ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৯ মার্চ ২০২৪, ১৫ চৈত্র ১৪৩০

যে কারণে জাগুয়ার এখনও বিলুপ্ত হয়নি

প্রকাশিত: ০৭:০৫, ১২ ফেব্রুয়ারি ২০১৬

যে কারণে জাগুয়ার এখনও বিলুপ্ত হয়নি

ম্যাসটোডন, গ্রাউন্ড শ্লথ, স্যাবারক্যাট এদের কারোর কোন অস্তিত্ব নেই। সবই বিলুপ্ত হয়ে গেছে ১০ হাজার বছর কি তারও আগে। সেই সঙ্গে বিলুপ্ত হয়ে গেছে আরও নানা ধরনের অদ্ভুত অদ্ভুত সব প্রাণী ও পাখিরা যারা ‘মেগাফনা’ শ্রেণীভুক্ত ছিল। তবে মেগাস্তন্যপায়ী প্রাণীদের সবাই যে বিলুপ্ত হয়ে গিয়েছিল তা নয়। যারা হয়নি তাদের অন্যতম জাগুয়ার। বলাবাহুল্য এই বিলুপ্তির অধ্যায়টা ছিল শেষ বরফ যুগ। জাগুয়াররা কেন বিলুপ্তির হাত থেকে রক্ষা পেল? এর একটা কারণ আছে। জাগুয়ার হলো মার্জার জাতের পুরনো প্রাণী। এদের প্রথম আবির্ভাব ঘটেছিল প্রায় ৩০ লাখ বছর আগে ইউরেশিয়ায়। এরা পৃথিবীর পূর্ব ও পশ্চিম দুই দিকেই ছড়িয়ে পড়েছিল। অবশেষে ইংল্যান্ডের দক্ষিণাঞ্চল থেকে নেব্রাস্কা এবং নিচে দক্ষিণ আমেরিকা পর্যন্ত বিরাট তল্লাটজুড়ে তারা বসবাস করতে থাকে। আজ তাদের আবাসস্থল হলো দক্ষিণ এরিজোনা থেকে আর্জেন্টিনা পর্যন্ত প্রায় ৩৪ লাখ বর্গমাইল এলাকা। বরফ যুগের আগে তাদের এলাকার যে বিস্তার ঘটেছিল এটা তার অতি সামান্য অংশ মাত্র। জাগুয়ারের বিচরণ এলাকারই শুধু যে সংকোচন ঘটেছে তা নয়। প্লেইস্টোসিন যুগে তাদের পূর্বপুরুষদের তুলনায় এরা আজ আকারের দিক দিয়েও প্রায় ১৫ শতাংশ ছোট হয়ে এসেছে। তারপরও কথা হলো জাগুয়াররা টিকে আছে। অন্যদিকে আমেরিকান সিংহ স্যাবারক্যাট ও অন্য শিকারী প্রাণীরা বিলুপ্ত হয়ে গেছে। কেন? এই প্রশ্নের জবাব খুঁজে পওয়ার জন্য জীববিজ্ঞানী ম্যাট হেওয়ার্ড ও তার সহকর্মীরা জাগুয়ারের খাদ্য এবং কিভাবে প্রাণীটির শিকারের ক্ষেত্রে অগ্রাধিকারগুলো কালের প্রবাহে পরিবর্তিত হয়েছে সেগুলো পরীক্ষা করে দেখেন। জাগুয়ারের বধ করা ৩২১৪টি প্রাণীর সচিত্র বিবরণ সংবলিত ২৫টি প্রকাশিত সমীক্ষার তথ্য বিশ্লেষণ করে হাওয়ার্ড ও তার দল দেখতে পেয়েছেন যে, হিংস্র ধরনের শিকারী প্রাণীদের মধ্যে জাগুয়াররা যথেষ্ট খুঁতখুঁতে স্বভাবের। এদের খাদ্যের তালিকার মধ্যে রয়েছে গরু, ছাগল, মহিষ থেকে শুরু করে ইঁদুর, বানর ও কচ্ছপ পর্যন্ত ১১১ প্রজাতির প্রাণী। কিন্তু গবেষণাপত্রে যা লেখা হয়েছে হাওয়ার্ড ও তার দল দেখতে পেয়েছেন যে বাস্তব অবস্থা প্রায়শই তার উল্টো। জাগুয়ার সর্বভুক প্রাণী নয় যে যা পায় তাই শিকার করে খায়। তারা দেখেছেন যে জাগুয়ারের ডায়েটের সবচেয়ে প্রচলিত অংশ হলো ক্যাপিবারা, বুনো শুকর, কেইমান, পেকারি, আর্নাডিলো, পিপীলিকাভুক, কোয়াটি ইত্যাদি। এগুলো