ঢাকা, বাংলাদেশ   শনিবার ২০ এপ্রিল ২০২৪, ৬ বৈশাখ ১৪৩১

চিররহস্যময়ীর কুয়াশা ভেদ করে

প্রকাশিত: ১৯:২৬, ৫ ফেব্রুয়ারি ২০১৬

চিররহস্যময়ীর কুয়াশা ভেদ করে

অনলাইন ডেস্ক ॥ ‘সাংবাদিক জীবনের গৃহস্থগিরি করতে গিয়ে বার বার মনে হয়েছে অবিচুয়ারি লেখার সুযোগ সাপ্তাহিক শ্মশান যাত্রার মতো।...ব্যক্তিগত শোকগাথা লেখা মানে মর্গে বডিটাকে উল্টে-পাল্টে ময়না তদন্তের মতো দেখা।’ তাঁর সাম্প্রতিকতম বই ‘তারাদের শেষ চিঠি’র ভূমিকায় লিখছেন সাংবাদিক গৌতম ভট্টাচার্য। সঙ্গে সুচিত্রা সেনের শোকগাথার সংক্ষেপিত অংশ। ‘‘এটা তার মানে সুচিত্রা সেনের ফ্ল্যাট? এটাই দেখাতে এনেছেন মুনমুন?’’ তাঁর মায়ের মৃত্যুর পর দেওয়া প্রথম ইন্টারভিউ শেষ করে উঠে মুনমুন সেন বললেন, ‘‘একটা জিনিস দেখবেন? এখন লিখতে পারবেন না কিন্তু। অ্যান্ড পিকচার ইজ আউট অব দ্য কোয়েশ্চেন।’’ বুঝলাম তাঁর মা-র কোনও দুষ্প্রাপ্য ছবি বা বিশেষ স্মৃতিচিহ্ন জড়িত শাড়িটাড়ি হবে। বললেন, ‘‘চলুন’’। ওঁর ফ্ল্যাট থেকে বেরিয়ে ঠিক পাশের ফ্ল্যাটে ঢুকলাম আমরা। বোঝা গেল জিনিসটা যাই হোক, এখানে রয়েছে। ছোট ড্রইংরুম। তেমন কিছু আসবাব নেই দামি টেবলটা ছাড়া। চোদ্দ বাই চোদ্দ হবে ঘরটা। সুচিত্রার ছবি ঝুলছে দেওয়ালে। এই ছবি দুটোই কি তাহলে বিশাল ইঙ্গিতবাহী? একটা ‘সপ্তপদী’-র। অন্যটা বোধহয় বাড়িতে তোলা। মুনমুন ছবির দিকে তাকিয়ে মাথায় হাত ঠেকালেন। ‘‘ওঁর জীবিত অবস্থাতে টাঙাতে দেননি। বলেছিলেন, আমি চলে যাওয়ার পরে তোমার যা ইচ্ছে তাই কোরো।’’ বোঝা গেল ছবিগুলোর লোকেশন সম্প্রতি বদলেছে। তার মানে এর সঙ্গে কোনও নস্ট্যালজিয়া জড়িত নেই। তাহলে কী দেখাতে মুনমুন আনলেন আমাকে? সামনে ছিমছাম গোছানো সোফা। একটা দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে মুনমুন বললেন, ‘‘পাশের ঘরটা খুব ছোট। একটা ছোট ডাইনিং টেবল ধরে। কোনায় দরজা বন্ধ ঘরটা ঠাকুরঘর। এই ড্রইংরুমটাতেই সারাদিন কেটে যেত ওঁর।’’ এখানে সারাদিন কেটে যেত মানে- মাথায় কেউ তীব্র হাতুড়ির ঘা মারল। অন্ধকারের মধ্যে হঠাৎ যেন জ্বলে উঠল আলোর ফুলকি। এটা তার মানে সুচিত্রা সেনের ফ্ল্যাট? এটাই দেখাতে এনেছেন মুনমুন? কিন্তু ওঁর ফ্ল্যাটটা তো এই ফ্লোরের কোনার দিকের সবচেয়ে শেষ ঘরটা ছিল বলে জানি। যে ফ্ল্যাট চিক দিয়ে দিন-রাত সব সময় ঢাকা। চিরকাল জেনে এসেছি ওই চিক দেওয়া ঘরটাই দীর্ঘ এত বছর দুই বাংলার রহস্যময়তাকে লালন করেছে। কোনার দিকে সবচেয়ে শেষ ঘর ইচ্ছাকৃত বেছে নেওয়া যাতে অবগুণ্ঠন অবিচলিত থাকায় আরও সাহায্য আসে। কোনার ফ্ল্যাটটার লোকেশন এমন যে বাকি পৃথিবীর সঙ্গে একটা সম্মানজনক দূরত্ব জাস্ট বিনা বাক্যব্যয়ে তৈরি হয়ে রয়েছে। যখনই মুনমুন বা রাইমার সঙ্গে এ বাড়িতে দেখা করতে এসেছি, গেটওয়েতে দাঁড়িয়ে চিক দেওয়া ঘরটাকে লক্ষ্য করেছি। মনে হয়েছে হায় এর পর্দা কি কখনও উঠবে না? মুনমুন তো সেই অ্যাদ্দিনকার ধারণাকে খারিজ করে দিচ্ছেন। এত বছরের বিশ্বাসের জামানত বাজেয়াপ্ত হচ্ছে ওঁর দেওয়া তথ্যে। ‘‘মা এই ফ্ল্যাটটাতেই থাকতেন। যবে থেকে এ বাড়িতে আমরা এসেছি।’’ কিন্তু কী করে সেটা সম্ভব? গায়ে লাগানো দুটো ফ্ল্যাট। মুনমুনেরটা থ্রি সি। আর এটা নিশ্চয়ই থ্রি ডি। মুনমুনের ফ্ল্যাটের বাইরে কোনও নেমপ্লেটও নেই। অথচ বাড়িতে এত ভিজিটর আসে। হতেই তো পারে সে ভুল করে এই ফ্ল্যাটটায় বেল বাজাল। তখন তো আপনার মা-কে বার হতে হত। ‘‘হত না। মা খুলতেন না দরজা,’’ হেঁয়ালি-সহ বললেন মুনমুন। একটা পর্যায়ের পর আর জিজ্ঞেস করা যায় না। বলা যায় না বেল শুনে যদি দরজা না খোলেন তাহলে আপনারা এমন অবিরত যাতায়াত করতেন কী করে? এই বাড়িতে আনন্দপ্লাস-এর ফটোশুট হওয়ার সময়ে মনে আছে রাইমা কিছুক্ষণের জন্য অদৃশ্য হয়ে গেছিলেন। তারপর এসে বলেছিলেন, ‘‘আম্মাকে দেখিয়ে এলাম।’’ আজ এই হতভম্ব অবস্থাতেই মনে হচ্ছে ডুপ্লিকেট চাবির অবধারিত গল্প ছিল। কিন্তু তার চেয়েও বড় প্রহেলিকা অজ্ঞাতবাসে থাকতে যে প্রবাদপ্রতিম মহানায়িকা এমন আগ্রহী, তিনি জমজমাট লোকালয়ের এত কাছে থাকবেন কেন? মুনমুন রাজনীতিতে যোগ দেওয়ার আগে পর্যন্ত ভরপুর সোশ্যাল লাইফ উপভোগ করেছেন। পার্টি-উৎসব-নেমন্তন্ন লেগেই থেকেছে ওপাশের ফ্ল্যাটে। কত মানুষজন এসেছে। তারা একটু তৎপর হলেই তো দেখে ফেলত। তাছাড়া সবার আগে আরও একটা ধাঁধা, তাহলে কি অজ্ঞাতবাসকে একটা মজার চ্যালেঞ্জ হিসেবে নিতেন সুচিত্রা? খুব এনজয় করতেন এই ঔৎসুক্য? এই লোকেশন কিন্তু তেমনই বলছে। টাচ মি টাচ মি নট। সূত্র : আনন্দবাজার পত্রিকা
×