ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ২৫ এপ্রিল ২০২৪, ১২ বৈশাখ ১৪৩১

মেলার চিরচেনা চেহারা পাল্টাচ্ছে, স্টল বন্ধে মিশ্র প্রতিক্রিয়া

প্রকাশিত: ০৫:২৭, ১৭ ফেব্রুয়ারি ২০১৬

মেলার চিরচেনা চেহারা পাল্টাচ্ছে, স্টল বন্ধে মিশ্র প্রতিক্রিয়া

মোরসালিন মিজান ॥ বিভিন্ন বয়সী মানুষ। দুই দেড় শ’ নয়, হাজার হাজার। প্রতিদিন মেলায় আসেন। বই কেনেন। দেখেন। ঘুরে বেড়ান। লেখক-পাঠক প্রকাশকের এই মিলনমেলা থেকে কাউকে আলাদা করা যায় না। সবারই বলায় চলায় একটা মিল খুঁজে পাওয়া যায়। চেনা জানা চেহারা পায় মেলা। চরিত্র যা দাঁড়ায়, খুব সহজেই এর সঙ্গে মিশে যাওয়া যায়। কিন্তু এ বছরের মেলায় কাজটা অত সহজ হচ্ছে না। পাঠকের অভিমত- প্রতি বছরের মেলায় যাদের দেখি, এবার তাঁদের অনেককেই দেখছি না। যত সংখ্যায় দেখতাম, সেই সংখ্যায় তাঁরা আসছেন না। প্রতিদিন মেলায় আসা বই কেনা আড্ডা জমানোর লোক হিসেবে যাদের বিশেষ খ্যাতি, তাঁরা পা টিপে আসছেন। চলে যাচ্ছেন সন্ধ্যা নামার আগেই। অন্যদিকে, নতুন নতুন মুখ দেখা যাচ্ছে। এই মুখগুলো যথেষ্টই অচেনা। মেলায় আসা সাধারণ পাঠকের সঙ্গে তাদের কোথায় যেন অমিল। গত কয়েকদিন মেলা ঘুরে পাঠকের এমন কথার কিছু যৌক্তিকতাও খুঁজে পাওয়া গেছে। এখন পুলিশের পাহারায় মেলায় আসেন প্রগতিশীল চিন্তার অত্যন্ত জনপ্রিয় লেখক ড. মুহম্মদ জাফর ইকবাল। মঙ্গলবারও দীর্ঘ সময় মেলায় ছিলেন তিনি। বাচ্চাদের অটোগ্রাফ দিয়েছেন। পুরোটা সময় তাঁকে ঘিরে ছিল পুলিশী নিরাপত্তা। প্রকাশকদের মধ্যে যারা খুব পরিচিত এবং প্রগতিশীল চিন্তার, তাদের মেলায় খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না। প্রকাশক নেতা ও আগামী প্রকাশনীর স্বত্ব¡াধিকারী ওসমান গনীকে তাঁর প্যাভিলিয়নে পাওয়া যায়নি এখনও। মেলা শুরুর আগেই হুমকি দেয়া হয়েছিল সময় প্রকাশনের স্বত্ব¡াধিকারী ফরিদ আহমেদকে। তিনিও মেলায় আসছেন না। মুক্তিযুদ্ধের চেতনার পক্ষে সরব তরুণ প্রকাশক রবিন আহসান মেলায় আসেননি গত দুই দিন। মঙ্গলবার তাঁর প্রকাশনা প্রতিষ্ঠান শ্রাবণসহ আরও বেশ কয়েকটি উল্লেখযোগ্য প্রকাশনা প্রতিষ্ঠানের সামনে সন্দেহজনক ঘোরাফেরা লক্ষ্য করা গেছে। প্রকাশনা প্রতিষ্ঠানের কর্মীদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, ওই দলটি বিভিন্ন বইয়ের লেখার বিষয় পরীক্ষা করার চেষ্টা করছিল। ‘হার্ড’ বিষয়ে লেখা কোন বই আছে কিনা জানতে চাইছিল। মঙ্গলবারের মেলায় বিষয়টি ব্যাপক আলোচিত হয়েছে। এমন আরও কিছু উদাহরণ তৈরি হচ্ছে প্রতিদিনের মেলায়। সোমবার বন্ধ করে দেয়া স্টল ‘ব-দ্বীপ’র সামনে বসে থাকতে দেখা যায় পুলিশ সদস্যদের। ধর্মীয় অনুভূতিতে আঘাত হানার মতো উপাদান থাকার কথা জানিয়ে পুলিশ এই প্রকাশনা প্রতিষ্ঠানের একটি বই জব্দ করে। সেই থেকে স্টলটিও সিলগালা। স্টলের সামনে পুরো সময় বসে পাহারা