ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৯ মার্চ ২০২৪, ১৫ চৈত্র ১৪৩০

জঙ্গীবিরোধী আলেমরা জামায়াত-শিবিরের আক্রমণের মুখে

প্রকাশিত: ০৫:১৮, ১০ ফেব্রুয়ারি ২০১৬

জঙ্গীবিরোধী আলেমরা জামায়াত-শিবিরের আক্রমণের মুখে

বিভাষ বাড়ৈ ॥ ধর্মের অপব্যাখ্যা দিয়ে চলা জঙ্গীদের বিরুদ্ধে ঐক্যবদ্ধভাবে মাঠে নেমে এবার বাধার মুখে পড়েছেন দেশের বিশিষ্ট মুফতি আলেম ওলামাসহ ইসলামী চিন্তাবিদরা। আলেম সমাজের ‘জঙ্গীবাদবিরোধী’ ফতোয়া ঠেকাতে মাঠে নেমেছে জামায়াত-শিবিরসহ তাদের মদদপুষ্ট উগ্রবাদী সংগঠন আনসারুল্লাহ বাংলা টিম, হিজবুত তাহ্রীর। দেশের লক্ষাধিক আলেমের অংশগ্রহণে ফতোয়া জারির উদ্যোগ কোনভাবেই গ্রহণ করতে পারছে না এ গোষ্ঠী। ফতোয়ার বিরোধিতা করে শুরু করেছে অপপ্রচার। উগ্রপন্থীদের বাঁশের কেল্লা ও তিতুমীর মিডিয়া থেকে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ছড়িয়ে দেয়া হছে বিকৃত তথ্যসম্বলিত ভিডিও। সেখানে জঙ্গীবাদ প্রতিরোধের ফতোয়াকে ‘জেহাদের বিরুদ্ধে ফতোয়া’ বলে অপপ্রচার চলছে। এদিকে উগ্রবাদীদের এ কর্মকা-ে ভীত না হলেও এ চক্রকে চিহ্নিত করে কঠোর ব্যবস্থা নেয়ার জন্য আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সহযোগিতা চেয়েছেন ইসলামী চিন্তাবিদরা। তারা বলেছেন, জঙ্গী ও তাদের মদদপুষ্টরা জেহাদ ও সন্ত্রাসকে এক করে আসলে ইসলামের ক্ষতি করছে। এদের সম্পর্কে সর্বস্তরের মানুষকে সজাগ থাকতে হবে। বিশিষ্ট আলেমরা বলছেন, সন্ত্রাস ও জঙ্গী কর্মকা-কে ইসলাম সমর্থন করে না। আন্তর্জাতিক গোষ্ঠীর উসকানিতে একটি চক্র দেশের তরুণদের বিপদগামী করছে। দেশের সব আলেম সম্মিলিতভাবে জঙ্গীবাদের বিরুদ্ধে ফতোয়া দিলে, ধর্মের সঙ্গে জঙ্গীবাদের যে সম্পর্ক নেই, তা বিশ্বের কাছে স্পষ্ট হবে। এতে দেশের ভাবমূর্তি উজ্জ্বল হবে। জঙ্গীদের বিরুদ্ধে বিশাল এ কর্মযজ্ঞ শুরুর বিষয়ে এর অন্যতম সংগঠন ঐতিহাসিক শোলাকিয়া ঈদগার খতিব ও বাংলাদেশ জমিয়াতুল উলামার চেয়ারম্যান আল্লামা ফরীদ উদ্দীন মাসউদ বলছিলেন, জঙ্গীবাদবিরোধী ফতোয়ায় এক লাখ মুফতি ও উলামায়ে কেরামের স্বাক্ষর সংগ্রহের কার্যক্রম শুরু হয়ে গেছে। এক মাসের মধ্যেই লক্ষাধিক আলেমের সই সংবলিত ফতোয়া প্রকাশ করা সম্ভব হবে বলে আমরা মনে করছি। জঙ্গীবাদের বিরুদ্ধে ইতোমধ্যেই ফতোয়ায় স্বাক্ষার করেছেন উপমহাদেশের সবচেয়ে বড় দেওবন্দ মাদ্রাসা ও দেশের অন্যতম হাটহাজারী মাদ্রাসার মুফতিগণ। শোলাকিয়া ঈদগার খতিব বলেন, জঙ্গীবাদের কবল থেকে দেশ ও সত্যিকারের ইসলামকে রক্ষা করতে খতিব বলেন, জঙ্গীবাদের কবল থেকে দেশ ও সত্যিকারের ইসলামকে রক্ষা করতে হবে। জঙ্গীবাদের বিরুদ্ধে অবস্থান নিতে আলেমদের নিয়ে দেশের হিন্দু, বৌদ্ধ, খীস্ট্রানসহ অন্য ধর্মালম্বীদের সঙ্গে মতবিনিময়ও করা হবে। এছাড়া এই কার্যক্রমে অংশ নিতে দেশের মসজিদ-মাদ্রাসা, ধর্মভিত্তিক রাজনৈতিক দলগুলোর নেতাদের প্রতিও আহ্বান জানিয়ে চিঠি দেয়া হচ্ছে। আলেমদের নিয়ে সন্ত্রাসবিরোধী মানববন্ধন, মহাসমাবেশের পরিকল্পনাও রয়েছে। জানা গেছে, গতবছর নবেম্বরে আইএস ও জঙ্গীবাদবিরোধী যাবতীয় কর্মকা-ের বিরুদ্ধে ভারতের এক হাজার ইমাম, মুফতি এবং ইসলামী চিন্তাবিদদের স্বাক্ষর করা একটি ফতোয়া প্রকাশ করা হয়। ওই ফতোয়া জাতিসংঘ মহাসচিবের কাছেও পাঠিয়েছিলেন তারা। ওই ফতোয়ায় বলা হয, ‘ইসলাম সন্ত্রাসের বিরুদ্ধে আর আইএস সন্ত্রাসকে উসকে দিচ্ছে। বিভিন্ন মুসলিম দেশেও ১৫ খ-ের ফতোয়াটি পাঠানো হয়েছিল। অন্য দেশের আলেমদেরও এভাবে জঙ্গীবাদের বিরুদ্ধে ফতোয়া জারি করে আহ্বানও করা হয়েছিল কখন। এরই ধারাবাহিকতায় সম্প্রতি পুলিশ সদর দফতরে আয়োজিত ‘ইসলামের দৃষ্টিতে জঙ্গীবাদ: বাংলাদেশ পরিপ্রেক্ষিত’ শীর্ষক এক মতবিনিময় সভায় জঙ্গীবাদের বিরুদ্ধে দেশের আলেমদের ফতোয়া দেয়ার পক্ষে মত দিয়েছিলেন আল্লামা ফরীদ উদ্দীন মাসউদ। সেই পরিকল্পনার অংশ হিসেবেই শুরু হয়েছে জঙ্গীবাদবিরোধী ফতোয়ায় স্বাক্ষর সংগ্রহ কার্যক্রম। কিন্তু কার্যক্রম চালাতে গিয়ে এখন জঙ্গীদের টার্গেটে পরিণত হয়েছেন খোদ আলেম সমাজই। জঙ্গী কার্যক্রমকে ‘মুসলিম তরুণদের জিহাদি জাগরণ’ উল্লেখ করে এই কার্যক্রম বন্ধ করতে ‘দরবারী আলেমদের জিহাদবিরোধী ফতোয়া আসছে’ বলে ওই ভিডিওতে বলা হচ্ছে। এই ভিডিওটিতে ফতোয়া সংগ্রহ কমিটির প্রধান ও শোলাকিয়া ঈদগার খতিব আল্লামা ফরীদ উদ্দীন মাসউদকে নিয়েও নেতিবাচক মন্তব্য করা হচ্ছে। ভিডিওটিতে শাইখ তামিম আল আদনানী নামের এক ব্যক্তির কণ্ঠে সম্ভাব্য এ ফতোয়াকে জিহাদবিরোধী উল্লেখ করে এ কার্যক্রমে অংশ না নিতে আলেমদের প্রতি আহ্বানও জানানো হয়েছে। সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ভিডিওতে বলা হচ্ছে ‘মুসলিম উম্মাহ জেগে উঠছে, নাস্তিক-মুরতাদদের বিরুদ্ধে তারা অস্ত্র