ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৯ মার্চ ২০২৪, ১৫ চৈত্র ১৪৩০

কঠোর পদক্ষেপ প্রয়োজন

হিজড়া সেজে জোরপূর্বক টাকা আদায়, মাদক ও অস্ত্র ব্যবসার অভিযোগ

প্রকাশিত: ০৫:২৫, ১৩ ফেব্রুয়ারি ২০১৬

হিজড়া সেজে জোরপূর্বক টাকা আদায়, মাদক ও অস্ত্র ব্যবসার অভিযোগ

গাফফার খান চৌধুরী ॥ ঢাকায় হিজড়াদের ১৫ থেকে ২০টি দল রয়েছে। সারাদেশে থাকা প্রায় ১২ লাখ হিজড়ার রয়েছে ছোট-বড় বহুসংখ্যক সংগঠন। কেন্দ্রীয়ভাবেও এদের একাধিক সংগঠন রয়েছে। প্রতিটি সংগঠনের প্রধানরা গুরু হিসেবে পরিচিত। একশ্রেণীর মানুষ হিজড়া না হয়েও হিজড়া সেজে হিজড়াদের নানা প্রলোভন দেখিয়ে তাদের দলে ভেড়াচ্ছে। আর তাদের মাধ্যমেই মাসে লাখ লাখ টাকা চাঁদাবাজি করছে। চাঁদাবাজির মোটা অঙ্কের ভাগ পেয়ে থাকে এসব গুরুরা। এছাড়া এক শ্রেণীর মাদক ব্যবসায়ী ও অবৈধ আগ্নেয়াস্ত্রের ব্যবসায়ীরাও হিজড়াদের মাধ্যমে অস্ত্র বেচাকেনা ও স্থানান্তরের কাজ করে থাকে। মঙ্গলবার ঢাকায় হিজড়াদের গুলিতে এক হিজড়া আহত হওয়ার রেশ কাটতে না কাটতেই বৃহস্পতিবার রাজশাহীতে হিজড়াদের হাতে আহত হয়েছেন একজন বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষক। কর্মসংস্থানের পাশাপাশি হিজড়াদের চাঁদাবাজি রোধে কঠোর পদক্ষেপ নেয়া প্রয়োজন বলে জানিয়েছেন হিজড়া কল্যাণ ফাউন্ডেশনের সভাপতিসহ আইনশৃঙ্খলা বাহিনী দায়িত্বশীলরা। গত ৯ ফেব্রুয়ারি দুপুর সাড়ে বারোটায় রাজধানীর উত্তরার সাত নম্বর সেক্টরে রাজউক মার্কেটে একদল হিজড়া দোকান থেকে জোরপূর্বক টাকা আদায়কালে হামলার শিকার হয়। দুইটি মোটরসাইকেলযোগে কয়েক হিজড়া সেখানে হাজির হয়ে হিজড়াদের লক্ষ্য করে গুলি চালায়। আহত হয় সেজুতি ওরফে মানিক (৩৫) নামের এক হিজড়া। সেজুতির সহযোগী হিজড়া মাসুমার অভিযোগ, হামলাকারী দলের নেতা স্বপ্না ওরফে খায়রুল মূলত পুরুষ। খায়রুল নিজেকে হিজড়া সাজিয়ে রেখে নানা অপরাধমূলক কর্মকা- করে থাকে। গুলশান ও বনানীসহ ঢাকার অভিজাত এলাকায় অপরাধমূলক কর্মকা- চালায় খায়রুলের গ্রুপটি। এ ঘটনায় সরূপা (৩৩), পায়েল (৩৮), কচি (৩৫), সোনালী (৩৪), জোনাকী (৩২) ও মল্লিকা (৩৭)সহ মোট ৭ হিজড়া গ্রেফতার হয়। এ ব্যাপারে উত্তরা পশ্চিম থানায় একটি মামলা দায়ের হয়। মামলায় গ্রেফতারকৃতদের মধ্যে কচিকে ২ দিনের এবং অন্যদের এক দিনের করে রিমান্ড মঞ্জুর করে আদালত। এদিকে বৃহস্পতিবার দুপুরে রাজশাহীর অক্টয়মোড়ে হিজড়াদের হাতে মারাত্মক আহত হন রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের পপুলেশন সায়েন্স এ্যান্ড হিউম্যান রিসোর্স বিভাগের এক সহকারী অধ্যাপক। হিজড়ারা ওই শিক্ষকের কাছে টাকা দাবি করেন। শিক্ষক একশ টাকা দিলে আপত্তি করে হিজড়ারা। টাকা বাড়িয়ে দিতে রাজি না হওয়ায় হিজড়ারা শিক্ষককে বেধড়ক মারধর করে। পুলিশ সনি, শাহানা ও রিয়া নামে তিন হিজড়াকে আটক করেছে। জানা গেছে, ঢাকায় হিজড়াদের অন্তত ১৫ থেকে ২০টি সংগঠন রয়েছে। প্রতিটি সংগঠনের কর্মক্ষেত্র ভাগ করা। এক এলাকার হিজড়া আরেক এলাকায় গিয়ে চাঁদাবাজি করতে পারবে না। অধিকাংশ সংগঠনের সভাপতি-সাধারণ সম্পাদকই পূর্ণাঙ্গ পুরুষ। তারা হিজড়া