ঢাকা, বাংলাদেশ   বুধবার ২৪ এপ্রিল ২০২৪, ১১ বৈশাখ ১৪৩১

বিক্ষোভে মিছিলে ছিল উত্তাল ॥ ভাষা আন্দোলনে মাদারীপুর

প্রকাশিত: ০৫:৫৮, ১৩ ফেব্রুয়ারি ২০১৬

বিক্ষোভে মিছিলে ছিল উত্তাল ॥ ভাষা আন্দোলনে  মাদারীপুর

ব্রিটিশ আমলে আন্দোলন-সংগ্রাম ও রাজনৈতিক কারণে মাদারীপুর পরিচিত ছিল ‘চিতোর অব বেঙ্গল’ নামে। ১৯৫২’র ভাষা আন্দোলনের জন্য ঢাকায় গঠিত সর্বদলীয় রাষ্ট্রভাষা সংগ্রাম পরিষদে মাদারীপুরের কৃতী সন্তান ডা. গোলাম মাওলা ছিলেন অন্যতম। তাঁর অনুপ্রেরণায় ঢাকা মেডিক্যাল কলেজের ২য় বর্ষের ছাত্র ডা. সিরাজুল হক তোতা, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিভাগের ছাত্র হাবিবুর রহমান চাদ এবং ছাত্র আব্দুল মান্নান সিকদার (সলিমুল্লাহ হলের ক্রীড়া সম্পাদক) মাদারীপুর আসেন। এ সময় ঢাকাসহ অন্যান্য জেলার মতো মাদারীপুরের বিভিন্ন স্কুল-কলেজের শিক্ষার্থী, আইনজীবী, শিক্ষক, রাজনীতিবিদ ভাষা আন্দোলনে ভূমিকা রাখেন। ভাষা আন্দোলনে অংশ নেয়ার জন্য অনেককে পুলিশী নির্যাতনের পাশাপাশি মামলা, জেল-জুলুম সহ্য করতে হয়েছে। চাকরিচ্যুত করা হয় ইউনাইটেড ইসলামিয়া উচ্চ বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষককে। ১৯৪৭ সালের ১৪ আগস্ট ভারত ও পাকিস্তান নামের দুটি রাষ্ট্র জন্ম নেয়ার পর হয় ভাষা আন্দোলনের সূত্রপাত। অবশ্য ভাষা আন্দোলনের সূত্রপাত হয় মূলত ১৯৫২ সালের বহু আগে। অর্থাৎ ১৯০১ সাল থেকে ভাষা আন্দোলনের যাত্রা শুরু। ১৯০১ সালে সৈয়দ নওয়াব আলী চৌধুরী রংপুরে প্রাদেশিক শিক্ষা সম্মেলনে বাংলা ভাষাকে জাতীয় পর্যায়ে স্বীকার করার আহ্বান জানিয়ে বক্তব্য রেখেছিলেন। ১৯১৮ সালে ড. মুহাম্মদ শহীদুল্লাহ বিশ্বভারতীয় সম্মেলনে উপমহাদেশের সাধারণ ভাষা হিসেবে বাংলা ভাষাকে প্রতিষ্ঠার জোর দাবি পেশ করেছিলেন। ১৯৩৭ সালে মাওলানা আকরম খাঁ, ১৯৪৭ সালে তমদ্দুন মজলিস, ধীরেন্দ্রনাথ দত্ত এবং ভাষা চিন্তাবিদগণ আন্দোলনের পথ সুগম করেছিলেন। ১৯৫২-এর ভাষা আন্দোলনের সাথে মাদারীপুরের ছাত্র যুবসমাজ ওতপ্রোতভাবে জড়িত ছিল। এ আন্দোলনে মাদারীপুরের মানুষের ভূমিকা ব্যাপক। তমদ্দুন মজলিস ও পূর্ব পাকিস্তান মুসলিম ছাত্রলীগের সমন্বয়ে গঠিত রাষ্ট্রভাষা সাব-কমিটির আহ্বানে ১৯৪৮ সালেই বাংলা ভাষাকে রাষ্ট্রভাষা করার দাবিতে মাদারীপুরে আন্দোলন শুরু হয়। কংগ্রেস নেতা নরেশ দাশগুপ্তের অনুপ্রেরণায় মাদারীপুরের চরমুগরিয়া মার্চেন্টস স্কুল থেকে প্রথম জিন্নাহর ‘উর্দুই হবে পাকিস্তানের রাষ্ট্র ভাষা’ ঘোষণার প্রতিবাদ ওঠে। ১৯৪৮ সালের ২৩ ফেব্রুয়ারি চরমুগরিয়া বন্দরের রাশিবাবু বাজারে (বর্তমানে নদীভাঙ্গনে বিলীন) প্রথম প্রতিবাদ সভা ও বিক্ষোভ মিছিল হয়। ওইদিন বেলা ১১টায় চরমুগরিয়া মার্চেন্টস স্কুলের ছাত্ররা মিছিল নিয়ে বিক্ষোভ করতে করতে রাশিবাবু বাজারের স্টিমার ঘাট পর্যন্ত যায়। বিক্ষোভ শেষে বাজারে সমাবেশ করে। চরমুগরিয়া মার্চেন্টস স্কুলের ছাত্র সরদার আবুল ফজল, আব্দুল মান্নান ভূঁইয়া, আব্দুল লতিফ তায়ানী, সৈয়দ আলী, আবদুল হাই তালুকদার, নির্মল সেন, আবদুর রহমান তালুকদার, মতিয়ার রহমান মাস্টার, ফজলুর রহমান খান, ডা. আবদুল হক, শৈলেন্দ্র চন্দ্র রায়, নিরোদ বিহারী গুহ, আজাহার মুন্সী, আবদুুস সাত্তার মুন্সী, সীতানাথ সাহা বিক্ষোভ সমাবেশে নেতৃত্ব দেন। ১৯৪৮ সালে ১১ মার্চ প্রদেশব্যাপী (পূর্ব পাকিস্তান) ধর্মঘট পালিত করে। সংগ্রাম কমিটির আহ্বানে মাদারীপুরের সকল শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে ধর্মঘট পালিত হয়। চরমুগরিয়া মার্চেন্ট উচ্চ বিদ্যালয় ১৯৩১ সালে প্রতিষ্ঠিত এবং এ অঞ্চলের মধ্যে পুরাতন ও ছাত্রসংখ্যা বেশি হওয়ার সুবাদে সকল আন্দোলন-সংগ্রামের কেন্দ্র ছিল স্কুলটি। এই স্কুলটি প্রতিষ্ঠা করেন ব্যবসায়ী মতি চান পোদ্দার, হেমচন্দ্র রায় এবং হাজী অছিমউদ্দিন তালুকদার। স্কুলের প্রতিষ্ঠাতা প্রধান শিক্ষক ছিলেন জিতেন্দ্রনাথ সেনগুপ্ত। শুরু থেকে ভাষা আন্দোলনে মাদারীপুরে নেতৃত্বে ছিলেন মৌলভী আচমত আলী খান, অধ্যাপক মতিয়ার রহমান বাদশা, অধ্যাপক সরদার আবুল ফজল, ডা. সিরাজুল হক তোতা, সূফি আবদুল কাদের, আবদুল ওহাব মজনু, আবদুল হাই তালুকদার। তাঁরা ভাষা আন্দোলনে ছাত্রদের উদ্বুদ্ধ করেছিলেন। ভাষা আন্দোলনের নেতৃত্ব দেয়ার জন্য মৌলভী আচমত আলী খান, আবদুল ওহাব মজনু ও আব্দুর রশিদকে গ্রেফতার করা হয়। ১৯৫১ সালে ৭ এপ্রিল থেকে এ আন্দোলন আরও জোরদার হয়ে ওঠে। ওই সময় মাদারীপুর উচ্চ শিক্ষার একমাত্র প্রতিষ্ঠান নাজিমউদ্দিন কলেজ নতুন প্রতিষ্ঠিত হওয়ায় কলেজের ছাত্রছাত্রী সংখ্যা ছিল কম। যে কারণে চরমুগরিয়া মার্চেন্টস হাই স্কুলের ছাত্রদের সমন্বয়ে ভাষা আন্দোলনের মূল কেন্দ্র হিসেবে ইউনাইটেড ইসলামিয়া উচ্চ বিদ্যালয় মুখ্য ভূমিকায় চলে আসে। স্কুল থেকে আন্দোলনে নেতৃত্ব দেয় অষ্টম শ্রেণীর ছাত্র এটিএম নুরুল হক। এ জন্য তাঁকে ছাত্র সংগ্রাম পরিষদের আহ্বায়ক করা হয়। এই সংগ্রাম পরিষদের সভা বসতো শহরের পুরান বাজার ডা. রকিবউদ্দিন আহম্মদের চেম্বারে। এখান থেকেই মাদারীপুরে ভাষা আন্দোলনের কর্মসুচি গ্রহণ করা হতো। ১৯৫২ সালের ২১ ফেব্রুয়ারি রাষ্ট্রভাষা সংগ্রাম পরিষদ কেন্দ্রীয় কমিটির আহুত ধর্মঘট চলাকালে ঢাকার ছাত্রদের ওপর গুলির সংবাদ মাদারীপুরে পৌঁছে ২২ ফেব্রুয়ারি সন্ধ্যায়। প্রতিবাদ ও বিক্ষোভের