ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৯ মার্চ ২০২৪, ১৫ চৈত্র ১৪৩০

শামস তিবরিজ

নেতাজী রহস্য আজও অবগুণ্ঠনেই থাকল

প্রকাশিত: ০৬:৫০, ১০ ফেব্রুয়ারি ২০১৬

নেতাজী রহস্য আজও অবগুণ্ঠনেই থাকল

স্বাধীন ভারতের প্রতিষ্ঠাতা পুরুষদের প্রতি পাশ্চাত্যের যে শ্রদ্ধাবোধ তা সাধারণত দুজন ব্যক্তির মধ্যে সীমাবদ্ধ। একজন মোহন দাস করমচাঁদ গান্ধী, অন্যজন জওহরলাল নেহরু। একজন ধুতি পরিহিত শান্তিবাদী, অন্যজন ক্যাম্ব্রিজ শিক্ষিত, মার্জিত রুচিবোধসম্পন্ন। এদের বিপরীতে যে মানুষটি ভারতবাসীর হৃদয়ে বিশেষ শ্রদ্ধার আসনে প্রতিষ্ঠিত তিনি নেতাজী সুভাষচন্দ্র বসু। ইনি ছিলেন রেডিক্যালপন্থী। ব্রিটিশদের বিরুদ্ধে তিনি অস্ত্র ধারণ করেছিলেন এবং দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে অক্ষশক্তির পক্ষ নিয়েছিলেন। যুদ্ধের শেষ পর্যায়ে ১৯৪৫ সালে তিনি জাপান অধিকৃত তাইওয়ানে এক বিমান দুর্ঘটনায় মারা যান। ব্রিটিশরা যতই তাঁকে অক্ষশক্তির পদলেহী বলে ধিক্কার দিক, তাঁর শৌর্যবীর্য ও বীরত্ব আজও ভারতীয়দের অনুপ্রাণিত করে। তাঁর জন্মভূমি বাংলার অনেক স্থান তাঁর নামে নামাঙ্কিত। তার পরও ভারতে সুভাষ বসুুর জীবন কাহিনীর কিছু অংশ আজও গোপনীয়তার মোড়কে ঢাকা। ধারণা করা হয় সে জাতীয় নিরাপত্তার কারণেই তা করা হয়েছে। তবে গত ২৩ জানুয়ারি নেতাজীর জন্মবার্ষিকী উপলক্ষে নরেন্দ্র মোদি সরকার তাঁর ওপর সরকারী সংগ্রহ শালায় রক্ষিত এক শ’টি ফাইল অবমুক্ত করে। এতে অবশ্য তেমন কোন চাঞ্চল্যকর তথ্য প্রকাশ পায়নি। এর আগে গত সেপ্টেম্বর মাসে পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী তৃণমূল কংগ্রেস নেত্রী মমতা ব্যানার্জি রাজ্য সরকারের হাতে সুভাষ বসুর ওপর যত ফাইল ছিল সবই অবমুক্ত করেন। সেই ফাইলগুলো থেকে বহুল আলোচিত এই তথ্যটাই মূলত প্রতিষ্ঠিত হয় যে কংগ্রেস সরকার ১৯৫০ ও ১৯৬০-এর দশকে বসু পরিবারের ওপর গুপ্তচরবৃত্তি চালিয়েছিল। স্বভাবতই এই সামান্য তথ্যে বাঙালীদের হৃদয় তৃপ্ত হয়নি। তারা আশা করেছিল আরও অনেক নাটকীয় তথ্য প্রকাশ পাবে। সুভাষ বসুর মৃত্যু নিয়ে যে রহস্যের অবগুণ্ঠন রয়েছে তা উন্মোচিত হবে। কিন্তু কিছুই হয়নি। সুভাষ রহস্য পুরুষই থেকে গেলেন। এক পর্যায়ে তিনি মিত্রশক্তির চোখ ফাঁকি দেয়ার জন্য থাইল্যান্ডে এক ভিক্ষুর ছদ্মবেশ ধারণের কথা ভেবেছিলেন। ইতোপূর্বে ১৯৪১ সালে কলকাতায় অন্তরীণ থাকা অবস্থায় ব্রিটিশদের চোখ ফাঁকি দিয়ে দুঃসাহসিক এক অভিমানে আফগানিস্তান হয়ে বার্লিনে পালিয়ে গিয়ে দারুণ চাঞ্চল্য সৃষ্টি করেন এবং খ্যাতির তুঙ্গে পৌঁছান। পরবর্তীকালে