ঢাকা, বাংলাদেশ   শনিবার ২০ এপ্রিল ২০২৪, ৭ বৈশাখ ১৪৩১

বগুড়ায় সম্পূর্ণ কম্পিউটারাইজড এ্যাগ্রো-এ্যারোমেটিক শিল্প

চালের বাই প্রোডাক্ট দিয়ে বিদ্যুত তেল পোল্ট্রি খাবার সার

প্রকাশিত: ০৫:২৪, ১৪ ফেব্রুয়ারি ২০১৬

চালের বাই প্রোডাক্ট দিয়ে বিদ্যুত তেল পোল্ট্রি খাবার সার

সমুদ্র হক ॥ বগুড়ায় স্থাপিত দেশের অন্যতম সম্পূর্ণ কম্পিউটারাইজড এ্যাগ্রো এ্যারোমেটিক অটোমোশন শিল্পে ধান থেকে চাল বানানোর পরও বাই প্রোডাক্ট ছাই বালি জৈব সার, মাছের খাবার তৈরি এবং তুষ দিয়ে ভোজ্যতেল ও বিদ্যুত উৎপাদিত হচ্ছে। ইতোমধ্যে প্রতিষ্ঠানটি দেশের চাহিদা মিটিয়ে এ বছর থেকে চাল রফতানি শুরু করেছে। প্রথম দফায় চাল রফতানি হয়েছে শ্রীলঙ্কায়। দেশ-বিদেশের প্রাকৃতিক দুর্যোগে খাদ্য ও পোলট্রি ফিড পাঠিয়ে সহযোগিতার হাত বাড়িয়েছে। বগুড়া জেলা শহর থেকে প্রায় ১৫ কিলোমিটার পশ্চিমে খড়নার বীরগ্রামে ২০১৩ সালের ডিসেম্বরে গুঞ্জন এ্যাগ্রো এ্যারোমেটিক অটোমেশন রাইস মিল নামের মিলটি স্থাপিত হওয়ার পরই অতি উন্নতমানের আমিষযুক্ত চিকন চাল উৎপাদনের পাশাপশি সকল বাই প্রোডাক্ট কাজে লাগায়। তুষে উৎপাদিত বিদ্যুতে অনেক কিলোওয়াট বিদ্যুত সাশ্রয় হয়ে উৎপাদন খরচ কমায়। দুই বছরের মাথায় তারা সরকারের সঙ্গে চাল রফতানিকে অংশ নিয়ে সহযোগিতা করে। পরিত্যক্ত তুষে কোলেস্টরেলমুক্ত ভোজ্যতেল (রাইস ব্রান) তৈরির আলাদা প্লান্ট স্থাপনের পথে। বিদ্যুতের জ্বালানি হিসেবে ব্যবহৃত তুষ পোড়ার পর যে ছাই বের হয় কৃষক তা জৈব সার হিসেবে আবাদি জমিতে ফেলে। গুঞ্জন এগ্রো এ্যারোমেটিক অটোমোশন দেশের একমাত্র রাইস মাল্টি পারপাস মিল, যা আন্তজার্তিক মান নিয়ন্ত্রণের (আইএসও) প্রত্যায়নপ্রাপ্ত। প্রতিষ্ঠানের স্বত্বাধিকারী আইনুল হক সোহেল জানান, মিলটি যাতে বিদেশী শিল্পের সঙ্গে পাল্লা দিয়ে দেশের সুনামকে আরও বাড়িয়ে দেয় সেই লক্ষ্যেই তিনি পরিচালিত করছেন। ইতোমধ্যে ধান থেকে অতি উন্নতমানের কয়েক গ্রেডের চিকন চাল (যার প্রলেপে আমিষ অংশ বাদ দেয়া হয়নি) তৈরি করে দেশের চাহিদা মিটিয়ে রফতানি পর্যায়ে চলে গেছে। বাই প্রোডাক্ট সকল অংশই কাজে লাগানো হচ্ছে। ভর বছর যেন চালু থাকে সেই ব্যবস্থা রাখা হয়েছে। মেশিনে ধান প্রথম শর্টিংয়ের পর বালির মধ্যে ভাঙ্গা ও ঢেলার যে পরিত্যক্ত অংশগুলো বের হয় তা হ্যাচারি ও পোল্ট্রিতে মাছ, মুরগির খাবার হিসেবে ব্যবহৃত হচ্ছে। এমনকি ছাই ফেলনা নয়। প্রতি ঘণ্টায় ৮ মেট্রিক টন করে ধান ভেঙ্গে চাল তৈরি করা হচ্ছে। প্রতিদিন মিলটি দিনে রাতে ২২ ঘণ্টা করে চালু থাকে। ভর বছর যাতে উৎপাদনে থাকে এজন্য বিভিন্ন হাট-বাজারে থেকে চালের মান দেখে কিনে গুদামে রাখার পর তা প্রথমে ফিডার শর্টারে নেয়া হয়। ৫০ বিঘার ওপর স্থাপিত জাপানের স্যাটেক কোম্পানির তৈরি মিলটি সম্পূর্ণ কম্পিউটারের প্রোগ্রামেবল