ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ১৯ এপ্রিল ২০২৪, ৬ বৈশাখ ১৪৩১

অপরাধ জগতের সব উপাদানই এখানে ;###;জন্মনিয়ন্ত্রণের বালাই নেই

বস্তিবাসীর জীবন কাহিনী ॥ সন্ধ্যা হলেই মাদকের আসর

প্রকাশিত: ০৫:২৪, ৫ ফেব্রুয়ারি ২০১৬

বস্তিবাসীর জীবন কাহিনী ॥ সন্ধ্যা হলেই মাদকের আসর

গাফফার খান চৌধুরী ॥ মাদক আমার স্বামীরে কাইড়া নিছে। মাদক সেবন করতে করতেই আমার স্বামী মইরা গেছে। কাইড়া নিছে আমার আর আমার সন্তানের ভবিষ্যত। মাদকের কারণে বস্তির বাসিন্দারা অতিষ্ঠ। এর সূত্রধরে বহু দাঙ্গা-হাঙ্গামা খুন-খারাবিও হয়েছে। বস্তির প্রায় ঘরে ঘরে অশান্তির মূল কারণও মাদক। শুধু বস্তি নয়, মাদক বস্তির আশপাশের পরিবেশ ও ছেলে পেলে নষ্ট হওয়ারও প্রধান কারণ। গোটা সমাজেই এর নেতিবাচক প্রভাব পড়ছে। বস্তিতে নিম্ন আয়ের মানুষের বসবাস করায় অবাধে জনসংখ্যা বাড়ছে। পরিবার পরিকল্পনার বালাই নেই। বস্তিতে বসবাসকারীদের শতকরা ৭৫ ভাগ মানুষ জন্ম নিয়ন্ত্রণ পদ্ধতি গ্রহণ করেন না। এতে দিনকে দিন জনসংখ্যা বেড়েই চলেছে। জনসংখ্যা চাপ সামালাতে সরকারকে প্রতিনিয়ত হিমশিম খেতে হচ্ছে। এমন চিত্র ফুটে উঠল হালে আলোচনায় আসা কল্যাণপুরের পোড়া বস্তির বাসিন্দা পঁয়তাল্লিশ বছর বয়স্ক আসিমন নেছার কথায়। তার বাড়ি জামালপুর জেলার ইসলামপুর থানাধীন ধর্মপুর গ্রামে। তিনি বলছেন, মাত্র কুড়ি বছর বয়সে স্বামীর সঙ্গে এই বস্তিতে এসেছিলাম। নদীতে বাড়ি গিলে খাওয়ার পর উপায়ান্তর না দেখে এখানে এসে উঠি। তখন বস্তিতে তেমন লোকজনই ছিল না। ফাঁকা জায়গা। পাশেই ডোবা। প্রায় সাড়ে পনেরো একর জায়গায় উপস্থিত পোড়া বস্তির বেশিরভাগ জায়গাই পানিতে ভরে ছিল। হাতেগোনা দু’চারটি পরিবার বসবাস করত। দেখতে দেখতে পঁচিশ বছর পার হয়ে গেল এই বস্তিতেই। বস্তিতে রিক্সাচালক, কাজের বুয়া, দোকান কর্মচারী, মেকার, হকারসহ নানা নিম্ন আয়ের মানুষের বসবাস। এখানে আগ থেকেই মাদক ছিল। এখনও আছে। আগে গাঁজার প্রচলন ছিল বেশি। আর বাংলা মদ। আমার স্বামী রিক্সা চালাতেন। সারাদিন রিক্সা চালিয়ে ঘরে ফেরার পর রাতের খাবার দাবার খেয়েই স্ফুর্তি করতে বেরোতেন। তিনি বাংলা মদ খেতেন। ধীরে ধীরে স্বামী মদে আসক্ত হয়ে পড়লেন। এক পর্যায়ে রিক্সা চালানো বাদ দিয়ে সারাদিন মদ খেয়ে পড়ে থাকতেন। সংসার আর চলছিল না। আমি উপায়ান্তর না দেখে বুয়া হিসেবে কাজের পরিমাণ বাড়িয়ে দিলাম। আগে মেসে ৬/৭ জনের রান্না করতাম। এরপর সারাদিনে ৭০/৮০ জনেরও রান্না করেছি। উপায় ছিল না। স্বামীর মদ খাওয়া নিয়ে সংসারে অশান্তি নেমে এলো। একপর্যায়ে স্বামী রাগ করে গ্রামের বাড়ি চলে গেলেন। সেখানেই এক রাতে বিষাক্ত মদ পান করার পর স্বামী মারা যান। আমার দুঃখ আর কে দেখে। চার সন্তানের মধ্যে এক সন্তান গ্রামে। আর তিন