ঢাকা, বাংলাদেশ   শনিবার ২০ এপ্রিল ২০২৪, ৭ বৈশাখ ১৪৩১

দারিদ্র্যকে জয় করেই লক্ষ্য অর্জন

স্বর্ণকন্যা মাবিয়া- একনিষ্ঠ সাধনাই তার সাফল্যের চাবিকাঠি

প্রকাশিত: ০৫:২৪, ১৮ ফেব্রুয়ারি ২০১৬

স্বর্ণকন্যা মাবিয়া- একনিষ্ঠ সাধনাই তার সাফল্যের চাবিকাঠি

আজাদ সুলায়মান ॥ সাতই আগস্ট তার জন্ম। সাতই ফ্রেরুয়ারি স্বর্ণ জয়। জ্যোতিষীরা বলতেই পারেন- সাত তার জীবনে সৌভাগ্যের সংখ্যা। কিন্তু মাবিয়ার জীবনে সৌভাগ্য এমনি এমনি আসেনি। সৌভাগ্য তিনি কেড়ে এনেছেন। অর্জন করেছেন সাধনা দিয়ে। জন্ম থেকে স্বর্ণ জয় পর্যন্ত মাত্র ঊনিশ বছরের জীবন তার। চরম দারিদ্র্যের কশাঘাতে জর্জরিত প্রতিটি মুুহূর্তের কথা আজও স্মরণীয় হয়ে আছে। জীবনযুদ্ধে কিভাবে জয়ী হতে হয়, কিভাবে কি মোকাবিলা করতে হয়, কিভাবে সৌভাগ্য অর্জন করতে হয়- তার জ্বলন্ত উদাহরণ মাবিয়া। দারিদ্র্য শুধু বঞ্চনাই দেয় না, কখনও কখনও বিকশিত জীবনের সন্ধানও দেয়- মাবিয়ার অতীত তারই স্বাক্ষর বহন করছে। চরম লাঞ্ছনা-বঞ্চনার মাঝেও অভীষ্ট লক্ষ্যে পৌঁছাই ছিল তার একমাত্র সাধনা। সাতই ফ্রেব্রুয়ারি এসএ গেমসে ভারোত্তলনে স্বর্ণ জয়ের আগ পর্যন্ত মাবিয়ার জীবন ছিল অজানা-অচেনা। সাত তারিখের পর থেকেই এখন চলছে মাবিয়া বন্দনা। বেরিয়ে আসছে তার জীবনের অজানা অধ্যায়ের অবিশ্বাস্য সব কথা। মাবিয়া গরিব ঘরের মেয়ে সেটা কাগজে দেখেছি। কিন্তু এতটা গরিব ঘরে জন্ম- সেটা ছিল ধারণাতীত। বুধবার ভরদুপুরে যখন রাজধানীর সিপাহীবাগের নতুন রাস্তার পাশে তার বাসায় গিয়ে হাজির হই, তখন অনুধাবন করা গেল কতটা অসহায় পরিবারে তার জন্ম। কী ছিল তার বাপ-দাদার? তেমন কিছুই না। বাবা হারুনুর রশিদের বাড়ি ছিল মাদারীপুরের কুনপুদ্দিতে। সেখানেও ছোট্ট একটা ভিটে ছাড়া যে কিছুই ছিল না। ভিটেবাড়ি রেখে তিনি জীবন সংগ্রামে পাড়ি দেন। সব ছেড়ে চলে আসেন ঢাকায়। সেটা ১৯৮২ সাল। শুরু করেন বেবিট্যাক্সি চালানো। থাকতেন খিলগাঁওয়ে ছোট্ট একটা ঘরে। সামান্য কিছু যা আয় করতেন, সেটাই সঞ্চয় করতেন। বছর তিনেক পর ১৯৮৫ সালে খিলগাঁও চৌরাস্তার স্থায়ী বাসিন্দা আখতার বানুকে বিয়ে করেন। বেবিট্যাক্সি চালাতে গিয়ে একদিন দুর্ঘটনায় পড়েন। ছাড়তে বাধ্য হন এ পেশা। এরপর তার সংসারে আসতে থাকে নতুন অতিথি। বড় ছেলে রাসেল, বড় মেয়ে আনজুম। সবশেষ ১৯৯৭ সালের সাত আগস্ট তার ঘর উজ্জ্বল করে জন্ম নেয় আজকের মাবিয়া আক্তার সিমান্ত। মেয়ের নাম কেন সিমান্ত রেখেছিলেন তার কোন সঠিক ব্যাখ্যা দিতে পারেননি। ‘মনে চেয়েছিল, ভাল লেগেছিল, তাই নামটা রেখেছিলাম’- অকপটে স্বীকার করলেন হারুনুর রশিদ। তারপর শুরু করলেন জীবন