ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৬ এপ্রিল ২০২৪, ১৩ বৈশাখ ১৪৩১

কাজী নজরুল ইসলাম

আমার ধর্ম

প্রকাশিত: ০৭:১৩, ১২ ফেব্রুয়ারি ২০১৬

আমার ধর্ম

দেশে একটা কথা উঠেছে যে, মুক্তির জন্য যে আন্দোলন আমরা চালাচ্ছি আমাদের তা ধর্মের ওপর প্রতিষ্ঠিত করে নিতে হবে। দেশে যখন মুক্তির জন্যে ভাঙ্গ ভাঙ্গ বলে রব করে লাখ লাখ লোক আগল ভেঙ্গে বেরিয়ে এল, তখন তারা এক নতুনভাবে মাতোয়ারা হয়ে মানুষের মত মানুষ দেখে তার পেছনে পেছনে চলতে লাগল। কিন্তু আজ যখন তাকে সরিয়ে নেওয়া হল তখন তাঁর মতে ব্যাখ্যা নিয়ে তর্ক উঠে সঙ্ঘ ভেঙ্গে যাবার যোগাড় হল। এমনি করেই যুদ্ধের পরই সঙ্ঘ থেকে জীবন চলে গিয়েছিল, পড়েছিল শুধু বাইরের একটা আচার। ঠিক তেমনি আজ যেন আমাদে ভিতর থেকে প্রাণটুকু বেরিয়ে যাবার উপক্রম হয়েছে- তার্কিকেরা তাকে ধরে রাখার কোন চেষ্টাই করছেন না। কেউ কেউ এত বেশি গোঁড়া আর সাবধানী হয়ে পড়েছেন, কিন্তু ধ্বংসকে ডেকে আনবার মত সাহস বা ক্ষমতা তাদের আছে বলে মনে হয় না। কারণ আমাদের মনে তো কই সাড়া খুঁজে পাচ্ছি না। আমরা শুনতে পাচ্ছি যে, আমাদের ধর্মের ভিতর দিয়ে চলতে হবে। কিসের জন্যে আমাদের ধর্মকে আশ্রয় করতে হবে? ওরে শূদ্র, তুই এবার ওঠ। উঠে বল, ‘আমি ব্রাহ্মণ নয় যে ধর্মের ব্যাখ্যা নিয়ে পড়ে থাকব। আমি আর তোমার মুখের দিকে চেয়ে থাকব না। আমায় বাঁচাতে হবে- যেমন করে হোক আমি বাঁচবো।’ ওরে পতিত, ওরে চিরলাঞ্ছিত, তুই দেখ সারা বিশ্ব তোকে ধ্বংস করতে উদ্যত। দেবতা তাঁর জল ঝড় নিয়ে, প্রকৃতি তার রোগ মহামারী নিয়ে তোকে পিষে ফেলতে ব্যস্ত। আচার তার জগদ্দল পাথর তোর বুকে বসিয়ে দিয়েছে- সমাজ তোর কণ্ঠরোধ করে ফেলেছে। ধনীর অট্টহাস্য তোর প্রাণের করুণ কাঁদুনি ঢেকেছে। কিসের ধর্ম? আমার বাঁচাই আমার ধর্ম। দেবতার জল ঝড়কে আমি বাঁধবো, প্রকৃতিকে আমি প্রতিঘাত দেবো। আচারের বোঝা ঠেলে ফেলে দেবো, সমাজকে ধ্বংস করবো। সব ছারে-খারে দিয়েও আমি বাঁচবো। আমার আবার ধর্ম কি? যার ঘরে বসে কথা কইবার অধিকার নেই, দুপুর রাতে দুঃস্বপ্নে যার ঘুম ভেঙ্গে যায়, অত্যাচারকে চোখ রাঙ্গাবার যার শক্তি নেই, তার আবার ধর্ম কি? যাকে নিজের ঘরে পরে এসে অবহেলায় পশুর মত মেরে ফেলতে পারে, যার ভাই-বোন বাপ-মাকে মেরে ফেললেও বাক্যস্ফুট করবার আশা নাই, তার আবার ধর্ম কি? দুবেলা দুটি খাবার জন্যই যার বাঁচা, একটু আরাম করে কাল কাটিয়ে দেবার জন্যেই যার থাকা, তার আবার ধর্ম কি? মানুষের দাস তুমি, তোমার আবার ধর্ম কি? তোমার ধর্মের কথা বলবার অধিকার কি? ওরে আমার তরুণ, ওরে আমার লক্ষ্মীছাড়ার দল, তোরা আয়, তোরা ছুটে আয়- এই ভ-ামি থেকে চলে আয়। তোরা বল আমাদের আগে বাঁচতে হবে। কিসের শিক্ষা? কে শেখাবে? দাস কখনও দাসকে শেখাতে পারে? আমরা কিছু শিখবো না, আমরা কিছু শুনবো না; আগে বাঁচবো- আমরা বাঁচবো। একবার মনে ভেবে দেখ- তাদের কথা ভেবে দেখ। দেশ ছাড়া লক্ষ্মী ছাড়ার দল আজ কোন বনে বনে ঘুরে বেড়াচ্ছে। কে জানে তারা কত মরে গেছে, কত ঘা সয়েছে? তারা ত কথাটি কয়নি। সেই কবে গৃহহীন হয়ে প্রবাস বরণ করে, হাটে মাঠে বেড়াচ্ছে, তবু তারা কথাটি কয়নি। তাদের তপ্তশ্বাস আজ কি তোমার বুকে বয়ে যাচ্ছে না? তুমি যে পথ দিয়ে দিনের পর দিন শুধু সুখের সন্ধানে চলে যাও, তারই একপাশে বদ্ধ ঘর তারা যে দিনের পর দিন তিল তিল করে মরতে চলেছে, সে খবর তুমি রাখ কি? সেই অন্ধকারে সহস্র আঘাত খেয়ে তারা যে বছরের পর বছর কাটিয়ে দিয়েছে, তাদের ধর্ম কি? তারা বুঝেছে বাঁচাই তাদের ধর্মÑ তারা জানে এই তিল তিল করে মরার ভিতরেই জীবন। তাই তারা ঐ মরণের পথ বেছে নিয়েছে। ওগো তরুণ, আজ কি তুমি ধর্ম নিয়ে পড়ে থাকবেÑ তুমি কি বাঁচবার কথা ভাববে না? ওরে অধীন, ওরে ভ- তোর আবার ধর্ম কি? যারা তোকে ধর্ম শিখিয়েছে, তারা শত্রু এলে বেদ নিয়ে পড়ে থাকত? তারা কি দুশমন এলে কোরআন পড়তে ব্যস্ত থাকতো? তাদের রণ কোলাহলে বেদমন্ত্র ডুবে যেত, দুশমনের খুনে তাদের মসজিদের ধাপ লাল হয়ে যেত। তারা আগে বাঁচতো।
×