সন্তানকে নিয়ে এখানেই পড়ে আছি। এছাড়া আর কোন উপায়ও নেই। তাও শান্তি নেই। ছেলেরা বড় হচ্ছে। ভয় হয়, কখন আবার স্বামীর মতো ছেলেরাও মাদকের দিকে চলে যায়। মাদকের কারণে স্বামী মরে গিয়ে আমাকে আর আমার সন্তানদের মেরে গেছে। অনুসন্ধানে জানা গেছে, এমন পরিস্থিতি বস্তির প্রায় ঘরেই। সন্ধ্যা হলেই মাদকের আসর বসে। মাদক সেবনের পর বস্তিতে হৈচৈ লেগে যায়। মাদকের আসরে যোগ দেয় স্থানীয় মানুষজনও। তারা মাদক সেবনের পর অনেক সময়ই বস্তিতে অসামাজিক কর্মকা-ে লিপ্ত হয়। এছাড়া মাদক আসরে যোগ দেয়াদের মধ্যে ছিনতাইকারী, চোর, ডাকাত, নারী ও শিশু পাচারকারীসহ নানা ধরনের অপরাধীও রয়েছে। এসব অপরাধী নানা ধরনের অপরাধ করার পর বস্তিতেই আত্মগোপনে থাকে। গাড়ি চোরাকারবারি থেকে শুরু করে খুনী পর্যন্ত আত্মগোপনে থাকে বস্তিগুলোতে। ২০১৩ সালে ভাষানটেকে এক স্কুলছাত্রীকে উত্ত্যক্ত করে বস্তির ৫ যুবক। তাতে বাধা দেয় ওই স্কুলছাত্রীর ভাই। এতে ক্ষিপ্ত হয়ে বস্তির ওই যুবকরা এক সন্ধ্যায় ওই স্কুলছাত্রীর ভাইকে ডেকে নিয়ে নির্মমভাবে পিটিয়ে হত্যা করে। হত্যার পর লাশ ডোবায় ফেলে দেয়। গ্রেফতারের পর হত্যাকারীরা জানায়, তারা ইয়াবার নেশার ঘোরে ছিল। বাধা দেয়ায় স্কুলছাত্রীর ভাইকে তারা ডেকে দিয়ে রড দিয়ে পিটিয়ে হত্যা করে। বস্তি ঘিরে নানা অপরাধ ॥ দেশের সব বস্তিতেই মাদকের রমরমা বাণিজ্য রয়েছে। একশ্রেণীর মাদক ব্যবসায়ী বস্তিতে বসবাস করে মাদক ব্যবসা করে থাকে। মাদক বিক্রির জন্য তারা বস্তিকেই বেছে নেয়। গাঁজা, হেরোইন, চরস, আফিম, ভাঙ, ফেনসিডিল ও হালের ইয়াবাও জায়গা করে নিয়েছে বস্তিতে। ইয়াবা এক সময় দামী মাদক ছিল। কিন্তু হালে ইয়াবা যত্রতত্র পাওয়া যাওয়ায় এবং দামে সস্তা হওয়ায় তা বস্তি পর্যন্ত ছড়িয়ে পড়েছে। বর্তমানে ফেনসিডিলের জায়গা দখল করে নিয়েছে ইয়াবা। এসব মাদক বস্তিতে অনেকটা অবাধেই বিক্রি হয়। এর সঙ্গে বস্তির স্থানীয় নিয়ন্ত্রক, প্রভাবশালী চক্র ও স্থানীয় প্রশাসন জড়িত। অনুসন্ধানে জানা গেছে, মাদক ব্যবসায়ী ও স্থানীয় প্রভাবশালীরা টাকা-পয়সা, থাকা ও নগদ টাকার লোভ দেখিয়ে বস্তিবাসীদের নিজেদের অনুকূলে রাখে। কোন সময় আইনশৃঙ্খলা বাহিনী অভিযান চালালে গুজব রটিয়ে বস্তিবাসীদের ক্ষেপিয়ে দেয়। এদের সঙ্গে রয়েছে বিভিন্ন এনজিও। কারণ বস্তি না থাকলে এনজিওর ফান্ড বন্ধ হয়ে যাবে। এছাড়া রয়েছে ভোটের রাজনীতি। যখন যে দল ক্ষমতায় থাকে বস্তিবাসী তাদের কথাই বলেন। এটি তাদের টিকে থাকার কৌশল। বিভিন্ন রাজনৈতিক সমাবেশে লোকের যোগানও আসে বস্তি থেকে। এ জন্য বস্তিবাসী দিন মজুরি হিসেবে টাকা পেয়ে থাকেন। দেশের প্রায় প্রতিটি বস্তি লাগোয়া বিভিন্ন যানবাহনের গ্যারেজ রয়েছে। এসব গ্যারেজে কাজ করা অধিকাংশ শ্রমিকই বস্তির বাসিন্দা। একশ্রেণীর