সংগ্রামের করুণ কাহিনী, মাবিয়ার বিকশিত জীবনের নানা অধ্যায়, স্বর্ণ জয়ের নেপথ্য কথা। তিনি বললেন, মাবিয়া যেদিন জন্ম নেয় সেদিনও পকেটের অবস্থা ভাল ছিল না। কিভাবে কি করি সে টেনশন তো ছিল। কিন্তু উপরওয়ালার ওপর ভরসা করেই সামনের দিকে এগিয়ে যাই। মাবিয়ার বয়স যখন চার, তখন বাসা বদল করে চলে আসি আজকের এই জায়গায়। সেটা ২০০১ সাল। এখানে বর্ষাকালে পানি জমে। এই ঝিলটাতে তো আজও পানি জমে আছে। এখানেই শ্বশুর মশায় এককাঠা জমি দেন ঘর তুলে থাকার জন্য। প্রথমে বাঁশের একটা টং ঘর ওঠাই। এটার মধ্যেই থাকতে শুরু করি। কয়েক দিন পর আরও দুটি টংঘর ওঠাই। ওই দুটো ভাড়া দেই। হাজার দুয়েক টাকা পেতাম। মাবিয়ার বয়স তখন চার। তাকে খিলগাঁও মডেল প্রাইমারি স্কুলে ভর্তি করাই। ওর মা তাকে স্কুলে দিয়ে আসত। আমি বেবি চালানো ছেড়ে রাস্তার পাশে তালকুশ বিক্রি করার কাজে লাগি। সেটা ছেড়ে দিয়ে কিছুদিন প্লাস্টিক বিক্রি করি। কিন্তু সংসারের অভাব দূর হয় না। দিনের রোজগার দিনেই শেষ। কতদিন ঘরের চুলো জ্বলেনি। তুবও কারও কাছে হাত পাতিনি। তিন ছেলে মেয়ে সবাই স্কুলে। অর্থাভাবে একপর্যায়ে ওদের কারোরই লেখাপড়া তেমন হয়ে ওঠেনি। ছেলে যৎসামান্য লেখাপড়া শিখে কাজ নেয় আবুল খায়ের গ্রুপে। এখন হাজার পাঁচেক টাকা মাইনে পায়। বড় মেয়ে আনজুম এসএসসি পাসের পর আর পড়তে পারেনি। সেলাইয়ের মেশিন কিনে দিই। সেটাতেই কাজ করে। মাসে হাজার দুয়েক টাকা আয় করে। পাশাপাশি উন্মুক্ত স্কুলে এইচএসসি পড়ছে। আর মাবিয়া? তাকে নিয়ে অনেক কথা। চার বছর বয়স থেকেই সে খেলতে শুরু করে। ঘরে, স্কুলে, মাঠে ও রাস্তায়। ছেলেদের মতো পোশাক পরে দাড়িয়াবান্দা, ডাংগুলি, গোল্লাছুট, হামাগুড়ি, ডিগবাজি, দড়ি লাফানো ছিল তার নিত্যাভ্যাস। এ নিয়েও অনেক কথা শুনতে হয়েছে। খেলার নেশা তাকে এমনভাবে পেয়ে বসে যে, তাকে বারণ করাও সম্ভব হতো না। একদিকে অভাবের সংসার অন্যদিকে খেলা নিয়ে তার মাতামাতি। তাতেও কোন ক্ষোভ ছিল না। এক পর্যায়ে অর্থাভাবে তার স্কুলে যাওয়াই বন্ধ হয়ে পড়ে। সে তার মতোই খেলত। একপর্যায়ে সে আনসার বাহিনীর হয়ে খেলার সুযোগ পায়। তাতেই বাজিমাত। প্রতিযোগিতায় নিজের অবস্থান পাকাপোক্ত করে। মাবিয়ার জীবনে আশীর্বাদ হয়ে দেখা দেন তার মামা কাজী শাহাদত হোসেন। তিনি জাতীয় বক্সিং ফেডারেশনের সাধারণ সম্পাদক। দীর্ঘদিন ছিলেন জাপানে। সেখান থেকে ২০১১ সালে দেশে ফিরে মাবিয়াকে উৎসাহ অনুপ্রেরণা দিতে থাকেন। একদিন তিনিই তাকে নিয়ে যান জাতীয় ক্রীড়া পরিষদে। সেখানে ভারোত্তলন শাখায় ভর্তি করান। তারপর শনৈঃশনৈ উন্নতি। একের পর এক ইভেন্টসে সাফল্যের পালক। আনসারের হয়ে পদক পাওয়ায় তাকে প্রথমে তিন হাজার পরে পাঁচ হাজার করে সম্মানী দেয়া হয়। একই সঙ্গে প্রতিদিন মাবিয়াকে ছুটতে হতো স্টেডিয়ামে। অনেক দিন তার পকেটে ভাড়াও থাকত না। সেখানকার কোচ তাকে বিশ পঞ্চাশ টাকা ভাড়াও দিয়ে দিতেন। কয়েক বছরেই মাবিয়ার নিজের অবস্থান আরও সূসংহত করেন। বিগত দুটো বাংলাদেশ গেমসে তিনি ভারোত্তলনে স্বর্ণপদক পান। তারপর নেপাল, ভারত, মালয়েশিয়া, কাতার, থাইল্যান্ডে একের পর এক শ্রেষ্ঠত্বের স্বাক্ষর রাখেন। সবচেয়ে কাক্সিক্ষত মুহূর্তটি আসে গত সাত ফেব্রুয়ারি। অসমের গৌহাটিতে এসএ গেমসে ভারোত্তলনে স্বর্ণপদক লাভ করেন। এদিন সকালেই মাবিয়া ফোন করে মাকে বলেছিলেন দুপুর আড়াইটায় টেলিভিশনের পর্দায় চোখ রাখতে। প্রচ- আত্মবিশ্বাসী মাবিয়া সকালেই মাকে ধারণা দিয়েছিলেন- স্বর্ণপদক পাওয়ার ব্যাপারে। যখন সময় টেলিভিশনের স্ক্রলে এ খবরটা প্রথম ব্রেক করা হয় তখন মা-বাবা আনন্দের বাঁধভাঙ্গা জোয়ারে ভেসে যান। কেঁদে ওঠেন তারা। মুহূর্তেই মহল্লায় শোরগোল শুরু হয়ে যায়। মানুষজন ফোন করতে থাকে। বাসায় লোকজন আসতে থাকে। মাবিয়ার বাবা-মাকে হতে হয় নানা কৌতূহলী সব প্রশ্নের মুখোমুখি। প্রতিবেশীদের অনেকেরই প্রশ্ন ছিল- এটা কী আপনার মেয়ে মাবিয়া? তখন বিব্রত হতে হয়েছে। বাবা-মায়ের উত্তর ছিল- কেন আমরা গরিব বলে কি মাবিয়া এমন পদক পেতে পারে না? বুধবার দুুপুরে যখন মাবিয়ার বাসায় যাই তখন তিনি বাসায় ছিলেন না। আগের রাতে তাকে ফোন করে ঘণ্টাখানেক সময় বাসায় থাকার কথা অনুরোধ করলেও তিনি থাকতে পারেননি। সকালেই বাসা থেকে বের হতে হয়েছে। কয়েকটি টেলিভিশনের সাক্ষাতকার, দুটো পত্রিকায় সংবর্ধনা আর সবশেষে এক ক্রীড়া কর্মকর্তার আমন্ত্রণে ব্যস্ত থাকতে হয়েছে দিনভর। পরে শুনি রাত এগারোটায় তিনি বাসায় ফেরেন। বাসায় তখন বাবা-মা ও ভাইবোন। সিপাহীবাগ নতুন সড়ক থেকে ঝিলের দিকে নেমে যাওয়া একটি ছোট বাঁশের সাকো দিয়ে বাসায় পৌঁছতে হয়। নিচে পানি কচুরিপানা। ওপরে বাঁশের টংঘর। মাচা দিয়ে তৈরি ঘরে যাওয়ার গলিপথ। ছোট্ট একটা ঘরের দুটো কামরা। একটা কামরায় থাকেন বাবা-মা। আরেকটাতে দুই বোন মাবিয়া ও আনজুম। ছেলে রাসেল নিচের আরেকটা চাটার বেড়ার আড়ালে। শুষ্ক মৌসুমে মোটামুটি ভাল কাটলেও বর্ষাতে অবস্থা নাকাল। মশা-মাছি পোকামাকড় আর সাপের উপদ্রব তো নিত্যসঙ্গী। জীর্ণ এ ঘরেই মাবিয়ার বেড়ে ওঠা। বেঁচে থাকা। এত দৈন্যদশাতেও মাবিয়া টলেনি। হেসে খেলে জীবনের দুঃখ জয় করার সংগ্রামে এগিয়েছে। সে নিয়ে কম বঞ্চনা সইতে হয়নি। মাবিয়া কেন ছেলেদের ড্রেস পরে খেলত, কেন রাত-বিরাতে ঘরে ফিরত- সে