ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৯ মার্চ ২০২৪, ১৫ চৈত্র ১৪৩০

যশোরে কিন্ডার গার্টেনে মাত্রাতিরিক্ত বই

বইয়ের চাপে শিশুরা পিষ্ট ॥ বাধাগ্রস্ত মানসিক বিকাশ

প্রকাশিত: ০৭:১১, ৭ ফেব্রুয়ারি ২০১৬

বইয়ের চাপে শিশুরা পিষ্ট ॥ বাধাগ্রস্ত মানসিক বিকাশ

স্টাফ রিপোর্টার, যশোর অফিস ॥ শিক্ষার নামে শিশুর ওপর মাত্রাতিরিক্ত বইয়ের বোঝা চাপিয়ে দেয়া হচ্ছে। সরকারী নির্দেশনায় নির্ধারিত বইয়ের বাইরে শ্রেণীকক্ষে শিশুদের বাড়তি কোন বই পড়ানোর নিয়ম না থাকলেও তা মানা হচ্ছে না। শুধু যশোরের ২৭৩ কিন্ডারগার্টেনে সরকারের দেয়া বিনামূল্যের বইয়ের বাইরে পড়ানো হচ্ছে অতিরিক্ত পাঁচ থেকে আটটি বই। এছাড়া জেলার বেসরকারী স্কুলগুলোতেও শিশুদের মাত্রাতিরিক্ত বই পড়ানো হচ্ছে। ফলে মানসিক চাপে শিশুর মেধা বিকাশ বাধাগ্রস্ত হচ্ছে। সংশ্লিষ্টরা বিষয়টি স্বীকার করলেও কার্যত কোন উদ্যোগ নেয়া হচ্ছে না। শুধু তাই নয়, খোদ জেলা প্রশাসকের কার্যালয়ের পাশেই অনুমোদনহীন বই বিক্রি হলেও এ বিষয়ে কোন ব্যবস্থা নেয়া হয়নি। হুজাইফা মোড়লের বয়স ছয় বছর। তাকে এবার যশোর সদরের রূপদিয়া শহীদস্মৃতি কিন্ডারগার্টেন স্কুলের কেজি শ্রেণীতে ভর্তি করা হয়েছে। হুজাইফাকে সরকারের বিনামূল্যে বই দেয়া হয়েছে ১৪৪ পৃষ্ঠার এসো লিখতে শিখি, ৭২ পৃষ্ঠার আমার বাংলা বই এবং ১৫৭ পৃষ্ঠার আমার বই। তিনখানা বইয়ে বাংলা বর্ণ লেখা, গণনা করা, সংখ্যা লেখা ও ছবি আঁকা শেখার ব্যবস্থা আছে। কিন্তু এই স্কুলের ছাত্রী হিসেবে হুজাইফাকে আরও পড়তে হচ্ছে ‘অজানাকে জানতে হবে, বেবি পিকচার ওয়ার্ল্ড বুক, চিল্ড্রেন রাইমস, মডার্ন একটিভ ইংলিশ, রঙে রঙে ছবি আঁকা, ছোটদের অংক শেখা, মিনার ছড়া ও কচিদের বাংলা পড়া’ নামে আরও আটটি বই। সব মিলিয়ে তার ১১ খানা বইয়ে পৃষ্ঠা আছে ৬০৫টি। সিলেবাস অনুযায়ী সে ১১ মাসে পড়ার সুযোগ পাবে। সেই হিসেবে তাকে প্রতিদিন দুই থেকে তিন পাতা পড়া মুখস্থ করতে হচ্ছে। শুধু হুজাইফা নয়, যশোরের অধিকাংশ শিশু শিক্ষার্থীর ওপর এমন বইয়ের বোঝা চাপিয়ে দেয়া হয়েছে। শহরের নব কিশলয় প্রিক্যাডেট স্কুলের তৃতীয় শ্রেণীর এক ছাত্রীর অভিভাবক মিতা সরকার জানান, স্কুলে সরকারী বইয়ের বাইরে বই পড়ানো হচ্ছে। শিক্ষকরা শ্রেণীকক্ষে এসব বই কিনতে বলেছেন। মেয়ের ওপর চাপ পড়বে জেনেও তিনি বাধ্য হয়ে সাতটি বই কিনে দিয়েছেন। উপশহর বাদশা ফয়সাল ইনস্টিটিউটের চতুর্থ শ্রেণীর শিক্ষার্থীদের সরকারী ছয়টি বই ছাড়াও বাড়তি পড়ানো হচ্ছে ইংরেজী গ্রামার, বাংলা ব্যাকরণ, অজানাকে জানা, কম্পিউটার ও জ্যামিতি নামের পাঁচটি বই। অভিভাবক জীবন চৌধুরী জানান, অতিরিক্ত বইয়ের কারণে শিশুদের ওপর শুধু মানসিক চাপ পড়ছে না, তাদের ওপর অত্যাচার করা হচ্ছে। শিক্ষার নামে এই অত্যাচার শিশুদের মানবিক বিকাশ বাধাগ্রস্ত করছে। তাদের শৈশব চুরি করা হচ্ছে। শিক্ষার প্রতি ভীতি তৈরি হচ্ছে। এই মানসিক অত্যাচারের শিকার শিশুরা যখন বড় হবে তখন জাতিগতভাবে আমাদের মানবিক সঙ্কট দেখা দেয়ার আশঙ্কা রয়েছে। শাহানাজ পারভীন নামে এক ব্যাংক কর্মকর্তা জানান, তার ছেলের বয়স সাড়ে পাঁচ বছর। সরকারী প্রাথমিক বিদ্যালয়ে শিক্ষার উপযুক্ত পরিবেশ না থাকায় তিনি বেসরকারী স্কুলে খোঁজ নেন। অনেক দেখেশুনে তিনি ওয়াইডব্লুসিএ’তে ছেলেকে ভর্তি করেছেন। সেখানেও নার্সারিতে ছয়টি বই পড়ানো হচ্ছে। এত পড়ার চাপের কারণে শিশুদের নিজস্বতা তৈরি হচ্ছে না। কিন্তু বিকল্প না থাকায় বাধ্য হয়ে তিনি এই প্রতিষ্ঠানে ছেলেকে ভর্তি করিয়েছেন। সরকার নির্ধারিত বইয়ের বাইরে অতিরিক্ত বই পড়ানোর কথা জানতে চাইলে কিশলয় প্রিক্যাডেটের অধ্যক্ষ আতাহার রহমান বলেন, এগুলো কেউ বই, কেউবা খাতা বলেন। কারণ, সেগুলোর মাঝখানে মাঝখানে ফাঁকা জায়গা রয়েছে। সেখানে শিক্ষার্থীরা লিখে থাকে। জেলা শিক্ষা অফিসার নাসির উদ্দিনও মনে করেন অতিরিক্ত বই পড়ানোর কারণে শিশুদের ওপর মানসিক চাপ বাড়ছে। তিনি জানান, আইনে নিষিদ্ধ হলেও যশোরের কিন্ডারগার্টেনে অতিরিক্ত বই পড়ানো হচ্ছে। তবে আইনটি বাস্তবায়নের দায়িত্ব তাদের নয়, প্রাথমিক শিক্ষা অফিসের।
×