ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৯ মার্চ ২০২৪, ১৫ চৈত্র ১৪৩০

বায়ান্ন বাজার তিপ্পান্ন গলি

প্রকাশিত: ০৫:২৮, ৫ ফেব্রুয়ারি ২০১৬

বায়ান্ন বাজার তিপ্পান্ন গলি

মোরসালিন মিজান ॥ ভাষার মাস ফেব্রুয়ারি। এ মাসে উৎসব অনুষ্ঠান বেশি থাকে। এরই মাঝে নানা আয়োজনে মুখরিত হয়ে ওঠেছে ঢাকা। বায়ান্ন বাজার তিপ্পান্ন গলির শহর প্রাণ পেয়েছে নতুন করে। বিশেষ করে বাংলা একাডেমি ও সোহরাওয়ার্দী উদ্যান মুখরিত। দুই ভেন্যুতে চলছে অমর একুশে গ্রন্থমেলা-২০১৬। বাঙালী প্রাণের মেলায় যোগ দিতে প্রতিদিনই আসছেন বইপ্রেমীরা। এবার একেবারে শুরু থেকেই পাঠক সমাগম বেশি। সে তুলনায় অনেক পিছিয়ে আয়োজক বাংলা একাডেমি। মেলা তারা শুরু করেছেন বটে! অনেক কাজ এখনও বাকি। নীতিমালা অনুযায়ী উদ্বোধনের আগেই সমস্ত প্রস্তুতি সম্পন্ন করতে হবে। হওয়ার কথা। অথচ এর কোন লক্ষণ নেই। কাজকর্ম চলছে কচ্ছপ গতিতে। নীতিমালার ধার ধারছেন না কেউ। যে যার মতো চালাচ্ছেন। পদে পদে অব্যবস্থাপনা। একাডেমি চত্বর ও সোহরাওয়ার্দী উদ্যান ঘুরে অনেকেই অবাক। চার দিন পর মেলার এমন অগোছালো চেহারা- ভাবা যায় না। এবার শুরুটাই হয়েছিল নীতিমালা উপক্ষো করে। লটারির মাধ্যমে নির্ধারিত হওয়া যায়গায় স্টল সাজাননি অনেক প্রকাশক। সোহরাওয়ার্দী উদ্যানের পেছনের দিককার স্টল চলে গেছে একেবারে সামনে। এতে সংশ্লিষ্ট প্রকাশকরা খুশি বটে। অন্যরা ক্ষোভ প্রকাশ করছেন মেলা শুরুর আগের দিন থেকেই। শ্রাবণ প্রকাশনীর স্বত্বাধিকারী রবিন আহসান এ প্রসঙ্গে যারপরনাই সরব। মাঠের একেবারে শেষপ্রান্তে স্টল পেয়েছেন তিনি। বললেন, আমি তো মেনে নিয়েছি। অথচ অন্য অনেকেই স্টল নিয়ে সামনে চলে গেছেন। এটা বিশৃঙ্খলা। একুশের মেলায় আগেও একটু-আধটু অনিয়ম হয়েছে। তাই বলে এত নিচে নামলে হয় না। এজন্য তিনি একাডেমির মহাপরিচালক শামসুজ্জামান খানকে দায়ী করেন। একই রকম অভিযোগ করে অনিন্দ্য প্রকাশের স্বত্বাধিকারী আফজাল হোসেন বলেন, আমরা সামনে চলে গেলে সমালোচনা শুরু হয়ে যেত; তাই যাইনি। নিজের বই প্রকাশ ও ব্যক্তিগত সম্পর্ক বিবেচনায় মহাপরিচালক পেছনের স্টলগুলো সামনে নিয়ে গেছেন বলে অভিযোগ করেন এই প্রকাশক। মেলার ব্যবস্থাপনা নিয়ে অবশ্য কারও অভিযোগ করার দরকার হয় না। সবই চোখের সামনে ঘটছে। চতুর্থ দিন বৃহস্পতিবার একাডেমি চত্বরে ঢোকার আগেই কানে আসছিল পেরেক ঠুকার শব্দ। করাত চলছিল। শ্রমিকরা যে যার মতো ব্যস্ত। গ্রামের বাড়ির ওঠোনের মতো মেঝেতে যন্ত্রপাতি ছড়িয়ে রেখেছেন। বাংলাদেশ টেলিভিশনের একটি স্টল নির্মাণের দৃশ্য দেখে মনে হলো, মেলা আরও দুই দিন পর শুরু হবে। চত্বরের একেবারে কেন্দ্রে একটি গাছ। গাছের একপাশে নজরুল ইনস্টিটিউটের স্টল। সেখানে বই সাজানো। পাঠক ভিড়তে পারছেন না। কারণ গাছের ঠিক উল্টো পাশে চলছে আরেকটি স্টল নির্মাণের কাজ। অনেকটা জায়গাজুড়ে প্লাইউড ফেলে রাখা হয়েছে। খোঁজ নিয়ে জানা যায়, নির্মিতব্য স্টলের মালিক মেট্রোপলিটন পুলিশ। স্পন্সর