(১০ ফেব্রুয়ারির পর)
এও এক ধরনের প্রতিবাদ যা কখনো স্বীকৃত হয়নি। কর্নেল মঈনুল সরোয়ার ও আনোয়ারকে নিয়ে সাভারে যান ১৭ তারিখ। তিনি সবাইকে শান্ত থাকতে বলেন। মনজুর তখন দিল্লি থেকে ফিরে জিয়ার সঙ্গে ছায়ার মতো ঘোরাফেরা করছেন।
এ প্রসঙ্গে ওসমানীর কথা বলা যেতে পারে। ওসমানী সম্পর্কে নানা মিথ তৈরি করা হয়েছে। কিন্তু বিভিন্ন সময় বিভিন্ন মন্তব্যে তার মনের ভেতরের কথা বেরিয়ে আসে। সেই কাকুল কালচার বা কাকুল সংস্কৃতির সব ধারক-বাহক।
ওসমানীর সঙ্গেও দেখা হয়েছিল আনোয়ার উল আলমের। তিনি সরোয়ার ও আনোয়ারকে দেখামাত্র যে প্রশ্নটি করলেন তা হলো-
“ঐড়ি সধহু ঐরহফঁং ধৎব ঃযবৎব রহ জধশযযর ইধযরহর?”
এই একটি মন্তব্যই যথেষ্ট। আনোয়ার লিখেছেন, “মাত্র বছরখানেক আগেই তিনি সিলেটের একটি হিন্দু ছেলেকে লিডার পদে নিয়োগের জন্য আমাদের পরিচালককে অনুরোধ করেছিলেন।” [পৃ. ১৬৪]
৩ নভেম্বর যে অভ্যুত্থান হয় তার পরিকল্পনা করেছিলেন, লিখেছেন আনোয়ার, রক্ষীবাহিনীর প্রাক্তন প্রধান নুরুজ্জামান, খালেদ মোশাররফ, শাফায়াত জামিল প্রমুখ। তারা চেয়েছিলেন মোশতাককে ক্ষমতাচ্যুত করতে। অভ্যুত্থান সফল হতো কিন্তু “খালেদ মোশাররফ শুধু সেনাপ্রধান হয়েই খুশি ছিলেন না। তিনি মোশতাক ও ওসমানীর সঙ্গে সমঝোতা করে রাষ্ট্রপ্রধান হতে চাচ্ছিলেন। এ পরিপ্রেক্ষিতে আনোয়ার লিখেছেন, আমার ব্যক্তিগত ধারণা, খালেদ মোশাররফ তার গোপন ব্যক্তিগত কৌশল ও উচ্চাকাক্সক্ষা বাস্তবায়ন করতে গিয়ে অভ্যুত্থানের মূল উদ্দেশ্য থেকে বিচ্যুত হন। এতে তিনি শুধু নিজের বিপদ ডেকে আনেননি, তাঁর সঙ্গীদেরও বিপদের দিকে ঠেলে দেন। নিজে একজন দেশপ্রেমিক ও অসাধারণ মুক্তিযোদ্ধা হয়েও দুর্নাম কুড়ান এবং জীবন দেন ভারতের চর হিসেবে আখ্যায়িত হয়ে। যদিও তিনি ছিলেন চরম ভারতবিদ্বেষী।” [পৃ. ১৭৮]।
এরপর জিয়াউর রহমানের উদ্যোগে রক্ষীবাহিনীকে সেনাবাহিনীর সঙ্গে আত্তীকরণ করা হয়।
॥ ১৮ ॥
জেনারেল শফিউল্লাহ এবং অন্য সেনা কর্মকর্তাদের বয়ান থেকে কয়েকটি বিষয় সুস্পষ্ট হয়ে ওঠে।
সেনাবাহিনীর মাঝারি/জুনিয়র পর্যায়ের কর্মকর্তারা তাদের সমপর্যায়ের অবসরপ্রাপ্তরেদর নিয়ে ষড়যন্ত্র করেন। এতে বিদেশি শক্তির প্ররোচনা ও প্রশ্রয় ছিল, বিশেষ করে পাকিস্তানের। সেনা কর্মকর্তাদের মধ্যে যারা সিনিয়র ছিলেন, বিশেষ করে যাদের অবস্থান ছিল ঢাকায়, তাদের অনেককেই এই ষড়যন্ত্রের বিষয়টি জানানো হয়েছিল। তারা প্রত্যক্ষভাবে খুনোখুনিতে সাড়া দেননি হয়তো কিন্তু ষড়যন্ত্রের বিষয়ে ঊর্ধ্বতন মহলে জানাননি, প্রশ্রয় দিয়েছেন। মুক্তিযুদ্ধ ফেরত কর্মকর্তা ও পাকিস্তান ফেরত কর্মকর্তা বা অন্য কথায় কাকুল সংস্কৃতির উদ্যোগেই এই হত্যাকাণ্ড হয়। কাকুলিয়ানরা কখনই পুরোপুরি বাঙালি মনের হতে