ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৯ মার্চ ২০২৪, ১৪ চৈত্র ১৪৩০

বুয়েটের বিশেষজ্ঞ ও এলজিইডির মতপার্থক্য

মগবাজার-মৌচাক ফ্লাইওভারে নানা ত্রুটির অভিযোগ

প্রকাশিত: ০৫:৩২, ৭ ফেব্রুয়ারি ২০১৬

মগবাজার-মৌচাক ফ্লাইওভারে নানা ত্রুটির অভিযোগ

রাজন ভট্টাচার্য ॥ দেশীয় বিশেষজ্ঞদের মতামতকে গুরুত্ব না দেয়াসহ সমন্বয়ের অভাবেই মগবাজার-মৌচাক ফ্লাইওভার নির্মাণে শেষ সময়ে নানা ত্রুটি দেখা দিয়েছে। যা এই মুহূর্তে কোনভাবেই নিরসন সম্ভব নয়। অর্থাৎ যানজট নিরসনের এই উড়াল সড়কটি ভবিষ্যতে দুর্ভোগের কারণ হয়ে দাঁড়াতে পারে। সহস্রাধিক কোটি টাকার এই প্রকল্পে গুরুত্বপূর্ণ ত্রুটি বের হওয়ায় বিস্ময় প্রকাশ করেছেন বিশেষজ্ঞরা। তারা বলছেন, দেশীয় বিশেষজ্ঞদের পরামর্শ ছাড়াই বিদেশী প্রতিষ্ঠান দিয়ে নক্সা করানো ও সঠিক তদারকির অভাবেই এমন হয়েছে। তবে বাস্তবায়নকারী প্রতিষ্ঠান এলজিইডি বলছে, নক্সায় কিছুটা ত্রুটি থাকলেও তা সংশোধন করা হয়েছে। তাই একটি পিলারও ভাঙতে হবে না। সবকিছু ঠিক আছে। মার্চে প্রকল্পের একটি অংশ উদ্বোধন করার কথাও জানিয়েছেন প্রকল্পের পরিচালক নাজমুল আলম। তবে উড়াল সড়কটির সমস্যা নিয়ে একেক দফতর থেকে একেক রকমের মতামত মিলছে। কোনটি সঠিক? এ নিয়েই দেখা দিয়েছে বিভ্রান্তি। প্রকল্পের কাজ চলমান অবস্থায় ভুল নক্সার অভিযোগ তুলে ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান। তাদের পক্ষ থেকে বলা হয় মাটির নিচে বিভিন্ন সেবা সংস্থার লাইন থাকায় কাজকরা হচ্ছে না। কিন্তু কর্তৃপক্ষের বক্তব্য ছিল, এসব বিষয় মাথায় রেখেই প্রকল্পটি পাস হয়েছে। এমনকি ইউটিলিটি সার্ভিস লাইন সরানোর অর্থ যোগ করে দেয়া হয়েছে মূল প্রকল্পের সঙ্গে। কাজের গতি থামিয়ে দিতেই ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান নানা কথা বলছে বলে অভিযোগ আনা হয়। এরমধ্যেই কয়েকদফা নক্সায় পরিবর্তন আসে। এর পুরো কাজটিই করে বুয়েটের সিভিল ইঞ্জিনিয়ারিং বিভাগ ও স্থানীয় সরকার প্রকৌশল বিভাগ। বাস্তবতা হলো, শেষ পর্যন্ত প্রকল্পের নানা ত্রুটি বিচ্যুতির খবর ফাঁস হলেও এর দায় নিচ্ছে না কেউ। একেক বিভাগের পক্ষ থেকে দেয়া হচ্ছে একেক রকমের বক্তব্য। এলজিইডি বলছে, কোন সমস্যা নেই। সব ঠিক। প্রকৌশলগত ত্রুটি অনেক আগেই নিরসন হয়েছে। উড়াল সড়কটি খুলে দেয়ার পর কোন সমস্যা না হওয়ারও দাবি করা হচ্ছে সংস্থার পক্ষ থেকে। কিন্তু ভিন্ন কথা বলছেন, বুয়েটের বিশেষজ্ঞরা। তারা বলছেন, নক্সায় ভুল থাকায় সমস্যা অনিবার্য। এক পর্যায়ে ৬০টি পিলার ভেঙ্গে ফেলারও পরামর্শ দেয়া হয়েছিল। সমস্যা সমাধানে এলজিইডি আবারো আমেরিকান নক্সা প্রস্তুতকারী প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে কয়েকদফা কথা বলে। সে অনুযায়ী কিছু ত্রুটি বিচ্যুতে অনেকটা সুকৌশলে সারিয়ে নেয়ার চেষ্টা হয়। সব মিলিয়ে কাজ যেভাবে চলছে এভাবেই শেষ হবে। এরমধ্যে কোন পরিবর্তন হবে না। সাধারণত আমাদের দেশে ডানদিকে স্টিয়ারিং রেখে গাড়ি চালানো হয়। কিন্তু বাঁ দিকে স্টিয়ারিংয়ের বিষয়টি মাথায় রেখে ফ্লাইওভারের নক্সা অনুমোদন হয়েছে। এর কারণ হিসেবে সংশ্লিষ্টরা বলছেন, আমেরিকার একটি প্রতিষ্ঠানকে দিয়ে নক্সা করানো হয়। সে দেশে বাঁ দিকে স্টিয়ারিং ধরে গাড়ি চালান চালকরা। এ বিষয়টি বিবেচনায় রেখে নক্সা হওয়ায় ত্রুটি চিহ্নিত হয়েছে। বিদেশী প্রকৌশলীর করা নক্সায় নির্মাণাধীন ৮ দশমিক ৭০ কিলোমিটার দৈর্ঘ্যরে এই উড়াল সড়কে ওঠা-নামার র‌্যাম্পে জটিলতা আছে। প্রকল্প বাস্তবায়নে যাওয়ার আগে দেশীয় পরিকল্পনাবিদদের সঙ্গে পরামর্শ, স্বতন্ত্র কোন বিশেষজ্ঞকে দিয়ে যাচাই ও গণশুনানি না করাকে চিহ্নিত করেছেন বাংলাদেশ প্রকৌশল ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের (বুয়েট) পুরকৌশল বিভাগের অধ্যাপক মোহাম্মদ শামসুল হক। উড়ালসড়কের নক্সার ত্রুটি তুলে ধরে তিনি সংবাদমাধ্যমকে বলেন, এতো দীর্ঘ একটি উড়ালসড়কে পর্যাপ্ত রাইট টার্নের ব্যবস্থা না রাখায় তা যানজট নিরসনে ভূমিকা রাখবে না। দ্রুত গন্তব্যে পৌঁছার যে সুবিধাটুকু ফ্লাইওভার থেকে পাওয়ার কথা ছিল তাও হয়ত পাওয়া যাবে না। এছাড়া ফ্লাইওভারের মৌচাক এলাকার একটি স্থানে সিগন্যাল পদ্ধতি রাখা হয়েছে, যা উড়ালসড়কের উপরেই যানজট সৃষ্টির কারণ হবে। চার লেনবিশিষ্ট এ উড়ালসড়কে উঠা-নামার জন্য তেজগাঁওয়ের সাতরাস্তা, সোনারগাঁও হোটেল, মগবাজার, রমনা (হলি ফ্যামিলি হাসপাতাল সংলগ্ন রাস্তা), বাংলামোটর, মালিবাগ, রাজারবাগ পুলিশ লাইনস ও শান্তিনগর মোড়ে লুপ বা র‌্যাম্প রাখা হয়েছে। নির্মাণ শুরুর তিন বছরের মাথায় ফ্লাইওভারটি ভৌত রূপ লাভের পর দেখা যাচ্ছে, এর উঠার পথ নামার পথের চেয়ে তুলনামূলক খাড়া। অথচ উপরে উঠার জন্য ঢালু পথ ও নিচে নামার জন্য খাড়া পথ যানবাহনের জন্য উপযোগী বলছেন বিশেষজ্ঞরা। এই ফ্লাইওভারের নক্সা করার ক্ষেত্রে বিদেশে বাঁ দিকে স্টিয়ারিংয়ে চালিত গাড়ির কথা মাথায় রাখায় উঠা-নামার লুপে এই বৈপরীত্য দেখা দিয়েছে বলে ধারণা করা হচ্ছে। এতে দুর্ঘটনার