হাতে ধারণ করার সংকল্প করেছে। তখনই এ জাগরণকে বন্ধ করার জন্য, মুসলমানদের ঘুম পাড়িয়ে রাখার জন্য একদল দরবারি আলেম মুনাফিকদের সরদার আব্দুল্লাহ বিন ওবায়ের এর ভূমিকায় মাঠে নেমেছে। ওই ভিডিওতে তরুণদের জাগরণকে বন্ধ করার জন্য একদল শাহবাগী আলেম মাঠে নেমেছে বলেও অভিযোগ করা হয়। ঘটনা সম্পর্কে ঐতিহাসিক শোলাকিয়া ঈদগার খতিব আল্লামা ফরীদ উদ্দীন মাসউদ বলছিলেন, জিহাদ ইসলামের একটি বিধান, আমরা সেটির বিরোধিতা করছি না। আমাদের প্রশ্ন ইসলামের জিহাদ ও সন্ত্রাস কি একই বিষয়? আমরা এ বিষয়ে আলেমদের মতামত নিয়ে ফতোয়ার কাজ করছি। ফলে এটিকে জিহাদবিরোধী ফতোয়া বলা যাবে না। তিনি আরও বলেন, ফতোয়ার ১১টি প্রশ্ন আছে। যারা একমত হচ্ছেন তারা স্বাক্ষর করছেন। প্রশ্ন রয়েছে, ইসলাম সন্ত্রাস ও জঙ্গী কর্মকা-কে সমর্থন করে কিনা। এসব বিষয়ে মত দেবেন আলেমরা। ফলে এসব অপপ্রচার তারাই করছে যারা জঙ্গীবাদকে সমর্থন করে। এসব হুমকি ধামকি অনেকদিন ধরেই পাচ্ছি। জীবনের শেষ প্রান্তে এসে এসবে আর ভয় পাই না। ইসলামী ঐক্যজোটের মহাসচিব মুফতি ফয়জুল্লাহ বলেন, ইসলাম কাউকে বিনা বিচারে হত্যা সমর্থন করে না। সন্ত্রাসী প্রক্রিয়া ইসলামে নেই। আমরা জঙ্গীবাদের বিরুদ্ধে সকল কার্যক্রম সমর্থন করি। যারা ধর্মের নামে খুন করছে তারা ধর্মের ক্ষতি করছে। জেহাদ ও সন্ত্রাসকে এক করে আসলে ইসলামের ক্ষতি করা হচ্ছে। এদিকে ফতোয়ায় স্বাক্ষর সংগ্রহ কার্যক্রম সম্পর্কে আল্লামা ফরীদ উদ্দীন মাসউদ বলছিলেস, ইতোমধ্যেই শত শত আলেম উপস্থিত হয়ে সমস্বরে জঙ্গীদের বিরুদ্ধে নিজেদের অবস্থানের কথা প্রকাশ করেছেন। সারাদেশ থেকে ফতোয়ায় আলেমদের স্বাক্ষর সংগ্রহের জন্য কেন্দ্রীয়ভাবে একটি সমন্বয় কমিটি করা হয়েছে। এ কমিটিতে আছেন মাওলানা আবদুর রহীম, মাওলানা এমদাদুল কাসেমী, মাওলানা সদরুদ্দিন মাকনুন। এছাড়া প্রতি জেলায় ‘দায়িত্বশীল’ নিয়োগ করা হয়েছে। তারা কাজের প্রয়োজনে কমিটিতে নতুন ব্যক্তিদের সম্পৃক্ত করতে পারবেন। আলেম সমাজের এই উদ্যোগকে স্বাগত জানিয়েছেন অনেক ইসলামী চিন্তাবিদ। তারা বলছেন, এটা খুব ভাল উদ্যোগ। এতে করে পরিষ্কার হবে, দেশের আলেমরা জঙ্গীবাদের বিরুদ্ধে অবস্থান নিয়েছেন। ফলে মসজিদ-মাদ্রাসার সঙ্গে জঙ্গীবাদের সম্পৃক্ততার অভিযোগ তুলে আর কোন অপপ্রচারের সুযোগ পাবে না। পাশাপাশি দেশের কোন মানুষকে ভুল বুঝিয়ে জঙ্গীবাদের