দিচ্ছে পুলিশ। সন্ধ্যায় প্রকাশনা প্রতিষ্ঠান শুদ্ধস্বর’র সামনে দেখা হয় ইতিহাসবিদ ও লেখক মুনতাসীর মামুনের সঙ্গে। প্রসঙ্গটি তুললে তিনি বলেন, পুলিশ বার বার লেখককে সাবধান করছে। প্রকাশককে সতর্ক করছেন। অথচ যারা লেখক প্রকাশকদের হত্যা করছেন তাদের উদ্দেশ্যে কিছু বলার নেই। এটা খুব একপেশে ব্যাপার হয়ে যাচ্ছে। পুলিশ নিজ থেকে স্টলে ঢুকে বই জব্দ করে নিয়ে যাচ্ছে। স্টল বন্ধ করে দিচ্ছে। এটি মানা যায় না। এই দায়িত্ব তাঁদের না। যৌক্তিক কারণ থাকলে বাংলা একাডেমি কিছু সিদ্ধান্ত নিতে পারে। এভাবে পুলিশের করে দিলে অমর একুশে গ্রন্থমেলা এর চিরচেনা চরিত্র হারাবে। সত্য মিথ্যা যাচাই না করে, হঠাৎ স্টল বন্ধ করে দিলে, বই জব্দ করলে দেশের বাইরে বাংলাদেশ সম্পর্কে বাজে ধারণা হয়। এই দিকগুলো নিয়ে ভাবার পরামর্শ দেন তিনি। মুক্তমনাদের বর্তমান পরিস্থিতি বিবেচনায় নিয়ে সতর্ক হয়ে লেখার পরামর্শও দেন মুনতাসীর মামুন। বিষয়টি নিয়ে কথা হয় মেলা পরিচালনা কমিটির সদস্য সচিব ড. জালাল আহমেদের সঙ্গে। জনকণ্ঠকে তিনি বলেন, মেলার চরত্রি বদলে যাওয়ার বিষয়টি আপেক্ষিক। নিরাপত্তা নিয়ে আমাদের বিশেষভাবে ভাবতে হচ্ছে। এ জন্য কিছু বিষয় নতুন করে সামনে চলে আসছে। এতে করে মেলার মূল চরিত্র নষ্ট হওয়ার কিছু আছে বলে মনে করি না। নতুন বই ॥ রবিবার অমর একুশে গ্রন্থমেলার ১৬তম দিনে এসেছে অনেক নতুন বই। বাংলা একাডেমির তথ্য কেন্দ্রে জমা পড়েছে ৮৪টি। নির্বাচিত বইÑ অনন্ত আমরা চুপ থাকব না ॥ ড. আনোয়ার হোসেনের লেখা প্রবন্ধের সংকলন। ২০১২ সালের শেষ সময় থেকে ২০১৫ সালের মাঝামাঝি সময়ে লেখা। বিভিন্ন অনলাইন পোর্টাল ও জাতীয় দৈনিকে এসব প্রবন্ধ প্রকাশিত হয়। ১৭টি প্রবন্ধ নিয়ে বইটি প্রকাশ করেছে প্রকাশনা প্রতিষ্ঠান মত ও পথ। ধর্মান্ধ মৌলবাদী গোষ্ঠীর বিরুদ্ধে সরব প্রবন্ধিক একইসঙ্গে মুক্তিযুদ্ধের চেতনার বাংলাদেশ গড়ার উপর জোর দিয়েছেন। মুক্তিযুদ্ধের দর্শনে গভীর আস্থা আছে এমন রাজনৈতিক শক্তির ঐক্যবদ্ধ অবস্থান এবং রাজনৈতিক দৃঢ়তার প্রয়োজনীয়তা তুলে ধরা হয়েছে বিভিন্ন প্রবন্ধে। আশ্চর্য মৌনব্রত পালনের এই কালে বইটি উৎসর্গ করা হয়েছে ভয়ঙ্কর জঙ্গী আক্রমণের শিকার লেখক হুমায়ুন আজাদ, রাজীব হায়দার, অভিজিৎ, অনন্ত, বাবু, নীলয় ও দীপনকে। মূল্য ২৪০ টাকা। মানবকেন্দ্রিক উন্নয়ন ভাবনা ও বাংলাদেশ প্রসঙ্গ ॥ বিশিষ্ট অর্থনীতিবিদ ও উন্নয়ন বিশেষজ্ঞ কাজী খলীকুজ্জামান আহমদের লেখা বই। প্রকাশ করেছে প্রকাশনা প্রতিষ্ঠান পালক। ইতিহাস ও সাহিত্য ॥ প্রবন্ধের বই। লিখেছেন মাহবুবুল হক। প্রাবন্ধিক নানাভাবে কাল ও যুগের প্রভাব ধরে ধরে আঠারোটি অধ্যায় নিয়ে রচনা করেছেন এ বই। এতে আরও অনেক আলোচনার পাশাপাশি বাংলাদেশের কবিতা ও ছোটগল্পের ইতিহাস খুব সাবলীলভাবে উপস্থাপনের চেষ্টা করা হয়েছে। এসেছে বাংলা প্রকাশ থেকে। বাংলা ভাষার বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্র ও বাঙালীর সংগ্রাম ॥ লিখেছেন নিগার চৌধুরী। বিস্তৃত পরিসরে ভাষা আন্দোলনকে দেখার চেষ্টা করেছেন লেখিকা। বইতে রাজপথে ও পরিষদে যে সংগ্রাম চলছিল তার তথ্য নির্ভর ও বস্তুনিষ্ঠবিবরণ। প্রকাশ করেছে সুবর্ণ। এই সময়ের মুক্তিযুদ্ধের গল্প ॥ রফিকুর রশীদ সম্পাদিত বইতে মুক্তিযুদ্ধের উপেক্ষিত অথচ অনিবার্য বিষয়গুলো নানা মাত্রায় উপস্থাপিত হয়েছে। প্রকাশ করেছে জয়তী। রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের শহীদ বুদ্ধিজীবী ও বধ্যভূমি ॥ লিখেছেন প্রফেসর আবদুল খালেক। প্রকাশ করেছে আগামী। মেলা মঞ্চের আয়োজন ॥ গ্রন্থমেলার মূল মঞ্চে অনুষ্ঠিত হয় ‘মাহমুদ নূরুল হুদা’ জন্মশতবর্ষিকী শীর্ষক আলোচনা অনুষ্ঠান। প্রবন্ধ উপস্থাপন করেন স্বরোচিষ সরকার। প্রবন্ধের উপর আলোচনা করেন ড. নেহাল করিম, হাশেম সূফী, শামসুজ জাহান নূর এবং মাহমুদ নুরুল হুদার ভ্রাতুষ্পুত্র এইচ এইচ মাহমুদ। সভাপতিত্ব করেন ড. এনামুল হক। মূল পবন্ধে প্রাবন্ধিক বলেন, মাহমুদ নূরুল হুদা বাংলাদেশের সামাজিক-রাজনৈতিক ও সাংস্কৃতিক জগতের বিশিষ্ট একজন ব্যক্তিত্ব। জীবিত থাকতে তিনি বাংলাদেশের রাজনৈতিক ও সাংস্কৃতিক বিকাশে তাৎপর্যপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছিলেন। সেই ভূমিকার খানিকটা স্বীকৃতি মেলে মৃত্যুর পর মাত্র দুই বছরের মধ্যে ১৯৯৮ সালে বাংলা একাডেমি থেকে তাঁর জীবনী প্রকাশের মধ্য দিয়ে। মাহমুদ নূরুল হুদা নিজেও আত্মস্মৃতিমূলক চারটি গ্রন্থের লেখক ছিলেন। এসব গ্রন্থ এবং তাঁকে নিয়ে বিশিষ্টজনদের স্মৃতিচারণায় আমরা জানতে পারি এদেশের জাতীয় জাগরণে সাংস্কৃতিক সূত্রধরদের অন্যতম হিসেবে মাহমুদ নূরুল হুদা পালন করেছেন ঐতিহাসিক ভূমিকা। আলোচকরা বলেন, মাহমুদ নূরুল হুদা ছিলেন একজন নিঃশব্দ বিপ্লবী। তিনি বিশ্বাস করতেন সংস্কৃতিই জাগরণের প্রথম সূত্র। একই সঙ্গে তিনি ছিলেন ভীষণ রাজনীতিসচেতন এবং অসাম্প্রদায়িক দৃষ্টিভঙ্গির একজন মানুষ। শেরে বাংলা, সোহ্রাওয়ার্দী প্রমুখ জাতীয় নেতাদের সংস্পর্শ তাকে জীবন ও জগতের বৃহৎ পরিসরে যুক্ত করেছে। পাশাপাশি বুলবুল ললিতকলা একাডেমি (বাফা) প্রতিষ্ঠার মধ্য দিয়ে বাংলার লোকসংস্কৃতিকে তিনি আমাদের সামনে নিয়ে এসেছেন। তাঁরা বলেন, জন্মশতবর্ষে মাহমুদ নূরুল হুদাকে স্মরণের সঙ্গে সঙ্গে তাঁর স্বপ্নের বুলবুল ললিতকলা একাডেমি সংরক্ষণে সরকারী উদ্যোগ প্রয়োজন। সভাপতির বক্তব্যে ড. এনামুল হক বলেন, মাহমুদ নূরুল হুদার জন্মশতবর্ষে তাঁকে স্মরণ করে জাতীয় সাংস্কৃতিক প্রতিষ্ঠান বাংলা একাডেমি আমাদের সংস্কৃতি জগতের এক অনন্য ব্যক্তিত্বকে নতুন প্রজন্মের সামনে নিয়ে এসেছে। সন্ধ্যায় সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান নিয়ে মঞ্চে ছিল ক্রান্তি শিল্পীগোষ্ঠী, বাঁধনহারা ও বঙ্গবন্ধু সাংস্কৃতিক ফোরাম।
×