জার্মানি থেকে সাবমেরিনে করে আফ্রিকার মাদাগাস্কারে আসেন এবং একই সময় জাপানের এক সাবমেরিন এসে তাঁকে তুলে নিয়ে প্রশান্ত মহাসাগরীয় রণাঙ্গনে পৌঁছে দেয়। দ্বিতীয় মহাযুদ্ধে দুই দেশের সাবমেরিনে কোন সিভিলিয়ান বিনিময়ের এটাই প্রথম ও একমাত্র ঘটনা। জাপানের আত্মসমর্পণের পরবর্তী দিনগুলোতে ভারতে প্রত্যাবর্তনের লক্ষ্য নিয়ে তিনি কি চীন অথবা রাশিয়ায় গিয়ে থাকতে পারেন? সে ধরনের পরিকল্পনা কি তাঁর ছিল? বিমান দুর্ঘটনায় মৃত্যু কি সত্যি ঘটেছিল? নাকি তা ঘটনামাত্র? তিনি কি আসলে কোন সন্ন্যাসীর ছদ্মবেশে ভারতেই রয়ে গেছে? দুটো আশ্রম তো তাঁকে নিয়ে এমনই দাবি করে থাকে। সবই বাজে কথা। বলেছেন কৃষ্ণা বসু যিনি একজন প্রাক্তন এমপি এবং নেতাজীর প্রিয় ভ্রাতুষ্পুত্রের বিধবা স্ত্রী। ১৯৪১ সালে নেতাজী যে গাড়িতে করে পালিয়েছিলেন সেই জার্মান রোডস্টার গাড়িটি তাঁর এই ভ্রাতুষ্পুত্রই চালিয়েছিলেন। কলকাতায় কৃষ্ণা বসু পরিচালিত নেতাজী রিসার্চ ব্যুরোর সামনে সেই গাড়িটি আজও সঙ্কলিত আছে। কৃষ্ণা বসু বলেন সব বাজে কথা। নেতাজীকে নিয়ে কোন রহস্যের অস্তিত্ব নেই। তিনি আততায়ীর হাতে মারা যাননি। তার মৃত্যু হয়েছিল বিমান দুর্ঘটনায় এবং ওটা ছিল স্রেফ দুর্ঘটনাই। তাহলে দিল্লীতে একের পর এক ক্ষমতায় আসা সরকারগুলো কেন নেতাজীর ফাইলগুলো তালাবদ্ধ অবস্থায় রেখে দিয়েছিল? হয়ত ওগুলো নেহরু ও কংগ্রেস উভয়ের জন্য বিব্রতকর হতো। ২০১৪ সালের জানুয়ারি মাসে নির্বাচনী প্রচারের সময় বিজেপি ঘোষণা দিয়েছিল ক্ষমতায় এলে তারা সমস্ত ফাইল অবমুক্ত করবে। এখন অবমুক্তই যখন করল তখন এত সামান্য তথ্য বের হলো কেন? নেতাজী ও নেহরুর ইতিহাস রচয়িতা রুদ্রংসু মুখোপাধ্যায় বলেছেন যে বিজেপির আরেক হিরো বল্লভভাই সরদার প্যাটেল নেতাজী দারুণ অপছন্দ করতেন। অথবা হয়ত এই যে নেতাজী সম্পর্কে খানিকটা অজ্ঞতা বজায় রাখলে লাভই আছে। মোদি সরকার প্রকাশিত এক শ’ কথা ফাইলের একটিতে দেখা যায় যে টোকিওর রেনকোজি মন্দিরে রক্ষিত নেতাজীর দেহভশ্ম স্বদেশে পাঠানোর ব্যবস্থা করার জন্য টোকিওর ভারতীয় দূতাবাসের ওপর চাপ ছিল। সে সময় ভারতীয় আমলারা অভিমত দিয়েছিল যে এতে করে জনগণের কোন কোন অংশ যারা বিমান দুর্ঘটনায় নেতাজীর মৃত্যুর কথাটা বিশ্বাস করতে রাজি নয় তাদের মধ্যে বিরূপ প্রতিক্রিয়া হতে পারে। এ কারণে এ ব্যাপারে কিছু করতে না যাওয়াই শ্রেয়। কৃষ্ণা বসু জীবনের অধিকাংশ সময় ঐতিহাসিক নথিপত্র সংগ্রহ ও সংরক্ষণ করে কাটিয়েছেন। তিনি দুঃখ প্রকাশ করে বলেন যে রাজনীতিকরা বাস্তব ঘটনা নিয়ে এখনও আজেবাজে কথা বলে চলেছেন। সূত্র : দি ইকোনমিস্ট
×