শহরে পরিণত হয় মাদারীপুর, চরমুগরিয়া বন্দর ও শিবচর। ইউনাইটেড ইসলামিয়া হাইস্কুল মাঠে (সাবেক গোসাইবাড়ি, বর্তমান মাস্টার কলোনির পুকুরের দক্ষিণ পাড়ে জনস্বাস্থ্য প্রকৌশল অফিসের গুদাম সংলগ্ন) প্রতিবাদ সভা অনুষ্ঠিত হয়। সভাপতিত্ব করেন নাজিমউদ্দিন কলেজের মেধাবী ছাত্র শামসুল আলম। বক্তব্য রাখেন রাইমোহন, সূফি আবদুল কাদের, সরদার আবুল ফজল। একইদিন চরমুগরিয়া মার্চেন্টস হাই স্কুল মাঠে প্রতিবাদ ও শোকসভা অনুষ্ঠিত হয়। অনুপ্রেরণা দেন চরমুগরিয়া মার্চেন্টস হাই স্কুলের প্রধান শিক্ষক নিবারণ চন্দ্র দাস। এ কারণে তাঁকে তৎকালীন প্রশাসনের রোষানলে পড়তে হয়। স্কুলের এসএসসি (১৯৫২) পরীক্ষার্থী আবদুল হাই তালুকদার ও ছাত্রনেতা আবুল ফজল খান, ডা. আবদুল হক, নির্মল সেন, আজাহার মুন্সী, সীতানাথ সাহা, আহাম্মদ মাতুব্বর, রাধাবল্লভ সাহার নেতৃত্বে চার শতাধিক ছাত্র শোক মিছিল নিয়ে রাশিবাবু বাজারের উদ্দেশ্যে রওনা হয়। পথিমধ্যে এক ইউরোপিয়ান সাহেবের সাথে দেখা হলে ছাত্রনেতারা তার জুতা খুলে হাতে নিয়ে হাঁটতে বাধ্য করে। ২৪ থেকে ২৮ ফেব্রুয়ারি মাদারীপুরে আন্দোলন আরও জোরদার হয়। প্রতিদিন সর্বত্র মিছিল-মিটিং চলতে থাকে। মহকুমা প্রশাসকের নির্দেশে ছাত্রদের ওপর পুলিশী নির্যাতন বেড়ে যায়। ২৮ ফেব্রুয়ারি বিকেলে মিছিলের সময় সদর জামে মসজিদ এলাকা থেকে গ্রেফতার করা হয় আবদুল ওহাব মজনুকে। ওই সময় মাদারীপুর মহকুমা প্রশাসক ছিলেন কাজী মহব্বত আলী। বাঙালী অফিসার হয়েও তিনি ছিলেন ভাষা আন্দোলন বিরোধী। শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে ধর্মঘট পালনের কারণে তিনি ক্ষিপ্ত হন। ইউনাইটেড হাইস্কুলের গবর্নিং বডির মাধ্যমে ধর্মঘটী ছাত্রদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা গ্রহণের নির্দেশ দেন। বিদ্যালয়ে অনুপস্থিত থাকার জন্য প্রত্যেক ছাত্রকে মাথাপিছু দুই পয়সা করে জরিমানা করা হয়। এতে ছাত্ররা আরও ক্ষিপ্ত হয়ে বিদ্রোহ ঘোষণা করে। ভাষা আন্দোলনে ছাত্রদের পক্ষ নেয়ায় এবং প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে সহযোগিতা করার কারণে বিদ্যালয়ের তৎকালীন প্রধান শিক্ষক আব্দুল হামিদ আখন্দকে সাময়িক বরখাস্ত এবং তাঁর বিরুদ্ধে দুর্নীতির মামলা দিয়ে আটক করা হয়। তাঁকে আদালতে নেয়া হলে কোর্টের সকল আইনজীবী তাঁর পক্ষ নেয়। তারা শুনানিতে অংশ নিলে বিচারক তাঁকে জামিনে মুক্তি দেয়। জামিন পেলেও স্কুল কর্তৃপক্ষ পরবর্তীতে মুসলিম লীগ নেতাদের প্ররোচনায় তাঁকে স্কুল থেকে বিতাড়িত করে। এর প্রতিবাদে ছাত্ররা আন্দোলন ও লাগাতার ধর্মঘটের ডাক দেয়। Ñসুবল বিশ্বাস, মাদারীপুর থেকে
×