স্টাফ রিপোর্টার, চাঁপাইনবাবগঞ্জ ॥ দিনে দিনে বাড়ছে ঋণের পরিমাণ। তারপরও সরকারী- বেসরকারী ব্যাংকের ঋণ দেয়ার প্রতিযোগিতা থেমে নেই। যদিও সে তুলনায় ঋণ পরিশোধের কোন তাগিদ নেই কোন ঋণ গ্রহীতার। এর পরেও ব্যাংক ঋণ দিয়ে চলেছে। জেলায় ব্যাংকের প্রধান শাখার সংখ্যা প্রায় ১৮টির কাছাকাছি। জেলা শহর ছাড়া অন্যত্র শাখার পরিমাণ ৭০- এর কাছাকাছি। এর মধ্যে সরকারী ব্যাংকও রয়েছে। গত তিন যুগে ব্যাংক ঋণের টাকা কোন ব্যাংক উঠাতে পারেনি। যদিও তারা টাকা উসুলের জন্য বা ঋণের টাকা উঠাতে বাড়ি, মিলকারখানাসহ স্থাবর সম্পত্তির নিলাম ডাকে উঠিয়েছে একাধিক বার। কিন্তু অদৃশ্য কারণে সেসব সম্পত্তির নিলাম আটকে গেছে। সরকারী- বেসরকারী অধিকাংশ ব্যাংক কর্মকর্তা নানান সুবিধা ও উপঢৌকন গ্রহণ করে খুবই নিম্নমানের স্থাবর সম্পত্তি বা বাড়ি বাজারদরের চেয়ে কয়েকগুণ বেশি দাম দেখিয়ে (সম্পত্তি) বন্ধক রেখেছিল তা বাস্তবে অনেক ক্ষেত্রেই নির্দিষ্ট ঋণের এক পঞ্চম ও চতুর্থাংশও উঠে আসবেনা। একাধিক তফসিল ও বেসরকারী ব্যাংক থেকে পাওয়া তথ্যে জানা গেছে, সুদসহ ব্যাংকের পাওনা টাকার পরিমাণ জেলায় পাঁচ হাজার কোটি টাকা পেরিয়ে গেছে। অধিকাংশ ক্ষেত্রে বন্ধকী সম্পত্তির কাগজ জাল নতুবা সংশ্লিষ্ট ব্যাংক আইনজীবী ও কর্মকর্তার যোগসাজশে বেশি দেখিয়ে ঋণ দিয়েছে। জেলা শহরের ১৮টি প্রধান শাখাসহ জেলার ৭০টি শাখা (উপজেলা মিলিয়ে) একই স্টাইলে কোটি কোটি টাকা ঋণ দিয়েছে। পুরান বাজারের একটি ব্যাংকের (বেসরকারী) মোট ঋণের পরিমাণ প্রায় তিনশ’ কোটি টাকা। ব্যাংকটি প্রায় প্রতিমাসে (অর্থঋণ আদালত আইন ২০০৩, ধারা ১২(৩) মোতাবেক) নিলাম বিজ্ঞপ্তি প্রকাশ করে থাকে। সুদসহ ঋণের পরিমাণ নিলামের শর্তাবলী ও সম্পত্তির তফসিল উল্লেখপূর্বক নির্দিষ্ট তারিখ বেঁধে দিয়ে টাকা উসুলের চেষ্টা করে। কিন্তু নিলামের তফসিলভুক্ত সম্পত্তি দেখতে গিয়ে পার্টি বা খদ্দের পালিয়ে যায়। দেখা যায় ২০ লাখ টাকার বাড়ি দেখানো রয়েছে তিন কোটি টাকা আর জমির পরিমাণ অনেক কম যা চড়ামূল্য লিখা রয়েছে। এমনকি বন্ধক সম্পত্তির জে.এল নং, খতিয়ান নং, আর/এস নম্বর ও দাগ নম্বরেও গরমিল রয়েছে। অথচ ঋণ গ্রহণের আগে এসব সম্পত্তির কাগজপত্র ব্যাংক নিয়োজিত আইনজীবী কর্তৃক পরীক্ষা নিরীক্ষা করানো হয়েছে। প্রায় ক্ষেত্রে দেখা গেছে, প্রভাবশালীদের দ্বারা প্রভাবিত হয়ে ব্যাংক যে সব উকিল নিয়োগ করে রেখেছে তাদের অধিকাংশ দেওয়ানি আদালতের উকিল না হয়ে তারা ফৌজদারি আদালতের আইনজীবী। তাই অনেক ক্ষেত্রে এইসব আইনজীবীরা জমিজমা সংক্রান্ত কাগজপত্র পরীক্ষা নিরীক্ষার ব্যাপারে এতটাই অনভিজ্ঞ যে রিপোর্ট তৈরির ব্যাপারেও অপরের সহযোগিতা নিয়েছে। তাছাড়া এখানে দেওয়ানি আদালত সংক্রান্ত অভিজ্ঞ ও বিজ্ঞ আইনজীবীর খুবই অভাব রয়েছে। বিধায় ঋণ গ্রহীতার কাগজপত্র দেখে আইনী রিপোর্ট দেয়ার ব্যাপারে সংশ্লিষ্ট ব্যাংক কর্মকর্তার