ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ২৮ মার্চ ২০২৪, ১৪ চৈত্র ১৪৩০

ফেসবুকে লেখালেখি হচ্ছে অভিযোগ- স্টল সিলগালা, বই জব্দ

প্রকাশিত: ০৫:৪৫, ১৬ ফেব্রুয়ারি ২০১৬

ফেসবুকে লেখালেখি হচ্ছে অভিযোগ- স্টল সিলগালা, বই জব্দ

মোরসালিন মিজান ॥ মেলার নিরাপত্তা কী হবে? কতটা নিরাপদ বোধ করবেন পাঠক? এমন প্রশ্ন ছিল। বার বার উঠেছে। কিন্তু মেলা শুরুর পর সেই আশঙ্কা কেটে গেছে বলা যায়। পাঠকের শঙ্কা কেটেছে বটে। মেলার আয়োজক বাংলা একাডেমির ডর ভয় দূর হয়নি। নানা শঙ্কায় থাকা একাডেমি নিরাপত্তা প্রশ্নে সোমবার একটি প্রকাশনা প্রতিষ্ঠানের স্টল বন্ধ করে দিয়েছে। অখ্যাত প্রকাশনা প্রতিষ্ঠানটির নাম ‘ব-দ্বীপ’। এখান থেকে প্রকাশিত ‘ইসলাম বিতর্ক’ শিরোনামের বইটি স্টল বন্ধের কারণ বলে জানা গেছে। সম্পাদনা করে বইটি মেলায় এনেছিলেন প্রকাশক শামসুজ্জোহা মানিক নিজেই। পুলিশি অভিযানে বইয়ের সবকটি কপি জব্দ করা হয়। একইসঙ্গে পুলিশ আরও পাঁচটি বইয়ের কপি নিয়ে যায়। এসব বইয়ের মধ্যে ছিল শামসুজ্জোহা মানিক ও শামসুল আলম চঞ্চলের লেখা ‘আর্যজন ও সিন্ধু সভ্যতা’। এম এ খানের অনুবাদ গ্রন্থ ‘জিহাদ : জবরদস্তিমূলক ধর্মান্তরকরণ, সাম্রাজ্যবাদ ও দাসত্বের উত্তরাধিকার’। তুলে নেয়া হয়েছে শামসুজ্জোহা মানিকের তিনটি বই ‘ইসলামের ভূমিকা ও সমাজ উন্নয়নের সমস্যা’, প্রবন্ধ সংকলন ‘ইসলামে নারীর অবস্থা’ এবং ‘নারী ও ধর্ম’। পরে স্টলের কর্মীদের বের করে দিয়ে সামনের পর্দা টেনে দেয়া হয়। ওই সময় থেকেই স্টলের সামনে পুলিশ সদস্যরা অবস্থান নেন। এই রনসজ্জা মেলার সাধারণ পরিবেশ যথেষ্ট বিঘœ করে। অন্য প্রকাশকদের মধ্যে এক ধরনের আতঙ্ক ছড়িয়ে পড়ে। অভিযান প্রসঙ্গে জানতে চাইলে শাহবাগ থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা আবু বকর সিদ্দিক বলেন, জব্দ করা বইটির বিরুদ্ধে অভিযোগ এসেছে। ফেসবুকে লেখা হয়েছে, ধর্মীয় অনুভূতিতে আঘাত দেয়ার মতো উপাদান এ বইতে আছে। প্রাথমিকভাবে অভিযোগ প্রমাণিত হওয়ায় বইটি জব্দ করা হয়েছে বলে দাবি করেন তিনি। অন্য বই নিয়ে যাওয়ার কারণ জানতে চাইলে তিনি বলেন, এসব বইয়ে বিতর্কিত কোন লেখা আছে কিনা পরীক্ষা করে দেখা হবে। এ কারণেই বইগুলো নেয়া। কোন বইয়ের বিষয়, মান ইত্যাদির পরীক্ষা হতেই পারে। তাই বলে এ কাজ পুলিশ করবে? মেলা ঘুরে এমন প্রশ্ন বার বার শুনতে হয়েছে। অনেক বিদগ্ধ পাঠক ক্ষোভ জানিয়ে বলেছেন, এভাবে পুলিশের মেলা হয়ে ওঠার আশঙ্কা থাকে। আমরা এটা নিশ্চয়ই চাইব না। বিষয়টি নিয়ে কথা হয় মেলা পরিচালনা কমিটির সদস্য সচিব ড. জালাল আহমেদের সঙ্গে। জনকণ্ঠ’র কাছে তিনি স্বীকার করে বলেন, পুলিশ সূত্রেই আমরা খবরটি জেনেছি। আমাদের জানানো হয়েছে, ওখানে ধর্মীয় অনুভূতিতে আঘাত দেয়Ñ এমন বই প্রদর্শিত হচ্ছে। পরে বইটি আমরা পরীক্ষা করে দেখেছি। এতে এমন কিছু বিষয়ের অবতারণা করা হয়েছে যা নীতিমালার ১৩.১৩ অনুচ্ছেদের সঙ্গে সাংঘর্ষিক। যারা মুক্তবুদ্ধির চর্চা করেন, লেখকের স্বাধীনতা নিয়ে কাজ করেন যারা তারাও বইটি পড়লে এর স্থ’ল আলোচনা সম্পর্কে সহমত প্রকাশ করবেন বলে জানান তিনি। এ অবস্থায় স্টলটি মেলার সার্বিক নিরাপত্তার জন্য হুমকি হয়ে উঠতে পারে। এ কারণে প্রকাশনা প্রতিষ্ঠানটির স্টল বন্ধ করা হয়েছে। এ প্রসঙ্গে প্রকাশকদের মধ্যে দেখা যায় ভিন্নমত। প্রকাশনীর প্রকাশক রবিন আহসান বলেন, ফেসবুকে কে বা কারা একটি বই নিয়ে ‘সন্দেহ’ পোষণ করেছেন। তাতেই সেটি ধর্মীয় অনুভূূতির ইস্যু হয়ে গেল! স্টল বন্ধ করে দেয়া হলো! ভাবা যায়? তিনি বলেন, সুনির্দিষ্ট অভিযোগ থাকলে কোন বিদগ্ধজনকে দিয়ে বইটি পাঠ করিয়ে তাঁর মতামত নিতে পারত বাংলা একাডেমি। তার পর এ সংক্রান্ত আইন কী বলে, সেটি খতিয়ে দেখে ব্যবস্থা নেয়া যেত। কিন্তু একাডেমি এখন অনেক নতজানু। এই একাডেমির কাছ থেকে এর চেয়ে বেশি কিছু আশা করা যায় না বলে মন্তব্য করেন তিনি। একই দিন ভিন্ন কারণে বাংলাপ্রকাশ থেকে অনেকদিন আগে আসা একটি বই জব্দ করা হয়েছে। ‘হুমায়ূন আহমেদের শেষ দিনগুলি’ শিরোনামে বইটি লিখেছেন বিশ্বজিৎ সাহা। অভিযানে অংশ নেয়া পুলিশের উপ পরিদর্শক মামুনুর রশীদ জানান, বইটিতে নানা ভুল তথ্য দেয়া হয়েছে। হুমায়ূন আহমেদের স্ত্রী মেহের আফরোজ শাওন এই মর্মে আদালতে মামলা করেছেন। এখনও তা বিচরাধীন। এ অবস্থায় বইটি প্রদর্শন ও বিক্রি করা যায় না। আমরা তাই জব্দ করেছি। এ প্রসঙ্গে বাংলাপ্রকাশের কর্মকর্তা রেজা বলেন, নিম্ন আদালতে নিষেধাজ্ঞা থাকলেও, পরে তা ছিল না। এ কারণেই বইটি বাজারে আনা হয়। কিন্তু সোমবার কোন ধরনের পূর্ব নোটিস ছাড়াই একাডেমির সচিবের নির্দেশে বইটি জব্দ করেছে টাস্কফোর্স। নতুন বই রবিবার অমর একুশে গ্রন্থমেলার ১৫তম দিনে এসেছে অনেক নতুন বই। বাংলা একাডেমির তথ্য কেন্দ্রে জমা পড়েছে ৮৪টি বই। এগুলোর মধ্যে গল্প ১৫, উপন্যাস ৭, প্রবন্ধ ৪, কবিতা ২৯, শিশু সাহিত্য ১, জীবনী ১, মুক্তিযুদ্ধ ২, ভ্রমণ ১, ইতিহাস ১, রাজনীতি ১, ধর্মীয় ২, সায়েন্সফিকশন ৪ ও অন্যান্য বিষয়ের ওপর ১৬টি বই রয়েছে। নির্বাচিত বই আমার বাবা রবীন্দ্রনাথ ॥ কবিগুরুর পুত্র রথীন্দ্রনাথের লেখা স্মৃতিকথা। সন্তান হিসেবে বাবা রবীন্দ্রনাথকে তিনি দীর্ঘকাল কাছে থেকে দেখেছেন। প্রায় ৫০ বছর পিতার কাছাকাছি ছিলেন। প্রকাশকের ভাষায়- এ বই তাই সাধারণ কোন স্মৃতিকথা নয়। বরং রবীন্দ্রনাথের মতো মহীরুহের অবয়ব উন্মোচন। অ্যাডর্ন থেকে আসা বইয়ের অনুবাদ করেছেন কবির চান্দ। বইয়ের মূল্য ৪০০ টাকা। মুক্তিযুদ্ধ সমগ্র-তিন ॥ প্রখ্যাত ইতিহাসবিদ ও লেখক মুনতাসীর মামুনের মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক গবেষণা ও প্রবন্ধ একত্রিত করে এই সিরিজ প্রকাশনা। এটি তৃতীয় খ-। প্রকাশ করেছে সুবর্ণ। এ দেশ আমার গর্ব ॥ বইয়ের লেখক স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্রের বার্তা বিভাগের প্রধান কামাল লোহানী। বিশিষ্ট এই সাংবাদিক অস্থায়ী সরকারের নেতৃবৃন্দের ভাষণ রেকর্ড করা, সংবাদ লেখা এবং কথিকা তৈরির কাজ করেছেন। মুক্তিযুদ্ধ চলাকালীন সময়ে ১১ সেক্টরের মধ্যে কোন সেক্টরে কার কী ভূমিকা ছিল এই গ্রন্থে আলোচনার চেষ্টা করেছেন তিনি। সাংস্কৃতিক ব্যক্তিত্ব লিখেছেন বুলবুল ললিতকলা একাডেমি প্রতিষ্ঠার ইতিহাস। এসেছে বাংলাদেশ ও বাঙালী সংস্কৃতির আরও নানা গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। বইটি প্রকাশ করেছে গ্রন্থ কানন। মূল্য ৫০০ টাকা। সেরা দশ গল্প- নাসরীন জাহান ॥ বিভিন্ন লেখকের সেরা দশ গল্প নিয়ে সিরিজ গ্রন্থ মেলায় এনেছে অন্য প্রকাশ। সিরিজের অন্যতম একটি নাসরীন জাহানের গল্পে সাজানো। বইয়ে রাখা গল্পগুলোর শিরোনাম- এলেনপোর বিড়াল, আমাকে আসলে কেমন দেখায়, পুরুষ, অন্যরকম, প্রতিপক্ষ শকুনেরা, গরঠিকানিয়া, আমার জন্ম, পরপুরুষ, একটি দীর্ঘশ্বাসের ডালপালা ও হত্যাকারী। বাবর নামা ॥ ঐতিহ্য প্রকাশ করেছে ‘বাবর নামা ॥ জহির উদ্-দিন মুহম্মদ জালাল উদ্-দিন বাবর’। অনুবাদ করেছেন মুহম্মদ জালালউদ্দীন বিশ্বাস। বিজ্ঞানের মজার প্রজেক্ট ॥ বিজ্ঞান বিষয়ক রচনা। বিভিন্ন প্রজেক্ট নিয়ে লিখেছেন ড. আলী আসগর। বইটি প্রকাশ করেছে অনিন্দ্য। কাকে বলি অন্ধকার কাকে বলি আলো ॥ খালেদ হোসাইনের কাব্যগ্রন্থ। প্রকাশ করেছে অনিন্দ্য। বইটি সম্পর্কে কবির নিজের বলাটি এরকম- সময়ের সঙ্গে সঙ্গে আমার কবিতাকে বদলে যেতে দেখি আমি। আমার কবিতা সহজ হয়ে উঠতে চাইছে। এ এক কঠিন প্রবৃত্তি। বিপরীত দুরবিনে ॥ শ্বেতা শতাব্দী এষের কাব্যগ্রন্থ। প্রকাশ করেছে ঐতিহ্য। মেলা মঞ্চের আয়োজন ॥ গ্রন্থমেলার মূলমঞ্চে অনুষ্ঠিত হয় ‘বাংলাদেশে জীবনানন্দ দাশ চর্চা’ শীর্ষক আলোচনা অনুষ্ঠান। প্রবন্ধ উপস্থাপন করেন আবু হেনা মোস্তফা এনাম। আলোচনায় অংশগ্রহণ করেন প্রভাতকুমার দাস, রুবী রহমান, মুহাম্মদ সামাদ, ফয়জুল লতিফ চৌধুরী এবং পিয়াস মজিদ। সভাপতিত্ব করেন আহমদ রফিক। প্রাবন্ধিক বলেন, বাংলাদেশে জীবনানন্দ চর্চা আজ এক পরিণত পর্যায়ে উন্নীত। আবদুল মান্নান সৈয়দ যেমন তাঁর অপ্রকাশিত- অগ্রন্থিত কবিতা ও অন্যান্য রচনা সংগ্রহ ও সংকলন করেছেন ঠিক তেমনি আজকের তরুণতর কবি-লেখক-গবেষকবৃন্দ জীবনানন্দকে অন্বেষার প্রয়াস চালিয়ে যাচ্ছেন নানামাত্রিকভাবে। জীবনানন্দের কবিতার প্রামাণ্য সংস্করণ, তাঁর কথাসাহিত্য, সমালোচনা সমগ্র, পত্রাবলি অর্থাৎ তাঁর সৃষ্টিবিশ্বের সামগ্রিক সংকলন বাংলাদেশ থেকে যেমন প্রকাশিত হয়েছে তেমনি তাঁর জীবনী প্রণয়ন এবং বিশ্ব ও বাংলা সাহিত্যের প্রেক্ষাপটে তাঁর সাহিত্যকৃতির মূল্যায়নমূলক আলোচনা প্রকাশের মধ্য দিয়ে বাংলাদেশে জীবনানন্দ চর্চা নতুন মাত্রিকতা লাভ করেছে। আলোচকরা বলেন, বাংলাদেশে জীবনানন্দ চর্চা অতীত থেকে বর্তমান পর্যন্ত নানা মাত্রায় বিস্তৃত হয়েছে। প্রাতিষ্ঠানিক চর্চার পাশাপাশি ব্যক্তি উদ্যোগে গবেষক এবং সৃজনশীল লেখকেরা জীবনানন্দের কবিতা ও গদ্যভুবনে আলো ফেলেছেন। ১৯৯৯-এ জীবনানন্দ জন্মশতবর্ষে তাঁকে নিয়ে আলোচনা-গবেষণা নতুন মাত্রা পায়। জীবনানন্দকেন্দ্রিক ভিন্ন ভাষার লেখকদের বই ও গবেষণা-সংকলন এ দেশের অনুবাদকবৃন্দ নিষ্ঠার সঙ্গে যেমন অনুবাদ করেছেন তেমনি বাংলা ভাষা থেকে ইংরেজীসহ নানা ভাষায় ভাষান্তরিত করেছেন জীবনানন্দের কালজয়ী কবিতাবলি। তারা বলেন, জীবনানন্দ চর্চাকে কেবল কাগজে-কলমে ও গবেষণায় সীমাবদ্ধ না রেখে তাঁর নিবিষ্ট পাঠে আমাদের মনোযোগী হতে হবে। সভাপতির বক্তব্যে আহমদ রফিক বলেন, বাংলাদেশে জীবনানন্দ চর্চা শুধু গবেষকদের কাজে সীমাবদ্ধ নয়, এদেশের মানুষ গভীর ভালবাসায় রূপসী বাংলার কবিকে নিজের করে নিয়েছেন। জীবনানন্দ চর্চা ভবিষ্যতে এদেশে আরও বিস্তৃত হবে- আমরা এ প্রত্যাশা করি।
×