ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ২৮ মার্চ ২০২৪, ১৪ চৈত্র ১৪৩০

সুরাইয়া ফারজানা

ভেনিস ॥ কুইন অব এ্যাড্রিয়াটিক

প্রকাশিত: ০৫:৩৯, ৫ ফেব্রুয়ারি ২০১৬

ভেনিস ॥ কুইন অব এ্যাড্রিয়াটিক

(পূর্ব প্রকাশের পর) প্রথম দর্শনেই ইতিহাস ও ঐতিহ্যের জীবন্ত মিউজিয়াম বলে খ্যাত ভেনিস দেখে অভিভূত হয়ে গেলাম। সামনেই টলটলে সবুজ রঙ্গের পানিতে টইটম্বুর গ্রান্ড ক্যানাল। এই খাল ঘিরে রয়েছে মনোরম সব প্রাসাদ, সেতু আর সরু সরু কিছু খাল। মূল খালের সঙ্গে সংযুক্ত এসব ছোট ছোট খাল সর্পিলগতিতে এঁকেবেঁকে এই প্রাচীন নগরের ভেতরে প্রবেশ করেছে। পো এবং পিয়াভ এই দুই নদীর মোহনায় অবস্থিত ভেনিস আর্কিপেল্যাগো ১১৭টি দ্বীপের ১৭৭টি খাল আর ৪০৯ খানা সেতু দ্বারা আবদ্ধ। আমরা খালের পাশ দিয়ে হাঁটতে লাগলাম। কিছুদূর এগিয়ে মূল খালের ওপর সেতুটিতে গিয়ে উঠলাম। সেতুর পশ্চিম দিকে নতুন আর পূর্ব দিকে পুরাতন ভেনিস। এই পুরাতন ভেনিস বিস্তৃত হয়ে এ্যাড্রিয়াটিকের সাগরের নিকট পো এবং পিয়াভ নদীর মোহনায় মিশেছে। খালের ওপর বড় বড় কাঠের খাম্বা মাথা তুলে দাঁড়িয়ে আছে। জলে তার ঈষৎ বক্র ছায়া পড়েছে। আমরা খালের ওপাশে কিছু গন্ডোলা দেখতে পেলাম। এগুলো প্রদর্শনের জন্য রাখা। লাল আর গাঢ় নীল মখমলের সিট, পার্সি কার্পেট মোড়ানো নৌকাগুলো ভেনিসবাসীদের শৌখিনতার সাক্ষ্য দেয়। ছোট ছোট কিছু নৌকা আছে যেগুলোর নাম স্যান্ডোলা। ভেনিসবাসীর উৎসব- পার্বণের নিত্যসঙ্গী এসব গন্ডোলা ও স্যান্ডোলা। বিয়ে, শেষকৃত্যসহ বিভিন্ন অনুষ্ঠানে এগুলোর ব্যবহার হয়। আমি মস্ত্রমুগ্ধের মতো খালের দিকে চেয়ে আছি, আর পলাশ ক্রমাগত শাটার টিপেই চলেছে। খেয়াল করলাম, সামনেই তিনজন ভেনেসি যুবকের একটা জটলা। ওরা আমাদের শুরু থেকেই বেশ লক্ষ্য করছে। এগিয়ে গিয়ে বললাম- আমাদের দু’জনের একটা যুগল ছবি তুলে দেবে কি? ওরা হ্যাঁ সূচক মাথা নাড়ল। ছবি তোলা হলে খাঁটি ইতালিয়ন ভাষায় ধন্যবাদ দিলাম- গ্রাৎসে! ওদের সঙ্গে আলাপ হলো। মার্কো, লুকা আর লুইগি এই গ্র্যান্ড ক্যানালেই সিজনে গন্ডোলা চালায়। অফ সিজনে অন্য কোন কাজ করে সময় কাটাতে হয়। সুদর্শন মার্কো বারটেন্ডারের কাজ করে। আর লুকা, লুইজি দু’জনই এ্যাড্রিয়াটিকে মাছ ধরার ট্রলারে কাজ করে। জলের সঙ্গে ওদের সখ্য কি-না! আজ উইকএন্ডে তিন বন্ধু মিলে এদিকটায় বেড়াতে এসেছে। ভেনিসীয় তিন যুবকের কাছ থেকে বিদায় নিয়ে খালের কিনারা ধরে এগোতে লাগলাম। দু’পাশের প্রাসাদোপম গোথিক ও নানা স্থাপত্যরীতির দালানকোঠাগুলো যেন কোন শিল্পীর আঁকা চিত্রপট। খালের পাশের এই বাড়িগুলোর মূল আকর্ষণ এর ঝুল বারান্দা বা ছোট্ট বেলকনি। ভেনিসবাসীর রোমান্টিক জীবনযাত্রার এক চিরাচরিত অনুষঙ্গ। ভেনিসের এই বাড়িগুলো কাঠের পাইল বা স্তম্ভের ওপর নির্মিত। শতাব্দীর পর শতাব্দী ডুবে থাকার পর এসব পাইল এখনও অক্ষত আছে এক বিশেষ গুণের জন্য। এ্যাডলার