জাগুয়ারের ডায়েটের ১৬ থেকে ২১ শতাংশ। পরিসংখ্যানে আরও দেখা গেছে যে পেকারি, হরিণ, পিপীলিকাভুক ও কোয়াটিস প্রাণীগুলো ৮৫ শতাংশ সময় শিকার করা হয় যখন সেগুলো জাগুয়ারের পাল্লার মধ্যে উপস্থিত থাকে। শিকারের তালিকাটি আরও ছেঁটে গবেষকরা দেখতে পেয়েছেন যে, জাগুয়াররা বিশেষভাবে টার্গেট করে ক্যাপিবারা ও জার্সেন্ট এ্যান্টইটার বা বৃহৎ পিপীলিকাভুক প্রাণী দুটিকে। অনদিকে জাগুয়াররা কখনই টাপির এবং বলতে গেলে কখনই প্রাইমেট যথা বানর, শিল্পাঞ্জী ইত্যাদি প্রাণীর শিকার করেন। জাগুয়ার লেপার্ড বা চিতাবাঘের তুলনায় হৃষ্টপুষ্ট। তথাপি তারা অল্প কয়েক শ্রেণীর পাণীই কেবল শিকার করে থাকে যেগুলো তারা সামলাতে পারবে। প্রাণীটির আকার যে কিছুটা ছোট হয়ে গেছে এটা তার একটা কারণ হতে পারে। এককভাবে টাপির শিকার করার মতো বড় প্রাণী জাগুয়ার নয়। হরিণ তারা শিকার করতে পারে। কিন্তু মানুষ হরিণ মেরে মেরে সংখ্যাটা কমিয়ে ফেলায় এই তৃণভোজী প্রাণীটি এতই দুষ্প্রাপ্য হয়ে পড়েছে যে এর ওপর আর নির্ভর করা চলে না। কাজেই আকারে বড় হওয়া সত্ত্বেও জাগুয়ার ছোট ছোট শিকারই বেছে নেয়। এই ছোটখাটো শিকারগুলোর অভাব কখনই হয়নি। মানুষ ও অন্য প্রাণীরা এদেরকে খুব একটা বধ করে না বলে জাগুয়ারের এই খাদ্যের তেমন একটা অভাব হয় না। বিবর্তনের মধ্য দিয়ে জাগুয়াররা এভাবেই তাদের আহার্য বস্তু বেছে নিয়েছে বলে খদ্যাভাবে তাদের তেমন সঙ্কটে পড়তে হয়নি। অবশ্য জাগুয়ার এদিক দিয়ে একা নয়। কয়োটদেরও একই ধরনের পরিবর্তন ঘটে গেছে। এই মাংসাশী প্রাণীটিও বরফ যুগের ধকল সামলে নিয়ে টিকে থেকেছে। বরফ যুগের সময় তারা আকারে বেশ বড় ছিল। তাদের সকল প্রতিদ্বন্দ্বী প্রাণী বিলুপ্ত হয়ে যাওয়ায় কয়োটদের আর বড় থাকার প্রয়োজন পড়েনি। সে কারণে আকারে তারা ছোট হয়ে আসে এবং যেসব প্রাণী মানুষ ও অন্যদের শিকার সাধারণত হয় না সেগুলো খেয়েই তারা বেঁচে থাকে। অবস্থার সঙ্গে খাপ খাইয়ে নেয়ার বা খাদ্যাভাস পরিবর্তন করার এই কৌশলের কারণে অন্যান্য মাংসাশী প্রাণীর সঙ্গে জাগুয়ারের পার্থক্য রচিত হয়েছে। জাগুয়ার একদা বিশ্বের বেশিরভাগ তল্লাট জুড়ে বিচরণ করে বেড়ালেও এখন তাদের বিচরণক্ষেত্র অতি সীমিত। বর্তমানে এদের প্রায় বিপন্ন প্রজাতির তালিকায় ফেলা হয়েছে। তবে অন্যান্য অনেক মাংসাশী শিকার প্রাণী বিলুপ্ত হলেও এতদিন জাগুয়ার টিকে থাকতে পেরেছে স্রেফ তাদের ডায়েট বা আহার্য বস্তু পরিবর্তন করার কারণে। বরফ যুগে গণহারে বিলুপ্তি থেকে এই প্রাণীটি রক্ষা পেয়েছে তাদের খাবারের অগ্রাধিকার বদলে দিয়ে অপেক্ষাকৃত ছোট ছোট প্রাণী শিকার করে। একই কৌশলে পাহাড়ী সিংহ ও কঠিন সময় পার করে দিতে সক্ষম হয়েছে।
×