সেজে রাজধানীতে নানা ধরনের অপরাধমূলক কর্মকা- চালিয়ে থাকে। প্রতিদিন একজন হিজড়ার রোজগার গড়ে দেড় থেকে ২ হাজার টাকা। এর মধ্যে প্রতিজন হিজড়ার কাছ থেকে গুরু পাঁচশ থেকে হাজার টাকা পর্যন্ত পেয়ে থাকে। একজন গুরুর অধীন অন্তত ২০ জন হিজড়া থাকে। প্রতিদিন ৫শ’ টাকা হারে একজন গুরুর বাড়তি রোজগার কমপক্ষে ১০ হাজার টাকা। যা মাসে ৩ লাখ টাকা। পুলিশ বলছে, এমন রোজগার পুরোপুরি নিরাপদ। কারণ যাদের কাছ থেকে হিজড়ারা জোরপূর্বক টাকা আদায় করে, তারা স্বাভাবিক কারণেই থানা পুলিশের কাছে অভিযোগ করেন না। ফলে ন্যূনতম কোন ঝামেলা নেই। হালে হিজড়ারা মাত্রা ছাড়িয়ে যাচ্ছে। গোয়েন্দা সূত্রগুলো বলছে, হিজড়ারা দিন রাত চব্বিশ ঘণ্টা ঘুরে বেড়ায়। তাদের ওপর তেমন কোন নজরদারিও নেই। এমন সুযোগটিকে কাজে লাগায় হিজড়া ও হিজড়া সংগঠনগুলোর কতিপয় অসাধু কর্মকর্তা। হিজড়াদের সঙ্গে অস্ত্রগোলাবারুদ ও মাদক ব্যবসায়ীদের বিশেষ সখ্যতা রয়েছে। হিজড়ারা অস্ত্র নির্দিষ্ট জায়গায় পৌঁছে দিয়ে থাকে। কারণ হিজড়াদের দেহ সাধারণত তল্লাশি করা হয় না। এমন সুযোগে হিজড়ারা মাদক ও অস্ত্রগোলাবারুদ এক জায়গা থেকে আরেক জায়গায় স্থানান্তর করে দেয়। বিনিময়ে মোটা অঙ্কের টাকা পেয়ে থাকে। আবার অনেক মাদক ও অস্ত্র গোলাবারুদ ব্যবসায়ী নিজস্ব হিজড়া গ্রুপ তৈরি করে থাকে। তাদের গ্রুপের হিজড়াদের দিয়েই মাদক ও অস্ত্র গোলাবারুদের নিরাপদে ব্যবসা করে আসছে। এ ব্যাপারে উত্তরা পশ্চিম থানার ওসি আলী হোসেন খান জনকণ্ঠকে বলেন, গ্রেফতারকৃতদের জিজ্ঞাসাবাদে অস্ত্র গোলাবারুদ সম্পর্কে সুনির্দিষ্ট কোন তথ্য পাওয়া যায়নি। তবে অস্ত্র গোলাবারুদগুলো হিজড়াদেরই একটি গ্রুপের কাছ থেকে এসেছে বলে প্রাথমিকভাবে জানা গেছে। প্রাপ্ত তথ্য যাচাইবাছাই করা হচ্ছে। ওই গ্রুপের দলনেতা একজন পুরুষ। যিনি হিজড়া সেজে নানা অপরাধমূলক কর্মকা-ের মাধ্যমে চাঁদাবাজি করে থাকেন বলে প্রাথমিক তদন্তে জানা গেছে। এ ব্যাপারে হিজড়া কল্যাণ ফাউন্ডেশনের সভাপতি আবিদা সুলতানা মিতুর সঙ্গে যোগাযোগ করা হলে তিনি জনকণ্ঠকে বলেন, বর্তমান প্রধানমন্ত্রী ২০১৩ সালের ১০ নবেম্বর হিজড়াদের স্বীকৃতি দেন। হিজড়াদের উন্নয়নে নানা পদক্ষেপ নিয়েছে সরকার। শিক্ষাসহ নানা কার্যক্রমে জড়িত রয়েছে অনেক হিজড়া। তিনি অভিযোগ করেন, এক শ্রেণীর মানুষ রয়েছে যারা মূলত হিজড়া নন, অথচ হিজড়া সেজে রয়েছেন। তারা হিজড়াদের নিয়ে দল গঠন করে রীতিমত চাঁদাবাজি করাচ্ছেন। এতে হিজড়াদের দুর্নাম হচ্ছে। হিজড়ারা কেউ ইচ্ছে করে যা দেয় তাই নেয়। বাড়তি চাহিদা বা জোরজবরদস্তি করে না। নন হিজড়ারাই তাদের দলে থাকা হিজড়াদের দিয়ে জোরপূর্বক চাঁদাবাজি করাচ্ছেন। এক্ষেত্রে পরিত্রাণ পেতে তিনি জনগণ ও ব্যবসায়ীকে হিজড়াদের চাঁদা না দেয়ার আহ্বান জানান। সেইসঙ্গে তিনি হিজড়াদের কাজ করার সুযোগ করে দিতে দেশবাসীর প্রতি আহ্বান জানান। সবাই মিলে হিজড়াদের চাঁদা না দেয়ার রীতি চালু করলে, এক সময় হিজড়াদের চাঁদাবাজি বন্ধ হয়ে যাবে বলেও তিনি আশা করেন। অনেক অবৈধ মাদক ব্যবসায়ী ও অস্ত্র-গোলাবারুদ ব্যবসায়ীও হিজড়াদের লোভ দেখিয়ে নানা অপরাধমূলক কর্মকা-ে জড়িত করেন।
×