লজিক কন্ট্রোলে (পিএলসি) অটোমেশনে চালিত। যেখানে শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত প্রতিটি ধাপেই একজন করে অপারেটর এবং সার্বিকভাবে একজন ইঞ্জিনিয়ার ও ফোরম্যান কাজ করছেন। কম্পিউটার নিয়ন্ত্রণে চালু হওয়ায় মূল উৎপাদন থেকে বাই প্রোডাক্ট সবই সূক্ষ্মভাবে কাজ করে। যে কারণে কোন ওয়েস্টেজ নেই। বিদেশী লোকজন এসে এই মিল দেখে ভূয়সী প্রশংসা করেছেন। এমনকি বেসিক ব্যাংকের লোকজনও এই মিলকে অতি ভাল মিল বলে স্বীকৃতি দিয়েছে। মিলটি কম্পিউটারের যে কয় ধাপে চালু হয় তা এরকম- রিজার্ভারে পর্যায়ক্রমে ধান প্রসেস করে রাখা হয়। এরপর প্রতিটি ২৪ টন ধারণক্ষমতা তিনটি ড্রয়ারে রাখা হয়। চলমান প্রক্রিয়ায় ব্লোয়ার বয়লার ও স্টিম ফাংশনের পর সাইলোতে নামানো হয়। তারপর পার বয়েলিং ইউনিট বয়লার ও মিলিং এই তিন ইউনিটে কার্যক্রম শুরু করে। ধানের খোলস বা তুষ আলাদা হয়ে গেলে এলিভেটরের মাধ্যমে ডেস্ট্রয়ারে নিয়ে গিয়ে মিলিং সেকশনে তুষ রিসাইকেলে বিদ্যুত উৎপাদিত হয়ে সেই বিদ্যুতে মিলের কিছু অংশ চালিত হয়। চাল বের হওয়ার পর তা চলে যায় সেপারেটরে। সেখানে ভাংড়ি চাল যে ৫ শতাংশ বের হয় তা বাদ দিয়ে ফিডব্যাকের জন্য ফের যায় আলাদা সেপারেটরে। বাকি ৯৫ শতাংশ চাল ৩টি পর্বে পলিশ হয়। ভিটিএ-১০ নামের তিন পর্বে পলিশের সময় কিছু ভেঙ্গে গেল তা আলাদা হয়ে যায়। রফতানির মান অনুযায়ী চালের অংশকে সাদা সিলকি ও লাল অংশ ভাগ করা হয়। লাল খোলসটি যায় ভোজ্যতেল উৎপাদনে। অতি আধুনিক এই পলিশ ইউনিটটি চালের আমিষ অংশকে ধরে রাখে। কি পরিমাণ চাল, খুদ (ভাঙ্গা চাল), কালো চাল, চিটা, ধুলা এবং তুষ বের হলো তা হিসাব করে দেয় ফলো মিটার। এই ইউনিটে চালের মান পরিমাণ, থিকনেসসহ নানা বিষয় গণনা করে কম্পিউটারে বের করে দেয়। সবশেষে পাটের বস্তায় ৫০, ২০ ও ১০ কেজি করে চাল ভরে বস্তার মুখ অটো সুইয়িং মেশিনে সেলাই হয়ে বিপণন ও রফতানির জন্য প্রস্তুত হয়ে রোটারি বেল্টে পৌঁছে দেয় গুদামে। বাই প্রোডাক্টগুলোও কম্পিউটারে প্রতিটি ইউনিটে নিয়ন্ত্রিত হয়ে তা চলে যায় আলাদা ঘরে। প্রতি মেট্রিক টন ধান ক্রাশ করে চাল বের হয় ৬০ থেকে ৬৫ শতাংশ। বাকি ৩৫ শতাংশ বাইপ্রোডাক্ট যেমন তুষ, ভাঙ্গা চাল, কালো চালের কনা, চিটা ও ধুলি ইত্যাদি। মিল কর্তৃপক্ষ দাবি করছেন এ মিলটি দেশের অন্যতম একটি মিল, যার কোন কিছুই ফেলে দেয়া হয় না। এমনকি ফেলে দেয়া অংশ রফতানির চেষ্টা চলছে। প্রতিষ্ঠাতা আইনুল হক সোহেল বললেন, শীঘ্রই বাই প্রোডাক্ট দিয়ে কোলেস্টরেলমুক্ত রাইস ব্রান ভোজ্যতেল তৈরি করা হবে। বর্তমানে তুষের বিদ্যুত অনেক সাশ্রয় হচ্ছে। মিলের কর্মকা- তুষের বিদ্যুতেই করা যায় কি না, সেই চেষ্টা চলছে। মিলটি যাতে দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার মধ্যে শীর্ষে থাকে সেই চেষ্টাই চলছে।
×