প্রতিষ্ঠানের স্টল আগেও ছিল। কিন্তু এক কিনারে, পুকুর পাড়ে। এবার সেটি কেন্দ্রে স্থানান্তরিত হয়েছে। সুসজ্জিত স্টলের পাশেই বালির বড় স্তূপ। অনেক বাঁশ এলোমেলো পড়ে আছে। এ চত্বরের একেবারে প্রাণ যে জায়গাটিকে বলা হয়, সেখানে একটি ন্যাংটো বাড়ির কাঠামো! খোঁজ নিয়ে জানা গেল, এটি মিডিয়া সেন্টার হবে! মেলা শুরুর চতুর্থ দিনেও মিডিয়া সেন্টার না হওয়ার ঘটনা নতুন বৈকি! তার চেয়ে বড় কথা এ অর্ধসমাপ্ত মিডিয়া সেন্টার জায়গাটার সৌন্দর্য এমনভাবে নষ্ট করছে যে, না দেখতে চাইলেও চোখ চলে যায়। তখন বিচ্ছিরি একটা বোধ হয়। সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে প্রবেশ করেও দেখা যায় অভিন্ন দৃশ্য। হাতের বাম পাশে পুলিশ কন্ট্রোল রুম। কাজ চলছে এখানে। পাশে ইভেন্টটাচের অফিস। অফিস মানে, ন্যাংটো বাড়ির কাঠামো। চলছে ঠুকঠাক। এখান থেকে কয়েক পা এগোলে আবারও ঠুকঠাক। একটি গাছ মাঝখানে রেখে বেশ কয়েকজন শ্রমিক কাজ করছেন। তাদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেল, শিশুদের খেলাধুলার জন্য জায়গাটি প্রস্তুত করছে সিসিমপুর কর্তৃপক্ষ। আজ শুক্রবার শিশুপ্রহর অনুষ্ঠিত হবে। তার ঠিক আগের দিন বৃহস্পতিবার মনে পড়েছে, এখানে কিছু কাজ বাকি! বাংলা একাডেমির প্যাভিলিয়নের পাশে তো ভাগাড়ের মতো অবস্থা। বাঁশ-বেতসহ ইত্যাদি পরিত্যক্ত খড়কুটো দিয়ে উঁচু ডিবির মতো করে রাখা হয়েছে। কোন কোন স্টলে চলছে রং করার কাজ। রঙের বড় বড় ডিবি খুলে ছড়িয়ে রাখা। রাতে উদ্যানের পুরোটাজুড়ে আলোর ব্যবস্থাও করা সম্ভব হয়নি। পাঠকের আসা-যাওয়ার মধ্যেই চলছিল বৈদ্যুতিক তার টানার কাজ। মেলার নিরাপত্তা নিয়ে প্রচুর কথা হয়েছে। এখনও নিরাপত্তা খুব জরুরী ইস্যু। হ্যাঁ, সর্বত্র পুলিশ সদস্যদের বিচরণ। চেয়ার নিয়ে বসে থাকা। এরপরও নিরাপত্তা কতটা নিশ্চিত করা গেছে? উত্তর খোঁজতে গিয়ে পিলে চমকে যাওয়ার মতো অবস্থা হয়। স্বাধীনতা স্তম্ভের কাছাকাছি অংশের বেড়া দুই জায়গায় খোলা। টিন ও স্বচ্ছ প্লাস্টিকের বেড়ার সংযোগস্থল দিয়ে একসঙ্গে দুইজন মানুষ যাতায়াত করতে পারে। করছেনও। বেশ কিছু সময় এখানে দাঁড়িয়ে থেকে দেখা যায়, পুলিশ সদস্যরা তাদের মতো বসে আছেন। ঠিক পেছন দিয়ে বিনা বাধায় মেলায় প্রবেশ করছে পথশিশু ছেলে-ছোঁকরা। টোকাই ও হেরোইনসেবীরা অবাধে ঢুকছে। বের হচ্ছে। জায়গাটি থেকে গুনে ১০-১৫ হাত দূরে ‘শুদ্ধস্বর’র স্টল। মৌলবাদী আক্রমণে এ প্রকাশনা প্রতিষ্ঠানের স্বত্বাধিকারী টুটুল মরতে মরতে বেঁচে গেছেন। এখন বিদেশে। তার অনুপস্থিতিতেও বই প্রদর্শিত হচ্ছে। কিন্তু নিরাপত্তা কোথায়? আয়োজকরা ভাল বলতে পারবেন। এছাড়া সোহরাওয়ার্দী উদ্যানের এখানে ওখানে শুকনো মাটির দলা। পায়ের নিচে গড়াগড়ি খাচ্ছে। একটু ভুল করলেই বিপদ ঘটতে পারে। খোঁজ করলে চোখে পড়বে আরও অনেক অসঙ্গতি। চার দিন পরও এত অসঙ্গতি। কেন? জানার জন্য একাডেমির মহাপরিচালকের সঙ্গে যোগাযোগের চেষ্টা করা হয়। কিন্তু তিনি কলকাতায় অবস্থান