পক্ষে নেয়ার পথও বন্ধ হবে। তবে সরকার বিশেষত আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর প্রতি ধর্মের নামে চলা জঙ্গীবাদী কর্মকা- বন্ধে শক্ত অবস্থান নেয়ার দাবি জানিয়েছেন দেশের খ্যাতিমান আলেমরা। তারা এজন্য জামায়াত-হেফাজত নিয়ন্ত্রিত মাদ্রাসাগুলোতে নজরদারি বাড়াতেও পুলিশকে তাগিদ দিয়েছেন। আলহাজ মাওলানা ড. আ ন ম মাহবুবুর রহমান বলছিলেন, কিছু লোক বিদেশী টাকায় ইসলাম সম্পর্কে বিভ্রান্তিকর প্রচারণা চালাচ্ছেন। মিলাদ মাহফিলকে প্রশ্নবিদ্ধ করা চেষ্টা চালাচ্ছে। কোরান হাসিদের আলোকে জঙ্গীবাদের বিরুদ্ধে প্রচারণা চালাতে হবে। জিহাদ ও জঙ্গীবাদের মধ্যে যে পার্থক্য রয়েছে, তা তুলে ধরতে হবে। মাওলানা শাহ সুফি সৈয়দ মুহাম্মদ বাহাদুর শাহ বলছিলেন, ইসলাম শান্তি, সহমর্মিতা ও সৌহাদ্যের ধর্ম। একটি মহল বিভ্রান্তি ছড়িয়ে দেশে জঙ্গীবাদ সৃষ্টি করছেন। তারাই ইসলামের শত্রু। যারা পল্টনে বলেছেন, বাংলা হবে আফগান আমরা হব তালেবান’ তারাই হচ্ছেন অরিজিনাল জঙ্গী। চাঁদপুর গাবতলা দরবার শরীফের পীর মাওলানা খাজা আরিফুর রহমান বলেন, রাষ্ট্রের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করা জঙ্গী ও খারেজিদের চরিত্র। এ জন্য মসজিদে জুমার খুতবায় জঙ্গীবাদবিরোধী বক্তব্য দিতে হবে। মাওলানা কামাল উদ্দিন আজহারী বলেন, একজন মুসলমান আরেকজন মুসলমানকে কখনও হত্যা করতে পারেন না। এটা কুফরি কাজ। বোমা মারা, গুলি করা, মুসলমান হয়ে আরেক মুসলমানকে হত্যা করা, ইসলাম ধর্মের মূল চেতনার পরিপন্থী। অন্য ধর্মের লোকদেরও হত্যা করা ইসলাম সমর্থন করে না। ইসলামে এগুলো জঘন্য অপরাধ হিসেবে স্বীকৃত। মানুষকে ভালবাসা দিয়ে পৃথিবীতে ইসলাম প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। এখানে জঙ্গীবাদের কোন স্থান নেই। জঙ্গীবাদী কার্যক্রমের জন্য বিএনপির রাজনৈতিক মিত্র জামায়াতে শক্ত হাতে মোকাবেলার পরামর্শ দিয়েছেন অনেক ইসলামী চিন্তাবিদ। সারাদেশের ‘জামায়াত ও তাদের মদদপুষ্ট ইমামদের তালিকা তৈরির আবারও পরামর্শ দিয়ে আলেমরা বলছেন, যেসব ইমাম ইসলামের নামে জঙ্গীবাদের উস্কানি দিয়ে বক্তব্য দেন, তালিকা থাকলে তাদের শনাক্ত করা সম্ভব হবে। মানবতাবিরোধী অপরাধী যুদ্ধাপরাধী জামায়াত নেতা মুজাহিদের ফাঁসির পর যেসব মসজিদের ইমামরা তার জন্য দোয়া ও কান্নাকাটি করেছেন, তাদের চিহ্নিত করতে হবে।
×