নিয়ে মহল্লার অনেকেই টিপ্পনি কাটত। নানা কথা শুনাত। সমালোচনা করত। অনেকেই উপদেশ দিত-মেয়ে বড় হয়েছে। এখন এগুলো ছাড়তে হবে। মানসম্মান বলে তো আর কিছু থাকবে না। অনেক দীর্ঘশ্বাস নিয়ে এসব তিক্ত অভিজ্ঞতার কথা বলতে গিয়ে হারুনুর রশিদ একপর্যায়ে কেঁদে ওঠেন। তিনি বলেন, মেয়ে আমার আজকের জায়গায় আসতে অনেক খড়কুটো পুড়তে হয়েছে। অনেক কষ্ট করেছে। না খেয়ে স্টেডিয়ামে গিয়েছে। তবুও কারও কাছে হাত পাতেনি। মানসম্মান বিকোয়নি। আমরা তাকে সান্ত¡না দিতাম, তুই তোর মতোই চল। কারও কথায় মন খারাপ করবি না। সবচেয়ে খারাপ লেগেছে, মাবিয়া স্বর্ণ জয় করে দেশে ফিরলেও এয়ারপোর্টে কেউ যায়নি। আর দশটা যাত্রীর মতোই ঘরে ফিরেছে। তারপর যখন সাংবাদিকরা এই ভাঙ্গাঘরে আসতে থাকল, পত্রিকায় খবর বের হলো তখন অনেকেই খোঁজ নিতে শুরু করল। মাননীয় প্রধানমন্ত্রী ঘোষণা দিলেন মাবিয়ার পরিবারের দায়িত্ব নেবেন বলে। গত সোমবার আসলেন ক্রীড়া সচিব। ফুল দিয়ে গেলেন। যাওয়ার সময় বলে গেলেন- আবার আসবেন প্রধানমন্ত্রীর অনুদান নিয়ে। হারুনুর রশিদের করুণ আবেদন- আমার তো থাকার জায়গা নেই। প্রধানমন্ত্রীর ঝুড়িতে তো অনেক কিছু থাকে। যদি মাথাগোঁজার একটা ঠাঁই করে দিতেন তাহলে আর দুঃখ থাকত না। মাবিয়ার মা আখতার বানু জানালেন, আরও অবিশ্বাস্য কাহিনী। মাবিয়া স্বর্ণ জিতবে এমনটা বিশ্বাসের উপায় ছিল না। সাফ গেমসে রওনা হওয়ার কয়েক দিন আগে অনুশীলনের সময় হাতে আঘাত পায়। সেই আঘাত নিয়ে খেলতে যেতে বারণ করেছিলেন চিকিৎসক। কিন্তু প্রচ- আত্মবিশ্বাসী মাবিয়া জেদ ধরলেন- এই হাত নিয়েই খেলতে যাবে। তার কোচও এতে সায় দেন। শেষপর্যন্ত মাবিয়া অসম যায়। ইনজুরি নিয়েই খেলল। সোনাও পেল। বাসায় বসে মাবিয়ার সঙ্গে ফোনে কথা হয়। কি তার টার্গেট। সুস্পষ্ট বললেন, আগামী আগস্টে অনুষ্ঠিতব্য অলিম্পিক গেমসে সোনা জয় করাই আমার এ মুহূর্তের লক্ষ্য। সফলতার শেষধাপে পৌঁছে দেশের জন্য সুনাম বয়ে আনাই আমার টার্গেট। এছাড়া আর কিছু ভাবছি না। মাবিয়ার বাবার জীবনেও রয়েছে সততার এক বিরল দৃষ্টান্ত। ১৯৯৯ সালে তিনি যখন বেবিট্যাক্সি চালাতেন তখন একদিন এক যাত্রীকে গুলশানের বাসায় পৌঁছে দেন। তাকে নামিয়ে দেখেন পেছনের সিটে একটি কালো ব্যাগ। তিনি তাৎক্ষণিক ওই বাসায় গিয়ে তা যাত্রীকে ফিরিয়ে দেন। এ সময় তাকে জানানো হয় ওই ব্যাগে ৩১ লাখ টাকা ছিল। তিনি যদি ফিরিয়ে না দিতেন করার কিছুই ছিল না। পরে এ ঘটনা শুনে অনেকেই বলত- কেন সেটা ফেরত দিলেন। ওটা দিয়েই তো জীবনের মোড় ঘুরিয়ে দিতে পারতেন। জবাবে হারুন বলতেন- পরের ধন মেরে জীবনে বাঁচার চেয়ে মরাও ভাল।
×