করায় কথা বলা যায়নি। এ প্রসঙ্গে মেলা পরিচালনা কমিটির সদস্য সচিব ড. জালাল আহমেদ জনকণ্ঠকে বলেন, মেলা আগের চেয়ে অনেক বড় হয়েছে। পরিসর বেড়েছে। এজন্য কাজও অনেক। এখনও পুরোপুরি শেষ করা যায়নি। কিছু কিছু অসঙ্গতি হয়ত চোখে পড়ছে, কয়েক দিনের মধ্যে এগুলো থাকবে না। অনেক কাজ ইভেন্ট ম্যানেজমেন্টের দায়িত্বে থাকা প্রতিষ্ঠানটির উল্লেখ করে তিনি বলেন, সব তো আসলে আমরা দেখে পারি না। এরপরও মেলা সফল করতে একাডেমি সব ধরনের চেষ্টা অব্যাহত রাখবে বলে জানান তিনি। নতুন বই ॥ মেলার চতুর্থ দিনেও এসেছে অনেক নতুন বই। শুধু বাংলা একাডেমির তথ্য কেন্দ্রে জমা পড়া নতুন বইয়ের সংখ্যা ছিল ৯৩। মেলামঞ্চের আয়োজন ॥ মেলা মঞ্চে অনুষ্ঠিত হয় ‘বাংলা একাডেমির হীরকজয়ন্তী : গবেষণা কার্যক্রম, অতীত থেকে বর্তমান’ শীর্ষক আলোচনা। মূল প্রবন্ধটি ছিল ড. আবুল আহসান চৌধুরীর। আলোচনা করেন অধ্যাপক মনসুর মুসা, ড. ভূঁইয়া ইকবাল, ড. আমিনুর রহমান সুলতান। সভাপতিত্ব করেন ড. মনিরুজ্জামান। প্রবন্ধে বলা হয়, প্রতিষ্ঠার পর থেকে ষাট বছর যাবত বাংলাভাষা, সাহিত্য, সংস্কৃতিসহ প্রাসঙ্গিক বিষয়ে বাংলা একাডেমি অসাধারণ সব গবেষণাকর্ম সম্পাদন করেছে। সাম্প্রতিক সময়ে একাডেমির গবেষণাকার্যে নতুন গতি সঞ্চার হয়েছে। দুই খ-ে প্রকাশিত ‘প্রমিত বাংলাভাষার ব্যাকরণ’ এর কল্যাণে বাংলাভাষার বিজ্ঞানসম্মত প্রামাণ্য ব্যাকরণের অভাব মোচন হয়েছে। চার খ-ে প্রকাশের পরিকল্পনা রয়েছে ‘বাংলা ও বাঙালীর ইতিহাস’ গ্রন্থমালার। এখন পর্যন্ত মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক খ-ের চারটি পর্ব প্রকাশিত হয়েছে। আরেকটি প্রকল্পের অধীনে ‘বাংলাদেশের লোকজ সংস্কৃতি গ্রন্থমালা’ প্রকাশিত হচ্ছে। এর মধ্য দিয়ে বাংলাদেশের লোকসংস্কৃতির একটি পূর্ণচিত্র লাভ সম্ভব হবে। চার খ-ে পরিকল্পিত রবীন্দ্রজীবনীর দুটি খ- প্রকাশিত হয়েছে। আলোচকরা বলেন, প্রতিষ্ঠার শুরুতে মূলত গবেষণার দিকে মূল ঝোঁক থাকলেও ক্রমেই জনপ্রত্যাশার আহ্বানে বাংলা একাডেমি বহুমুখী কাজের সঙ্গে নিজেকে যুক্ত করেছে। ফলে একাডেমির প্রকৃত গবেষণা কার্যক্রম মাঝে মধ্যে ব্যাহত হলেও আমরা একাডেমির কাছ থেকে বিচিত্রমাত্রিক সৃষ্টিকর্ম উপহার পেয়েছি। তারা বলেন, দেশের তরুণ গবেষকদের বাংলাভাষা ও সাহিত্য-গবেষণায় আকৃষ্ট করার জন্য বাংলা একাডেমির একটি নতুন গবেষণা-পরিকাঠামো তৈরি করা প্রয়োজন। বঙ্গবিদ্যাচর্চার প্রতি ভবিষ্যত প্রজন্মকে যুক্ত করার বিষয়টি এখন হীরকজয়ন্তী পেরিয়ে বাংলা একাডেমির জন্য প্রধান চ্যালেঞ্জ। সন্ধ্যায় সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানে সঙ্গীত পরিবেশন করেন শিল্পী সাদী মহম্মদ, খায়রুল আনাম শাকিল, ফেরদৌস আরা, রাহাত আরা গীতি, মহিউজ্জামান চৌধুরী এবং নার্গিস চৌধুরী। আজ শিশুপ্রহর ॥ আজ শুক্রবার মেলার শিশুপ্রহর। শুরু হবে বেলা ১১টায়। চলবে রাত ৮টা পর্যন্ত। শিশুদের অভিভাবকসহ স্বাচ্ছন্দ্যে বই কেনার সুবিধার্থে শিশুপ্রহর ঘোষণা করা হয়েছে।
×