গাছের এই কা-গুলো বায়ুনিরোধী। এসব পাইল পানিতে ডুবে অক্সিজেনবিহীন পরিবেশে ক্ষয়ে যায় না, যেটা পানির ওপর হয়। ভেনিসবাসীরা সুদূর সেøাভেনিয়া থেকে পাইলের জন্য এসব কাঠ এনেছে। কাঠ মজবুত করার জন্য রুশ দেশের লার্চ গাছের নির্যাস থেকে তৈরি তার্পিন তেল মাখা হয়েছে। একটা চমৎকার বাড়ি দেখলাম। শ্বেতপাথর দিয়ে তৈরি বাড়িটি গ্রীক স্থাপত্যকলাকে অনুসরণ করে তৈরি করা হয়েছে। কিন্ত এর মাথায় আসমানী রঙা গম্বুজটি মুসলিম স্থাপত্যরীতির প্রকাশ। আশপাশে প্রচুর বাংলাদেশী শ্রমিক দেখা যাচ্ছে। একজনের সঙ্গে কথা হলো। মোসলেম মিয়া, ফুটপাথের পাশে ভ্যানে স্যুভেনিরসহ রকমারি মামুলি জিনিস বিক্রি করছে। থাকে পাদোভায়। ট্রেনে পাদোভা-ভেনিস ডেইলি প্যাসেঞ্জারি করে। জানালো ভেনিস ব্যয়বহুল হওয়ায় ওর মতো বেশিরভাগ বাংলাদেশী শ্রমিক পাদোভা ও মেস্ত্রেতে থাকে। মোসলেম মিয়ার ভ্যান থেকে নীল পুঁতি আর মেরুন রঙা পাখির পালকের একটা কার্নিভাল মাস্ক কিনলাম। লাঞ্চের জন্য খাবার কিনতে পাশের গলিতে ঢুকলাম। শহরের ভেতরে অজস্র সরু গলি। গলিগুলো পুরনো ঢাকার মতো গমগমে। ফুটপাথের খানিকটা অংশ নিগ্রোদের দখলে। কিছু সাধারণ মানের লেডিস ব্যাগ বিক্রি করছে। অসংখ্য দোকানপাট। খাবার দোকানের জমমজমাট ব্যবসা। একটা ঘুপচির মতো দোকানে ঢুকলাম। দোকানের বাইরে রকমারি পিৎজার ছবি। ঘুপচির মতো মনে হলেও দোকানটির পেছনের দিকটা বেশ লম্বা। সেখানে ভোজনরসিক ট্যুরিস্টরা গিজগিজ করছে। সেলসের চাইনিজ মেয়েটা আমার সামনে পিৎজার একটা দীর্ঘ লিস্ট ধরিয়ে দিল। চোখ বোলাতে গিয়ে দেখি হ্যাম আর স্যামনের ভিড়ে স্পিনাচ দেয়া এক পদের পিৎজা রয়েছে। ওটাই কিনলাম। সঙ্গে চিকেন বার্গারের মতো ইতালিয়ান একটা খাবার। খাবারের মোড়কগুলো ব্যাগে পুরে ওয়াটারবাসের টিকেট কাউন্টারের দিকে এগিয়ে গেলাম। টিকেট কেটে ওয়াটারবাসে চেপে সেন্ট লুসিয়া থেকে ভেনিসের শেষ প্রান্ত সেন্ট এলেনার উদ্দেশে রওনা হলাম। বাইরে পর্যটক খুব একটা দেখা না গেলেও ভেতরে বেশ ঠাসাঠাসি অবস্থা। একপাশে বসে পুরাতন দালানকোঠা দেখতে লাগলাম। অন্যপাশে তাকিয়ে মনে হলো ওদিকটায় আরও ভাল কিছু দেখার আছে। আস্তে করে উঠে এসে অন্যপাশের দৃশ্য দেখতে লাগলাম। কিছুক্ষণ পর মনে হলো- নাহ! ওদিকটাই বোধ হয় ভাল ছিল। আমার এই চঞ্চলতা লক্ষ্য করে পলাশ বলল- চলো, সামনের ডেকে দাঁড়াই। দু’পাশটাই ভাল করে দেখা যাবে। আমি সঙ্গে সঙ্গে উঠে দাঁড়িয়ে, ওর হাতে একটা ক্যামেরা দিয়ে নিজে আরেকটি ক্যামেরা নিয়ে বললাম, এবার দু’জন দু’দিকের দৃশ্য ভিডিও করব। প্রাচীন রোমানরা এ্যাড্রিয়াটিকের পূর্ব তীরের ভেনিসকে জেলেদের দ্বীপ হিসেবে আবিষ্কার করে। এর অধিবাসীরা ছিল মূলত আশপাশের রাজ্য থেকে আগত উদ্বাস্তু। জার্মান ও হান উপজাতিদের আক্রমণের হাত থেকে রেহাই পেতে তারা এ অঞ্চলে আশ্রয় নেয়। রোমানরা ভেনিসকে কনস্ট্যান্টিনোপলসের সঙ্গে সমুদ্রপথে সংযোগ স্থাপন