়া-কামড়ি শুরু করেছিলেন, তা তিনি মোটেই পছন্দ করেননি। তিনি তাদের কড়াভাষায় ডিসিপ্লিন ঠিক রাখার কথা বলতেন। এসব কথা মোটেই তাদের পছন্দ হতো না। অপ্রিয় হলেও সত্য কথা বলতে ওসমানী সাহেব কোনোদিন পিছপা হতেন না।” [পৃ. ১৩৭] হামিদের লেখায় জিয়ার চরিত্রটি ভালোভাবে ফুটে উঠেছে এবং জিয়া যে সাত্যিই ষড়যন্ত্রী ছিলেন এটিও ফুটে উঠেছে। শফিউল্লাহ ও এরশাদ সম্পর্কে যা বলেছেন তার সত্যতা শফিউল্লাহই নিরূপণ করতে পারবেন কেননা তিনি এখনও বেঁচে আছেন। বেঁচে আছেন এরশাদও। ॥ ১৪ ॥ উল্লিখিত কর্মকর্তাদের মধ্যে মেজর জেনারেল সৈয়দ মুহাম্মদ ইবরাহিমের আত্মজৈবনিক গ্রন্থ সেনাবাহিনীর অভ্যন্তরে আটাশ বছর। মাওলা ব্রাদার্স ১৯৯৯ সালে গ্রন্থটি প্রকাশ করেছে। গ্রন্থের প্রথম তিন লাইনের মধ্যেই কিন্তু বাংলাদেশের সেনাবাহিনীর বিকাশ, বর্তমান ও ভবিষ্যৎ কী হতে পারে তা নির্দিষ্ট করে দিয়েছেন। “বাংলাদেশ সেনাবাহিনী গড়ে উঠেছে পাকিস্তান সেনাবাহিনীর আদলে। যেমন কিনা বাংলাদেশ সরকারের প্রশাসনিক নিয়মকানুন ও কাঠামো গড়ে উঠেছে পাকিস্তান সরকারের নিয়মকানুনে ও আদলে।” [পৃ. ১১] পাকিস্তানি নিয়মকানুনের ভিত্তি আবার ঔপনিবেশিক আমলের নিয়মকানুন। একটি স্বাধীন দেশ যদি পরিচালিত হয় ঔপনিবেশিক নিয়মকানুন দ্বারা, তাহলে সমাজ রাজনীতিতে দ্বন্দ্ব থেকেই যাবে। সেনাবাহিনী এক্ষেত্রে একটু ব্যতিক্রম। ব্রিটিশ সেনাবাহিনী [১৯৪৭ সালের পূর্ব পর্যন্ত] সিভিল শাসনের অধীনে ছিল, সংবিধান তারা মানত। পাকিস্তান বাহিনী এই অংশটুকু বাদ দেয়। ফলে পাকিস্তান একটি ব্যর্থ রাষ্ট্রে পরিণত হয়। বাংলাদেশ সেনাবাহিনী সেই পাকিস্তানি মডেলই গ্রহণ করেছে। ফলে এর ভবিষ্যৎ সম্পর্কে জানতে পণ্ডিত হওয়ার প্রয়োজন পড়ে না। পাকিস্তান সেনাবাহিনীতে কমিশনপ্রাপ্ত হয়ে তিনি জয়দেবপুরের ইস্টবেঙ্গল রেজিমেন্টে যোগ দেন। সেই ১৯ মার্চের ঘটনা আমাদের মনে আছে। আমরা উদ্বেগাকুল, উত্তেজিত ও উল্লসিত হয়েছিলাম। জনতা সৈন্যদের বাধা দিয়ে অস্ত্র ছিনিয়ে নিয়েছে। ইবরাহিমের লেখায় জানতে পেরেছি, তারা বাঙালী সৈনিকই ছিলেন। এই ছোট একটি ঘটনা কিন্তু তাৎপর্যময়। ২৬ মার্চের পূর্ব পর্যন্ত পাকিস্তান সেনাবাহিনী [সেখানে বাঙালি থাকলেও] জনগণের কাছে ঘৃণিত ছিল। মুক্তিযুদ্ধের মাধ্যমেই প্রথম সাধারণ বাঙালীর মাঝে সেনাবাহিনী স্থান করে নেয়। এর আগে খানিকটা স্থান করে নিয়েছিল ১৯৬৮ সালে আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলায়। ইবরাহিম লিখেছেন, “পরোক্ষ বলুন আর প্রত্যক্ষ বলুন, ১৯ মার্চের ঘটনা মুক্তিযুদ্ধের প্রথম সশস্ত্র অভিব্যক্তি বলে আমার কাছে