পারেননি। বঙ্গবন্ধু হত্যায় মুক্তিযুদ্ধ ফেরত কর্মকর্তাদের মধ্যে জেনারেল জিয়া অগ্রণী ভূমিকা পালন করেছেন [খুনি ও তাদের সহযোগীরা ছাড়া]। মুক্তিযুদ্ধ ফেরত খালেদ মোশাররফ বিষয়টি জানতেন, প্রাথমিক সংঘর্ষ এড়িয়ে, জিয়াকে এলিমিনেট করে তিনি ক্ষমতা করায়ত্ত করতে চেয়েছিলেন। অন্যান্য মুক্তিযুদ্ধ ফেরত তাহের, মনজুর, শাফায়াত জামিলও ষড়যন্ত্রের কথা জানতেন। তাহের সরাসরি বঙ্গবন্ধু সরকারকে উৎখাত করতে চেয়েছেন এবং জিয়ার পক্ষে ছিলেন। মনজুর জানতেন দেখেই ১৫-১৬ আগস্ট ঢাকা চলে আসেন। তিনিও জিয়ার পক্ষে ছিলেন। শাফায়াত জামিল খালেদের মতো গা বাঁচিয়ে পরে ক্ষমতার দ্বন্দ্বে অবতীর্ণ হতে চেয়েছেন। এরশাদও জানতেন এবং জিয়ার পক্ষে ছিলেন যে কারণে জিয়া তাকে স্থলবাহিনীর প্রধান করেছিলেন। ডিএফআইয়ে রউফেরও ইন্ধন ছিল। গুরুত্বপূর্ণ খবরাখবর তিনি রাষ্ট্রপতিকে জানাতেন কিনা সন্দেহ।
আশ্চর্য জেনারেল ওসমানী এই হত্যায় দুঃখিত হননি। এবং তিনিও ইন্ধন জুগিয়েছেন সেনা বিশৃঙ্খলায়। পরে মোশতাক-জিয়াকে সমর্থন করেন।
এই ষড়যন্ত্রে জেনারেল শফিউল্লাহ ছিলেন না। বঙ্গবন্ধুর লোক হিসেবে তাকে জিয়া থেকে যড়যন্ত্রকারীরা এবং অন্যরা বিশ্বাস করতেন না। সেনাবাহিনীর কর্মকর্তাদের ওপরও তার নিয়ন্ত্রণ ছিল না। অনেক ক্ষেত্রে যে দৃঢ় ভূমিকা বা সিদ্ধান্ত নিতে হয় তা তিনি পারেননি, দ্বিধান্বিত ছিলেন। ডালিমের ক্ষেত্রে, ডালিমকে জেনেও তার প্রতি তার যে স্নেহপূর্ণ মনোভাব বোঝা যায় তার লেখা পড়ে তাতে খানিকটা অবাক হতেই হয়। বঙ্গবন্ধুকে বাঁচাতে পারেননি বা চেষ্টা করেননি বলে তাকে হেয় করার চেষ্টা করা হয়। কিন্তু বোঝা দরকার, সেনাবাহিনী তার নিয়ন্ত্রণে ছিল না, কমান্ড করার মতো অবস্থাও তার ছিল না। বিপর্যস্ত খানিকটা ছিলেন তো বটেই। বঙ্গবন্ধু হত্যা মামলার এক সাক্ষী উল্লেখ করেছেন, তিনি ফারুক রহমানকে জিজ্ঞেস করলেন, কোথায় যেতে হবে। ফারুক বললেন “স্বৈরাচারী সরকারকে উৎখাত করতে যাব। তিনি জিজ্ঞেস করলেন, জেনারেল শফিউল্লাহ কি তা জানেন। ফারুক উত্তরে জানালেন, তার প্রয়োজন নেই। [ঃযবৎব ধিং হড় হবপবংংরঃু]. [বঙ্গবন্ধু হত্যা মামলার রায়, বিচারপতি মোহাম্মদ রুহুল আমিন, পৃ. ৩৯, ইখঞ. ২০০১]
অনেকে বিস্মিত হতে পারেন এই ভেবে যে, মুক্তিযুুদ্ধ ফেরত সেনা কর্মকর্তারা কীভাবে সপরিবারে বঙ্গবন্ধু হত্যায় প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে জড়িয়ে পড়লেন। এ বিষয়ে বিস্তারিত লিখেছি আমি বাংলাদেশি জেনারেলদের মন গ্রন্থে, তাই এখানে আর পুনরাবৃত্তি করলাম না। কাকুল প্রশিক্ষিত কেউ-ই আসলে মনেপ্রাণে বাঙালি হতে পারেননি, বাঙালির নেতা বঙ্গবন্ধুকেও মানতে পারেননি। তারা এমন নেতা চেয়েছেন যিনি তাদের কথায় চলবেন।
চলবে...
শীর্ষ সংবাদ: