ঢাকা, বাংলাদেশ   শনিবার ২০ এপ্রিল ২০২৪, ৭ বৈশাখ ১৪৩১

স্বামী অবিচলানন্দ

সরস্বতী দেবী ও নারী সমাজ

প্রকাশিত: ০৩:৫২, ১২ ফেব্রুয়ারি ২০১৬

সরস্বতী দেবী ও নারী সমাজ

নানা আকারে-প্রকারে মাতৃ-দেবীর আরাধনা কমবেশি সকল সমাজেই ছিল। প্রাগৈতিহাসিক যুগ থেকে এ দেবীপূজা প্রচলিত। বৈদিক যুগেও দেবীপূজা প্রচলিত ছিল। মাঘ মাসের শুক্লা পঞ্চমী তিথিতে বাঙালী সমাজেও দেবী সরস্বতী পূজা উপলক্ষে নতুন সাজে সজ্জিত হয়। প্রতিটি শিক্ষাঙ্গন ও ঘর উৎসবে মুখরিত হয়। বিদ্যার্থীরা তাদের আরাধ্য দেবীকে বরণ করার জন্য কৌতূহলী। এ পূজা জাতি-ধর্ম-বর্ণ-নির্বিশেষে বাঙালীর তথা বিদ্যার্থীদের জাতীয় উৎসবে পরিগণিত। আজ সবাই কি যেন এক বিশেষ আনন্দে আত্মহারা। ‘ব্রাহ্মমুহূর্তে আবাহন সম্পন্ন হয় দেবীর, শঙ্খে শঙ্খে সমাদরে। সদ্য প্রস্ফুটিত পলাশ ও কুন্দ ফুল দিয়ে হবে তাঁর পূজা। বিদ্যার দেবী সরস্বতী, তার বাহন হংসসহ সমভিব্যাহারে দেবী আসছেন। আমরা রোমাঞ্চিত হৃদয়ে শ্রদ্ধা ও ভালবাসার পুষ্পাঞ্জলি লয়ে তাঁর শ্রীচরণ দর্শনের প্রত্যাশায় অপেক্ষমাণ। তাঁকে কেন্দ্র করে আমাদের অন্তরে আজ অপরিমেয় আনন্দ-অনুভূতির উদ্ভাস। পলাশ, কুন্দ প্রভৃতি নানা ফুলের ঘ্রাণে প্রকৃতি আজ নতুন সাজে সজ্জিত। তাঁর সে আগমনী বার্তা নিনাদিত হচ্ছে অনল অনিলে চির নভোনীলে। শাস্ত্রে রয়েছে- ‘সাধকানাং হিতার্থায় ব্রহ্মণো রূপকল্পনা’- সাধকদের হিতের জন্য ব্রহ্মের নানাপ্রকার রূপ পরিকল্পিত হয়। ফলত রূপ পরিকল্পনার তথা বাহ্য পূজার একটি দার্শনিক তত্ত্ব উপনিহিত রয়েছে। উক্ত তত্ত্বের মাধ্যমে আমরা বাহ্যপূজার প্রয়োজন, উপযোগিতা এবং ফল সম্বন্ধে সম্যক ধারণা লাভ করব। শাস্ত্রে আরও রয়েছে, ‘যা দেবী সর্বভূতেষু মাতৃরূপেণ সংস্থিতা’Ñ যে দেবী সর্বপ্রাণীতে মাতৃরূপে অবস্থিতা তাঁকে নমস্কার। তবুও যে যুগে আমরা বাস করছি দুর্ভাগ্যবশত তা স্বার্থপরতা, হিংসা, মিথ্যাচরণ ও সংঘর্ষে ক্রমাগত আন্দোলিত। সুস্থ চিন্তাশীল, হৃদয়বান মানুষ আজ সন্ত্রস্ত, সংক্ষুব্ধ। এমতাবস্থায় ঘন মেঘের আঁধার ভেদ করে শীতে সূর্যের প্রকাশের মতোই আমাদের সংশয়দীর্ণ হৃদয়ে দিব্যোজ্জ্বল আত্মপ্রকাশ করছেন বিদ্যার দেবী সরস্বতী। আমরা যদি বিদ্যার দেবীর আদর্শকে অর্থাৎ আমাদের ভিতরকার অজ্ঞাননাশকারিণী, জ্ঞানপ্রদায়িনী দেবীকে বুঝতে পারি, নিজেদের মধ্যে ধারণ করতে পারি তবেই হবে আমাদের সার্বিক কল্যাণ। সকলেই নিশ্চয় মায়ের জীবন আদর্শের মধ্যে শান্তির বার্তা খুঁজে পাবেন এবং নিজেদের প্রকৃত মানুষ হিসেবে গড়ে তুলবেন। মায়ের কাছে এ প্রার্থনা জানাবেন : ‘মা আমাদের মানুষ কর।’ আমরা বিদ্যার দেবীর শ্রীচরণে প্রার্থনা জানাচ্ছি- তিনি যেন আমাদের অন্তরের ভিতরকার মলিনতারূপ অজ্ঞান শক্তিকে বিনাশ করে শুভশক্তির উদ্বোধন করুন। আমরা যেন সাম্য, মৈত্রী, অহিংসা ও পরার্থপরতার অগ্নিমন্ত্রে দীক্ষিত হয়ে তাঁর সুসন্তানরূপে নিজেদের পরিচয় দিতে পারি। নিছক উৎসব-আড়ম্বরে মত্ত না হয়ে আমরা যেন আমাদের অন্তরে এই বিদ্যাশক্তির উদ্বোধনে নিয়ত ব্যাপৃত থাকতে পারি। সেই সঙ্গে মায়ের কাছে আকুল আর্তি, সাম্প্রতিক বিপর্যয়ে বিধ্বস্ত মানুষরা যেন পুনরায় সুস্থ সুন্দর জীবনে ফিরে আসতে পারে, তাদের দুঃখে আমরাও যেন মর্মে মর্মে সমবেদনা অনুভব করি। সরস্বতী দেবীর মানবীরূপ শ্রীমা সারদাদেবী বলেছেন : ‘নির্বাসনা প্রার্থনা করতে হয়। কেননা বাসনাই সকল দুঃখের মূল, বারবার জন্ম-মৃত্যুর কারণ, আর মুক্তিপথের অন্তরায়। তাই হে জীব শরণাগত হও, কেবল শরণাগত হও।’- তাঁর কাছে আমাদের সকলের একান্ত প্রার্থনা- জীবনের প্রতিটি দিন ও মুহূর্ত আমরা যেন নিজ নিজ অন্তরে ভক্তি, শ্রদ্ধা ও ভালবাসার অর্ঘ্য নিয়ে তাঁর পূজায় নিরত থাকতে পারি। ঞযব নবংঃ ড়ৎহধসবহঃ ড়ভ ধ ড়িসবহ রং যবৎ সড়ফবং : - একজন নারীর সবচেয়ে বড় অলঙ্কার হচ্ছে তার মাতৃত্ব।- শ্রীসারদাদেবী আজকের দিনে এ এক অপ্রিয় সত্য- ঘরে ঘরে সন্তান মাকে পায় না আদর্শ মায়ের মতন করে। বিদ্যালয়ে বিশ্ববিদ্যালয়ে বিদ্যার্থী শিক্ষককে পায় না স্নেহময়, আদর্শবান, নিঃস্বার্থ ছাত্রবৎসলরূপে। অতিমাত্রায় স্বার্থ-সচেতন মানুষ প্রয়োজনের তাগিদে হারিয়ে ফেলেছে স্নেহের চিরন্তন নীড়টুকু। যুগের চিত্র যে এত দ্রুত বদলে যাবে তা কে বা জানত? তাই তো মা আমার যুগের প্রয়োজনে আসা যুগাবতারের লীলাসঙ্গিনী চিরকালের মা। মহাশক্তি, কিন্তু এক শান্ত মাতৃমূর্তিতে সুস্থির। যেন মাটির কলসিতে ভরা অমৃত রস, সঞ্জীবনী সুধা। সে মাতৃভাবের অমৃত বিতরণে -জাগাতে-শালীত করতে নারী শক্তিরূপে এবারে এলেন জননী সারদা। পৌরাণিক গল্পে পাই, দেবাসুর সমুদ্রমন্থনের পর অমৃতের কলসটি হরণ করে অসুরদের বঞ্চিত করবেন বলে বিষ্ণু ধারণ করেছিলেন মোহিনী মূর্তি। এবার দেব ও অসুর, সৎ ও অসৎ- কাউকে বঞ্চিত করবেন না, তাই তাঁর জননী মূর্তি- সকলেই সন্তান। শ্রীমা সারদা দেবীর জীবন ও বাণী নিয়ে নতুন করে নারী জাতির ভাবার সময় এসেছে। পৃথিবীর নারী ইতিহাসে সীতা-সাবিত্রী উজ্জ্বল নক্ষত্র। শ্রীমা সারদার আন্তরসৌন্দর্য, আত্মমর্যাদাবোধ সীতা-সাবিত্রীর ঔজ্জ্বল্যকে অতিক্রম করে গেছে। বর্তমান যুগের মেয়েদের সে আত্মমর্যাদাবোধের নতুন করে অনুসন্ধান প্রয়োজন। শ্রীরামকৃষ্ণ বলেছেন, ও সারদা, সরস্বতী জ্ঞান দিতে এসেছে। ও কি যে সে ও আমার শক্তি। স্বামী বিবেকানন্দের গঠনমূলক শিক্ষা ভাবনা ছিল- জনসাধারণের মধ্যে শিক্ষাবিস্তার করতে হবে। তার ধারণা অতিক্রম করে আজ আমরা বাণিজ্যিক শিক্ষা, ভোগবাদী শিক্ষার মুখোমুখি। ভোগবিলাসের স্রোতে শিক্ষার সংযমের ইতিবাচক দিকটি অপসৃত- নারীরা ভেসে যাচ্ছে ভোগবিলাসের প্রবল স্রোতে। সনাতন ধর্মাবলম্বী মায়েদের হাতে শাঁখা, সিঁথিতে সিঁদুর ও লোহার বালা ধারণের আধ্যাত্মিক কারণ হলো- সত্ত্ব, রজঃ ও তমঃ তিনটি গুণের প্রতীক এ তিনটি জিনিস। সত্ত্বগুণ সম্পন্ন শাঁখা সাদা বর্ণের, রজোগুণ সম্পন্ন সিন্দুর লাল বর্ণের এবং তমোগুণ স¤পন্ন লোহা কালো বর্ণের। সংসার আশ্রমে মায়েরা এ তিনটি গুণের অধীন হয়েই সংসার ধর্ম পালন করেন। তারা বিয়ের পর স্বামী সেবা করে পরমার্থ লাভের সাধনা করেন সত্ত্বগুণের প্রভাবে। সংসার ধর্ম পালন করেন রজোগুণের প্রভাবে এবং তমোগুণকে প্রতিহত করেন সত্ত্ব ও রজের যৌথ শক্তিতে। আমাদের আরও প্রার্থনা- বাংলার প্রতিগৃহে বিদ্যার দেবীর আরাধনা প্রবর্তিত হোক। ভক্তগণের চিত্তশুদ্ধি ও ভক্তিলাভ হোক। - হে অজ্ঞাননাশিনী, হে বিদ্যাদাত্রী দেবী তোমাকে প্রণাম করি। ওঁ ভদ্রকাল্যৈ নমো নিত্যং সরস্বত্যৈ নমো নমোঃ। বেদ-বেদান্ত-বেদাঙ্গ বিদ্যাস্থানেভ্যঃ এব চঃ ॥ লেখক : সন্ন্যাসী মহারাজ, রামকৃষ্ণ মঠ ও রামকৃষ্ণ মিশন, ঢাকা।
×