ঝুঁকি থাকছে বলে মনে করছেন অধ্যাপক শামসুল হক। তিনি বলেন, বাংলাদেশে অনেক ফিটনেসবিহীন ও ওভারলোডেড বাস-ট্রাক ও অন্যান্য যানবাহন রাস্তায় চলছে। মালবাহী গাড়িগুলো খাড়া লুপ দিয়ে উঠার ক্ষেত্রে দুর্ঘটনায় পড়ার ঝুঁকি থাকবে। শামসুল হক বলেন, নির্মাণ কাজের মাঝামাঝি সময়ে এলজিইডির লোকজন আমাদের কাছে এসেছিলেন ভিন্ন একটি সমস্যা নিয়ে। ফ্লাইওভারের ডেক ( মেঝে) স্থাপনে হিসাবের গরমিল ছিল। আমরা সেটার সমাধান করতে পেরেছি। নক্সার বিভিন্ন ত্রুটি নিয়ে যে অভিযোগ আসছিল তারও সত্যতা পাওয়া যায় তখন। প্রকল্পের বাস্তবায়ন কাজ যে পর্যায়ে এসেছে এখন এসব ত্রুটি থেকে উত্তরণ প্রায় অসম্ভব বলে মনে করছেন তিনি। যে ত্রুটিগুলো নিয়ে কথা হচ্ছে এগুলো সমাধানের এখন আর সুযোগ নেই। তবে এমন ভুল যাতে ভবিষ্যতে না হয় এর থেকে সেই শিক্ষা নেয়া যেতে পারে। নগর পরিকল্পনাবিদ অধ্যাপক নজরুল ইসলাম ত্রুটি নিয়ে ফ্লাইওভার নির্মাণে অসন্তোষ প্রকাশ করে বলেন, শহরের ভেতরে এতো বড় একটি প্রকল্প বাস্তবায়নে যাওয়ার আগে যথেষ্ট চিন্তা-ভাবনা, বিচার-বিশ্লেষণ করা হয়নি। যারা এর বাস্তবায়নের সঙ্গে যুক্ত তাদের দক্ষতারও ঘাটতি রয়েছে বলে মনে হয়। এটা অত্যন্ত দুঃজনক ও নিন্দনীয়। এমনিতেই বার বার প্রকল্পের মেয়াদ বৃদ্ধি আর কয়েক বছর ধরে নির্মাণযজ্ঞের কারণে নগরবাসীর নাভিশ্বাস উঠেছে। তার মধ্যে এ ধরনের ত্রুটির কথা শোনা গেলে তা নিন্দাযোগ্য। তিনি বলেন, সঠিক পরিকল্পনার অভাবে এরকম ত্রুটি হয়েছে। বড় রকমের ত্রুটি বিচ্যুতি রেখে কিভাবে এতবড় একটি প্রকল্প পাস হলো? এতোদিন কাজ হয়েছে; তাই এখন ভাবনার বিষয়। এরফলে একদিকে যেমন জাতীয় সম্পদের অপচয় হয়েছে। যা সবাইকে হতাশ করে। অন্যদিকে আর্থিক ক্ষতি ও অব্যবস্থাপনার কারণে মানুষ আস্থা হারাবে। বড়-বড় প্রকল্প নেয়ার সময় সবার সঙ্গে আলোচনা করা উচিত বলেও মনে করেন তিনি। পুরো বিষয়টিকে হালকাভাবে দেখা উচিত হয়নি বলে মনে করেন এই বিশেষজ্ঞ। স্থানীয় সরকার প্রকৌশল অধিদফতরের তত্ত্বাবধানে ২০১৩ সালের ১৬ ফেব্রুয়ারি ফ্লাইওভারের নির্মাণকাজ শুরু হয়ে দুই বছরের মধ্যে অর্থাৎ ২০১৫ সালের মধ্যে শেষ করার কথা ছিল। ব্যয় ধরা হয়েছিল ৭৭২ কোটি ৭০ লাখ টাকা। তবে ঠিকাদার ও তত্ত্বাবধায়ক প্রতিষ্ঠানের ব্যর্থতার কারণে তিন দফায় সময় বাড়ানোর পর এখন ২০১৭ সালের জুনের মধ্যে কাজ শেষ করার কথা বলা হচ্ছে। পাশাপাশি প্রকল্পের ব্যয় প্রায় ৫৮ শতাংশ বাড়িয়ে এক হাজার ২১৯ কোটি টাকা বরাদ্দ করা হয়েছে। ভারতের সিমপ্লেক্স ইনফ্রাস্ট্রাকচার লিমিটেড ও নাভানার যৌথ উদ্যোগের প্রতিষ্ঠান ‘সিমপ্লেক্স নাভানা জেভি’ এবং চীনা প্রতিষ্ঠান দ্য নাম্বার ফোর মেটালার্জিক্যাল কনস্ট্রাকশন ওভারসিজ কোম্পানি (এমসিসিসি) ও তমা কনস্ট্রাকশন লিমিটেড উড়ালসড়কটির নির্মাণ কাজ করছে। নকশার ভুলে পিলার ভাঙতে হবে না ॥ মগবাজার-মৌচাক ফ্লাইওভারের ন নক্সার যে ভুল হয়েছে, তা সংশোধন করতে পিলার ভাংতে হবে না। প্রকল্প পরিচালক মোঃ নাজমুল আলম জনকণ্ঠ’কে বলেন, ফ্লাইওভারে ডানহাতি স্টিয়ারিংয়ের কথা মাথায় রেখেই ডিজাইন করা হয়েছে। নির্মাণকাজও চলছে সিভাবে। কাজেই ডানহাতি স্টিয়ারিং অনুযায়ী যান চলাচলে ঝুঁকির কোন কারণ নেই। তিনি বলেন, অনেকে না জেনে সমালোচনা করছেন। কেউ কেউ বলছেন, ৬০টি পিলার ভেঙ্গে ফেলতে হবে। কিন্তু কেন? কি এমন হলো যে পিলারগুলো ভেঙ্গে ফেলতে হবে। কিছুই হয়নি। সবকিছু ঠিক আছে। কোন আতঙ্কের কারণ নেই। আমরা এখন পর্যন্ত তো কোন পিলার ভাঙ্গিনি। যত সমালোচনা চলছে, তত কাজ এগিয়ে যাচ্ছে। যে যাই বলুক আমাদের লক্ষ্য হলো আগামী মার্চের মধ্যে ফ্লাইওভারের একটি অংশ গাড়ি চলাচলের জন্য উন্মুক্ত করে দেয়া হবে। তখন দেখবেন কোন সমস্যা হয় কিনা। প্রকল্প পরিচালক জানান, একনেক সভায় ফ্লাইওভারটির অনুমোদিত ব্যয় ধরা হয় ৭৭৩ কোটি টাকা। কিন্তু কয়েকটি গণমাধ্যমে এই ব্যয় ৪৪৬ কোটি টাকা বলা হয়েছে, যা অসত্য। অন্যদিকে এফডিসি থেকে সোনারগাঁও অংশে লেভেলক্রসিং অতিক্রম করায় ফ্লাইওভারের দৈর্ঘ্য ৪৫০ মিটার বেড়ে গেছে। এ কারণে ফ্লাইওভারের দৈর্ঘ্য বৃদ্ধি পেয়েছে। এতে ফ্লাইওভারের মোট দৈর্ঘ্য দাঁড়িয়েছে ৮ দশমিক ৭ কিলোমিটার। ফলে প্রকল্পের ব্যয় ও সময় বেড়েছে বলে জানান তিনি। প্রকল্প পরিচালক আরও জানান, ফ্লাইওভারটিতে র‌্যাম্প দিয়ে গাড়ি ওঠানামা নিয়ে কয়েকটি গণমাধ্যমে যে তথ্য দেয়া হচ্ছে, তা ঠিক নয়। কারণ ঢাকা শহরে প্রচলিত ট্রাফিক চলাচল যেভাবে হয়ে থাকে সেভাবেই বাঁয়ে ওঠা ও ডানে নামার র‌্যাম্প করা হয়েছে। চালকদের সমস্যা নিয়ে কথা বলতে চাইলে বাংলাদেশ সড়ক পরিবহন সমিতির মহাসচিব খন্দকার এনায়েত উল্যাহ জনকণ্ঠ’কে বলেন, আমাদের দেশের পরিবহন চালকরা যেভাবে গাড়ি চালিয়ে অভ্যস্ত সেভাবেই রাস্তা ও উড়াল সড়ক হবে এটাই স্বাভাবিক। এক্ষেত্রে যদি কিছু ব্যতিক্রম হয়ে থাকে তাহলে তো ভবিষ্যতে সমস্যা হতেই পারে। সড়ক দুর্ঘটনার আশঙ্কাও অমূলক নয়। তাই পরে সমস্যার চেয়ে আগে একটু সময় নিয়ে হলেও তা সমাধান করে নির্মাণ কাজ চালিয়ে যাওয়া উচিত বলে মনে করেন তিনি।
×