অসাধু ও অপরাধী চক্র এসব গ্যারেজের মালিক। কারণ একদিকে সস্তায় শ্রম পাওয়া যায়। আরেক দিকে চোরাই গাড়ি এসব গ্যারেজে রাখা হয়। বস্তি লাগোয়া গ্যারেজগুলো বিচ্ছিন্ন জায়গায় গড়ে ওঠায় সহজেই এসব গ্যারেজে থাকা চোরাই গাড়ি শনাক্ত করা যায় না। আর যানবাহনের চোরাই মালামাল রাখা হয় বস্তিতে। এতে ধরা পড়ার তেমন কোন সম্ভবনাও থাকে না। এছাড়া সম্প্রতি বস্তিগুলো শিশু ও নারী পাচারকারী চক্রগুলোর টার্গেটে পরিণত হয়েছে। চক্রের সদস্যরা বস্তিতে ঘর ভাড়া নিয়ে নানা এনজিও কার্যক্রমের আড়ালে নারী ও শিশুদের টার্গেট করে। উঠতি বয়সী তরুণীদের ভাল চাকরির লোভ দেখিয়ে বিদেশে পাচার করে দেয়। আবার শিশুদের তারা নানাভাবে পাচার করে থাকে। আবার অনেক পাচারকারী চক্র বস্তিতে গোপন আস্তানা গড়ে তোলে। দেশের বিভিন্ন জায়গা থেকে ওইসব নারী ও শিশুকে বস্তির সেই গোপন আস্তানায় আনার পর সেখান থেকে পাচার করে দেয়। গত বছরের মাঝামাঝি সময়ে এমন ৬ তরুণীকে ভারতের চেন্নাই থেকে উদ্ধারের পর পরিবারের কাছে ফেরত দেয় স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়। পাচারের শিকার তরুণীদের খুলনার একটি বস্তির গোপন ঘরে রাখা হয়েছিল। পরে সেখান থেকে তাদের ভারতের চেন্নাইয়ে ভাল চাকরি দেয়ার নাম করে পাচার করেছিল নারী পাচারকারীরা। বস্তিবাসীর সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, বস্তিবাসীর অধিকাংশ নদীভাঙ্গা মানুষ। এর মধ্যে সবচেয়ে বেশি মানুষ ভোলার। এরপর ফরিদপুরের আর জামালপুরসহ নদীভাঙ্গনপ্রবণ অন্যান্য জেলার মানুষও আছেন। তবে পরিমাণে কম। এমন চিত্র দেশের প্রায় বস্তিতেই। বস্তি থেকে পরিকল্পিত নাশকতার মাধ্যমে সরকারবিরোধী তৎপরতা ॥ বস্তিতে বিভিন্ন সময় সংঘর্ষকালে পরিকল্পিতভাবে আগুন দিয়ে মানুষ হত্যা করা, চুরি ডাকাতি, বোমাবাজিসহ নানা ধরনের অপরাধ কর্মকা- চালায় সরকারবিরোধীরা। তারা সুযোগটিকে কাজে লাগিয়ে সরকারকে রীতিমতো বেকায়দায় ফেলার চেষ্টা করে থাকে। বস্তিকেন্দ্রিক এনজিও, স্থানীয় প্রভাবশালী, মাদক ব্যবসায়ী ও আত্মগোপনে থাকা অপরাধীরা নানাভাবেই বস্তি টিকিয়ে রাখার চেষ্টা করে থাকে। এর জন্য যা যা করা দরকার তার সবাই করায় তারা। ঢাকা সিটি কর্পোরেশন সূত্রে জানা গেছে, সারাদেশের বস্তিতে তৎপরতা রয়েছে অন্তত হাজারখানেক এনজিওর। গড়ে প্রতিটি বস্তিতে অন্তত ১২টি করে এনজিও কাজ করে। একেকটি এনজিও একেকটি বিষয় নিয়ে কাজ করে থাকে। ঢাকা সিটি কর্পোরেশনের সঙ্গে কনসার্ন ওয়ার্ল্ড ওয়াইড নামের একটি প্রকল্পের পরিচালক সৈয়দা রোজেনা আক্তার জনকণ্ঠকে জানান, ঢাকা দক্ষিণ সিটি কর্পোরেশনের মাত্র কয়েকটি বস্তিতে ৭১টি এনজিও কাজ করছে বলে সম্প্রতি আন্তর্জাতিক একটি সংস্থার প্রতিবেদন থেকে জানা গেছে। পানি ও স্যানিটেশন, শিক্ষা ও স্বাস্থ্যসহ নানা বিষয়াদি নিয়ে কাজ করছে এনজিওগুলো। তবে কী পরিমাণ এনজিও বস্তিগুলোতে কাজ করছে তার সঠিক কোন পরিসংখ্যান নেই। বস্তির বাসিন্দাদের বক্তব্য ॥ পোড়া বস্তির বাসিন্দা এনজিও কর্মী রিনা বেগম (৩১) বলছিলেন, যারা বস্তিতে থাকেন তাদের আসলেই কোন থাকার জায়গা নেই। হয়ত হাতে গোনা দু’চারজনের থাকতে পারে। সেটি ভিন্ন বিষয়। তিনি ত্রিশ বছর ধরে বস্তিটিতে বসবাস করছেন। বাড়ি ভোলায়। নদী ভাঙ্গনে বাড়ি হারানোর পর মা-বাবা মোহাম্মদপুরের একটি বস্তিতে আশ্রয় নিয়েছিলেন। আমার জন্মও মোহাম্মদপুরের ঢাল বস্তিতে। এক বছর বয়সে মায়ের কোল চড়ে এখানেই আশ্রয় পাই। বস্তিতে থাকা অবস্থায়ই বিয়ে হয়। সব মিলিয়ে ত্রিশ বছর ধরে বস্তিটিতে বাস করছি। বিয়ে থেকে শুরু করে তিন সন্তানের মা হয়েছি বস্তিতে থেকেই। বস্তির বাসিন্দাদের প্রায় সবাই নদী ভাঙ্গা মানুষ। এমন বক্তব্য মিলেছে বস্তিবাসীর সঙ্গে কথা বলে। বেপরোয়া হারে জনসংখ্যা বাড়ছে বস্তিতে ॥ বস্তিতে বসবাসকারীরা অনেকটা পাখির মতো। আজ এই বস্তিতে তো কাল আরেক বস্তিতে। এরা সবাই ভাসমান মানুষ। এসব বস্তিতে গার্মেন্টস কর্মী, রিক্সাচালক, দোকান কর্মচারীসহ নিম্ন আয়ের পেশার মানুষ বসবাস করেন। এদের বিয়ে বা সংসার করার কোন ঠিক ঠিকানা নেই। দু’চার বছর বস্তিতে বসবাসকালে একাধিক বিয়ে করছেন। বিয়ের পর অনেক সন্তানাদি হয়। কারণ এরা পরিবার পরিকল্পনার ধারও ধারে না। এরপর স্বামী-স্ত্রীর সঙ্গে হয়ত কোন একদিন ঝগড়ার সূত্রধরে স্বামী অন্যত্র চলে যায়। তাদের আর হদিসও মেলে না। কারণ কিছু ভাসমান মানুষ আছে, যারা বস্তিতে নিজের আসল পরিচয় গোপন রেখে অসৎ উদ্দেশ্যে বসবাস করে থাকে। আর বস্তিতে কে কী পরিচয়ে বসবাস করছে তা যাচাই-বাছাই করার কোন সুযোগ নেই। এসব মানুষের কারণে দিন দিন দেশের জনসংখ্যা বৃদ্ধি পাচ্ছে। বস্তিতে বসবাসকারীদের মধ্যে শতকরা ৭৫ ভাগ মানুষ জন্ম নিয়ন্ত্রণ পদ্ধতির বাইরে। কিছু কিছু এনজিও বিষয়টি নিয়ে কাজ করে। কিন্তু তা খুবই সীমিত পরিসরে। বেশিরভাগ বস্তিবাসীই জন্ম নিয়ন্ত্রণ পদ্ধতি গ্রহণের পেছনে কোন প্রকার টাকা খরচ করতে রাজি নয়। তারা মনে করে সন্তানাদি বেশি হলে ক্ষতি নেই। অনেক সন্তান হলে তারা বড় হয়ে রোজগার করে তাদের খাওয়াবে পরাবে। ফলে বস্তিতে হু হু করে জনসংখ্যা বাড়ছে। একাধিক বিয়ের কারণে এক সময় সংসারে অশান্তি শুরু হলে পিতা বা মাতা আলাদা হয়ে যায়। কোন একদিন হয়ত দেখা যায়, পিতা রাতের আঁধারে বস্তি ছেড়ে পালিয়ে গেছে। তার আর হদিস মেলে না। কারণ এ ধরনের ভাসমান বাসিন্দাদের বেশিরভাগই নিজের পরিচয় গোপন করে বস্তিতে বসবাস করে। যতদিন সুযোগ সুবিধা থাকে, ততদিন বাস করে। এরপর হাওয়ায় মিলিয়ে যায়। এসব সংসারে জন্ম নেয়া সন্তানরা পিতামাতার আদর ভালবাসা বলতে তেমন কিছুই পায় না।
×