পরামর্শ মোতাবেক যেনতেন গোজামিল রিপোর্ট দিয়ে ছেড়ে দিয়েছে। পরবর্তীতে ঋণ আদায়ে নিলাম বিজ্ঞপ্তি দিয়ে সেসব বাড়িঘর ও স্থাবর সম্পত্তি দেখানো হয়েছে তার বাজার মূল্য অনেক কম। বিধায় কেউ আগ্রহ প্রকাশ করেনা ব্যাংক সম্পত্তি কিনতে। গত এক দশকের মধ্যে যে সব নতুন বেসরকারী ব্যাংক চাঁপাইনবাবগঞ্জ এসেছে তাদের ঋণ দেবার পরিমাণ কয়েক শত গুণ বেশি। এদের মধ্যে ঋণ গ্রহীতার সিংহভাগ অটোমিল রাইস ব্যবসায়ী। এসব ব্যাংক কর্মকর্তা নিজেদের দক্ষ হিসেবে চিহ্নিত করাতে এইসব ভুয়া বা ত্রুটিপূর্ণ বন্ধকী বাড়িঘর জমিজমার কাগজ দেখিয়ে ঋণ বরাদ্দ দিয়ে বদলি হয়ে চলে গেছে। তার বদলে নতুন যেসব কর্মকর্তা দায়িত্বভার গ্রহণ করেছে তারা বেকায়দায় পড়েছে ঋণের টাকা তুলতে গিয়ে। এমনকি যে সব বাড়িঘর, গুদামঘর বা জমিজমা বন্ধক রাখা ঋণ গ্রহীতার এইসব সম্পত্তির উপর ব্যাংকের নাম লিখা ঋণ সম্পত্তি সাইন বোর্ড পর্যন্ত বসানো হয়নি। প্রায় ৭০ শাখার ব্যাংক কর্মকর্তারা বন্ধকী সম্পত্তি চিহ্নিত করতে হঠাৎ করেই সাইনবোর্ড লাগানো শুরু করেছে। এক কথায় প্রতিটি আরবান ও মফস্বল এলাকায় হিড়িক পড়েছে ঋণে দায়বদ্ধ ব্যাংকের নাম লিখা সাইনবোর্ড টাঙ্গানোর। শহরসহ গ্রামের জনপদে ঘুরলেই নজরে পড়বে বড় বড় বাড়ি ও মিল কারখানায় এসব সাইনবোর্ড। ইসলামী ব্যাংক চাঁপাইনবাবগঞ্জ প্রধানসহ একাধিক শাখা এই ধরনের ঋণ দিয়েছে সাত শত কোটি টাকা। তারা পল্লী উন্নয়ন প্রকল্প ও মহিলা উদ্যোক্তাদের নামে ২০ কোটি ৮০ লাখ টাকা দিয়ে রেখেছে। তারা বিদেশী রেমিটেন্স পেয়েছে ৩১ ডিসেম্বর ২০১৫ পর্যন্ত প্রায় ২০৫ কোটি টাকা। তাদের ঋণ গ্রহীতারা নিয়মিত টাকা পরিশোধ করে পুনরায় ঋণ নিচ্ছে। সরকারী বেসরকারী মিলিয়ে জেলার ৭০ শাখার মধ্যে তাদের পাঁচটি শাখা চুটিয়ে ব্যবসা করলেও কোন সঙ্কট নেই। জেলার পাঁচ তফসিলী বা সরকারী ব্যাংক শাখাতেও সঙ্কট বিদ্যমান। অগ্রণী ব্যাংক চাঁপাইনবাবগঞ্জ প্রধান ও তার আওতাধীন শাখাসমূহে ঋণের পরিমাণ হাজার কোটি টাকা ছাড়িয়ে গেলেও একই সমস্যার মধ্যে রয়েছে ঋণের টাকা উঠানোর ব্যাপারে। এই ব্যাংকের অধিকাংশ বড় ঋণ গ্রহীতার মধ্যে অটোরাইস মিল মালিকরা অন্যতম। সোনালী ব্যাংক এজিএম শিশ মোহাম্মদ জানান, তারা বিভিন্ন খাতে ১১০ কোটি টাকার ঋণ দিয়ে রেখেছে। তার মধ্যে ব্যবসায়ীরা নিয়ে রেখেছে ৬৮ কোটি টাকা। কৃষি ঋণের পরিমাণ প্রায় ৮ কোটি টাকা। তবে একটি সূত্র বলছে এখানেও ঋণ জটিলতার কারণে একাধিক কর্মকর্তা, কর্মচারী বিভিন্ন সময়ে অভিযুক্ত হয়েছেন। জনতা, রূপালী, রাজশাহী কৃষি উন্নয়ন ব্যাংক ও বেসিক ব্যাংকের ঋণ নিয়েও নানান অভিযোগ রয়েছে। উল্লেখ্য পুরো জেলায় কৃষি ঋণের পরিমাণ শত কোটি টাকা হলেও তা পরিশোধে কোন উদ্যোগ নেই।
তবে বেসরকারী ব্যাংকের মধ্যে আইএফআইসি, যমুনা, প্রাইম, এবিসহ প্রায় ১৫টি বেসরকারী ব্যাংকের ঋণ প্রদান ও ঋণ বাণিজ্যের একাধিক অভিযোগ রয়েছে।