ঢাকা, বাংলাদেশ   শনিবার ২০ এপ্রিল ২০২৪, ৬ বৈশাখ ১৪৩১

কবির ফাঁসি!

প্রকাশিত: ০৪:৩২, ১৫ ফেব্রুয়ারি ২০১৬

কবির ফাঁসি!

কবিকে দিও না দুঃখ, দিলে সে-ও জলে-স্থলে হাওয়ায় হাওয়ায়/নীলিমায় গেঁথে দেবে দুঃখের অক্ষর। কবি তার নিঃসঙ্গতা/কাফনের মতো মুড়ে রাখে আপাদমস্তক, হাঁটে/ফুটপাথে একা,/দালানের চূড়ায় চূড়ায়, দিগন্তের অন্তরালে/কেমন বেড়ায় ভেসে, চাঁদের নিকট যায়, নক্ষত্র ছিটোয় যত্রতত্র/খোলামকুচির মতো। তাকে দুঃখ দিও না, চৌকাঠ থেকে দূরে/দিও না ফিরিয়ে। ফেরালে নক্ষত্র, চাঁদ করবে ভীষণ হরতাল, ছায়াপথ তেজস্ক্রিয়/শপথে পড়বে ঝরে, নিমেষেই সব ফুল হবে নিরুদ্দেশ। দেশের প্রধান কবি শামসুর রাহমানের এই কবিতাটি আজও কবির অতি সংবেদনশীল মনের প্রতি আমাদের দৃষ্টি আকর্ষণ করে। কবি হলেন সমাজের বা রাষ্ট্রের সবচেয়ে সত্যবাদী এবং স্পর্শকাতর মানবসত্তা, যদি তিনি প্রকৃত কবি হন। শুধু মানুষ নয়, উদ্ভিদ ও প্রাণিকুলের ওপর যে কোন আঘাত সরাসরি এসে পড়ে কবির হৃদয়ে। তাই এক অর্থে কবির জীবন দুঃখেরই পারাবার। তবু তাকে দুঃখ দেয়া চলে না। আর কবিকে মৃত্যুদ- দিয়ে তা কার্যকর করার কথা ভাবে কোন্ সে চ-াল পাষ-! আজ বাংলায় যখন ফাগুন হেসে উঠেছে ফুলের সৌন্দর্য ও পবিত্রতায়, বিশ্বের সকল প্রেমিক মনের ওপর ভালবাসার ঢেউ এসে আছড়ে পড়ছেÑ তখন কিনা আমাদের শুনতে হয় কবির ফাঁসির সংবাদ! কবিÑ সে যে কোন ভাষার যে কোন দেশের হোক না কেন, সে ধরিত্রীর শুদ্ধতম সন্তান। মানবতাবাদের সুরক্ষায় প্রয়োজনে সে ঘাতকের তলোয়ারের নিচে স্বেচ্ছায় জীবন দিতে রাজি। চির উন্নত তার শির। ঘটনাটি ইরানের। আদিবাসী আরব-ইরানিয়ান বংশোদ্ভূত কবি হাশেম শাবানিকে ইরানের নিরাপত্তার জন্য হুমকি বলে উল্লেখ করে তার ফাঁসি কার্যকর করা হয় সম্প্রতি। তাকে ঈশ্বরের শত্রুও আখ্যা দেয়া হয়। শাবানি ইরানের খুজেস্তান প্রদেশের আরব সংখ্যালঘু আদিবাসীদের প্রতি ইরানের আচরণ নিয়ে সমালোচনা করে দেশটির শাসকদের রোষের মুখে পড়েছিলেন। এ জন্য ২০১১ সালের মার্চে তাকে আটক করা হয়। ২০১৩ সালের জুলাইয়ে শাবানিসহ ১৩ জনকে ঈশ্বরের বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণাকারী বলে অভিযুক্ত করে মৃত্যুদ- দেয় ইসলামিক রেভ্যুলেশন ট্রাইব্যুনাল। ৪২ বছর বয়সী শাবানি আরবী ও ফার্সী ভাষার সমকালীন কবিদের মধ্যে বেশ জনপ্রিয়। ইরানের রাষ্ট্রীয় টেলিভিশন দাবি করেছে, তিনি বিচ্ছিন্নতাবাদীদের উস্কে দিয়ে ইরানের বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্রে লিপ্ত ছিলেন। রাষ্ট্র কর্তৃক কবিকে জেল-জরিমানা, এমনকি মৃত্যুদ-ে দ-িত করার বিষয়টি যুগে যুগে ঘটে চলেছে। কয়েক বছর আগে চীনের ভিন্ন মতাবলম্বী কবি ঝু ইউফুকে সাত বছরের কারাদ- দিয়েছিল দেশটির একটি আদালত। একটি কবিতার মাধ্যমে সরকার উৎখাতে উস্কানি দেয়ার দায়ে তাঁকে ওই দ- দেয়া হয়। ১৯৮৫ সালে দক্ষিণ আফ্রিকার বোথা সরকারের হাতে কৃষ্ণাঙ্গ কবি বেঞ্জামিন মালায়সের ফাঁসি হয়। কবি হলেন মুক্তচিন্তার প্রতীক। কবির ফাঁসি হলে বিশ্বমানবতা ভূলুণ্ঠিত হয়, কেঁপে ওঠে আকাশ-বাতাস-অন্তরীক্ষ। যারা কবির কণ্ঠ রুদ্ধ করতে চায়, কেড়ে নিতে চায় কবির কলমÑ তারা চিরকালই সভ্যতা ও মানবজাতির শত্রু। স্মরণ রাখতে হবে অন্ধ হলে প্রলয় বন্ধ থাকে না, আর কালের সত্যবাদন না শুনতে চাইলেও শ্রুতি বধির হওয়া থেকে রক্ষা পেতে পারে না।
×