করে। ইস্টার্ন রোমান সাম্রাজ্য বা কনস্ট্যান্টিনোপলসের অধীনে ভাইসরয় দ্বারা তখন ভেনিস শাসিত হতো। পরবর্তীকালে স্বায়ত্তশাসন দিয়ে এই রাজ্যটির নাম রাখা হয় ‘রিপাবলিক অব ভিনিজিয়া’। একজন ডজ বা ডিউক ছিল এই প্রজাতন্ত্রের প্রধান। বারো শতকের পূর্বে ভেনিস বহুবার এ্যাড্রিয়াটিকের অপর পাড়ের বলকান অঞ্চলের ক্রোয়েশিয়ার ডালমেশিয়ান জলদস্যুদের আক্রমণের শিকার হয়। অবস্থানগত কারণে ভেনিস পশ্চিম ইউরোপের প্রধান বাণিজ্যিক কেন্দ্রে পরিণত হয়। তুর্কি ও নরম্যানদের আকস্মিক আক্রমণের সময় ভেনিস কনস্ট্যান্টিনোপলসকে সহায়তা করার সুবাদে ভেনিসের সঙ্গে ইস্টার্ন রোমান সাম্রাজ্যের ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক গড়ে ওঠে। ভেনিস গোল্ডেন বুল- বিশেষ বাণিজ্য সুবিধা পায়। এছাড়া সাইপ্রাস ও ক্রিট দ্বীপে লবণ বাণিজ্য এবং নিকট প্রাচ্যের দেশসমূহে মসলা ও শস্য বাণিজ্যের কারণে সমৃদ্ধশালী ভেনিস রাজকীয় শক্তিতে পরিণত হয়। এই ভেনিস থেকেই বারো শতকের বণিক ও পর্যটক মার্কো পোলো স্থল ও সমুদ্রপথে মধ্য এশিয়া হয়ে সুদূর চীনদেশে গিয়েছিল বাণিজ্য প্রসারের জন্য। ভেনিসের বিশিষ্ট বণিক ও পরিব্রাজক মার্কোপোলো তার ভ্রমণ কাহিনীর মাধ্যমে ইউরোপিয়ানদের সর্বপ্রথম চীন ও মধ্য এশিয়ার সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দেন। যাই হোক, মার্কোপোলোর সময় অর্থাৎ তেরো শতকের গোড়ায় ভেনিস বিশ্বের সবচেয়ে সমৃদ্ধশালী নগরে পরিণত হয়। এ সময়ে ভেনিসের ৩,৬০০ নাবিক আর ৩,৩০০ জাহাজ ভূমধ্যসাগরে বাণিজ্যের ক্ষেত্রে একাধিপত্য বজায় রাখে। ভেনিসের প্রভাবশালী পরিবারগুলো বড় বড় প্রাসাদ নির্মাণ করে। শিল্পী ও সাহিত্যিকদের পৃষ্ঠপোষকতা করে আজকের এই দৃষ্টিনন্দন ভেনিস গড়ে তোলে। তবে পরবর্তীতে ক্রিস্টোফার কলম্বাসের আমেরিকা আবিষ্কার ও পর্তুগিজ নাবিক ভাস্কো দা গামা ভারতবর্ষে যাওয়ার নতুন পথ আবিষ্কার ইত্যাদি কারণে ভেনিস তার সমুদ্রপথের একচেটিয়া অবস্থান হারায়। এছাড়া তৎকালীন ফরাসী, ইংরেজ ও ওলন্দাজরা বিশ্বব্যাপী উপনিবেশিক দৌরাত্ম্যে মেতে উঠলে ভেনিস ধীরে ধীরে বিশ্ব বাণিজ্যে পরিত্যক্ত হয়। আমাদের বহনকারী ওয়াটারবাসটি গ্র্যান্ড ক্যানালের সবুজ পানি কেটে কেটে এগিয়ে যাচ্ছে। চারপাশে সাত-আট শ’ বছরের পুরাতন নগরী। আধুনিকতার ছোঁয়া থেকে একে সযতেœ আগলে রাখা হয়েছে। ঐতিহ্যকে এতটুকু হারিয়ে যেতে দেয়া হয়নি। খাল ঘেঁষে এই দৃষ্টিনন্দন বাড়িগুলোর কোনটি ফাইভস্টার হোটেল, কোনটি মিউজিয়াম, এমনকি কোনটি পত্রিকা অফিস। পানির ওপর এসব বাড়ির বেলকনি দেখে লোভ হয়। ইচ্ছা করে ওখানে গিয়ে দাঁড়াই। দু-একটা বাড়ি পর পর সরু গলি। কিছু গলি এত সরু যে, দু’জন মানুষ পাশাপাশি চলতে পারবে না। আবার কোন কোন জায়গার গলির বদলে সরু সরু খাল শহরের ভেতরে চলে গেছে। পাশাপাশি বিল্ডিংয়ের মঝে সেতুবন্ধ করেছে ছোট্ট একটি ঝুলন্ত প্যাসেজ। (চলবে)
×