বিবেচ্য।” [পৃ. ১৪] অতটা না বললেও বলতে পারি [জয়দেবপুর] যতটা মনে পড়ে মেজর শফিউল্লাহর নেতৃত্বেই ইস্টবেঙ্গল রেজিমেন্টের সৈন্যরা প্রথম পাকিস্তানি পক্ষ ত্যাগ করে যুদ্ধে যোগ দেয়। মুক্তিযুদ্ধে তার যোগদান ও প্রাসঙ্গিক বিষয়ে তিনি কোনো স্মৃতিচারণ করেননি। আশ্চর্য যে, অন্য সেনা অফিসারের মতো জিয়ার স্বাধীনতা ঘোষণা সম্পর্কেও তিনি কিছুই লেখেননি। যুদ্ধ শেষে ঢাকায়ই নিয়োগ পান। জহির রায়হানকে তিনিই নিয়ে গিয়েছিলেন মিরপুর। তারপরের ঘটনা সবার জানা। দুঃখ করে লিখেছেন, “৩০ জানুয়ারি বস্তুতই ২য় বেঙ্গল রেজিমেন্ট তথা বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর ইতিহাসে যুগপৎ শোক ও কলঙ্কের দিন।” রক্ষীবাহিনী সম্পর্কেও তিনি মতামত ব্যক্ত করেছেন অন্য সেনা অফিসারদের মতো। তবে তিনি কঠোর কোনো সমালোচনা করেননি। লিখেছেন তিনি-“আমি কিন্তু কোনোক্রমেই রক্ষীবাহিনীর কোনো সদস্যের ব্যক্তিগত সমালোচনা করছি না। ওই সময়ের নীতিগত অবস্থানের বর্ণনা দিচ্ছি মাত্র। সেনাবাহিনীতে আমরা যারা জুনিয়র অফিসার ছিলাম তাদের মনের তখনকার সময়ের আশঙ্কার কথা ব্যক্ত করছি মাত্র। বলতে দ্বিধা নেই, আমাদের মানসপটে রক্ষীবাহিনী একটি প্রতিপক্ষ।” [পৃ.২৮] পাকিস্তানি মানস গঠন যে সেনা অফিসারদের থেকে দূরীভূত হয়নি, তার প্রমাণ রক্ষীবাহিনী সম্পর্কে মনোভাব। রক্ষীবাহিনীতে মুক্তিযোদ্ধাদের অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছিল। রক্ষীবাহিনী থাকলে সেই স্পিরিটটি সব সময় বলবৎ থাকবে এবং পাকিস্তানে যেভাবে সেনাবাহিনী আধিপত্য বিস্তার করে আছে তা সম্ভব হবে না। সুতরাং বঙ্গবন্ধু হত্যার একটি অজুহাত ছিল রক্ষীবাহিনী। সে সময়ের এমন কোনো সেনা অফিসার নেই যাদের রক্ষীবাহিনী সম্পর্কে বিরূপ ধারণা ছিল না। যা হোক সঠিকভাবেই সেই সময়ের মনোভাব তুলে ধরেছেন অকপটে, তিনি সিনিস্টার কিছু খুঁজে পাননি রক্ষীবাহিনীর মধ্যে। লিখেছেন তিনি-“দেশের মধ্য পশ্চিম ও দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলে বেআইনি অস্ত্র উদ্ধার অভিযানে তাদের ব্যাপকভাবে ব্যবহার করা হতো। যে কোনো মূল্যেই হোক, তাদের সফলতাও ছিল। যা হোক, যে গতিতে তখন তাদের ব্যাটালিয়নের সংখ্যা বাড়ছিল, তাতে সেনাবাহিনীর ভিতরে একটা শঙ্কিত মনোভাবের সৃষ্টি হয়। সেনাবাহিনীর সদস্যরা নিজেদের ভবিষ্যৎ নিয়ে মানসিকভাবে কিছুটা হলেও শঙ্কিত বা দ্বিধাগ্রস্ত হয়ে পড়ে।” [পৃ. ২৯] বঙ্গবন্ধু হত্যার পর, “প্রথমত সেনাবাহিনীর সদস্যদের মন থেকে রক্ষীবাহিনী সংক্রান্ত ভীতি বা আশঙ্কা এই ভেবে দূর হয় যে, রক্ষীবাহিনীর অস্তিত্বই বিলুপ্ত হয়ে গেল। চলবে...
×