ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৬ এপ্রিল ২০২৪, ১২ বৈশাখ ১৪৩১

বাল্যবিয়ে ঠেকাতে দেশব্যাপী সাইকেল ভ্রমণ

‘হতে চাই না বিয়ের পাত্রী, হতে চাই স্কুলের ছাত্রী’

প্রকাশিত: ০৫:৩০, ১৮ ফেব্রুয়ারি ২০১৬

‘হতে চাই না বিয়ের পাত্রী, হতে চাই স্কুলের ছাত্রী’

সমুদ্র হক ॥ তার ভাগ্নি বালিকা বধূ হয়ে শ্বশুরবাড়িতে যাওয়ার পর শারীরিক ও মানসিক কি নির্যাতন সইতে হয়েছে তা চোখে দেখেছেন। তখনই বাল্যবিয়ে প্রতিরোধে জনসচেতনতা গড়ে তুলতে মাঠে নামেন। গ্রামের লোকজন বলেছে -একটি পাগল। তাদের কথায় গা করেননি তিনি। দোকান বেচে বাইসাইকেল কিনে তিনি বাল্যবিয়ে প্রতিরোধে সচেতন করতে সফরে বের হন। নিজ উদ্যোগে দেশের ৬৪ জেলায় গিয়ে উদ্বুদ্ধকরণের কাজ শুরু করেন। ৬৭ দিনের (২ মাস ৭ দিন) সফর শেষে বাড়িতে ফিরেও টাস্ক শেষ করেননি। এখন তিনি মাঠ পর্যায়ের স্কুলগুলোতে গিয়ে প্রচার শুরু করেছেন। সাইকেলের সামনের টিনের ফলকে লিখেছেন ‘হতে চাইনা বিয়ের পাত্রী, হতে চাই স্কুলের ছাত্রী।’ সাইকেলে চেপে এলাকায় ঘুরলে গ্রামের মেয়েরা হাততালি দিয়ে উৎসাহ দেয়। যে অভিভাবকদের সামান্যতম ইচ্ছে থাকে বালিকাকে বিয়ে দেবেন তারাও সাবধান হয়ে যান। সম্পূর্ণ নিজ উদ্যোগে জনস্বার্থে মাঠে নামা এই ব্যক্তির নাম আনোয়ার হোসেন তালুকদার। বয়স ৫০ পেরিয়েছে। এই বয়সেও তিনি তারুণ্যের শক্তিতে দ্রুতবেগে বাইসাইকেল চালান। বললেন, যমুনায় বঙ্গবন্ধু সেতুর ওপর দিয়েও সাইকেলে চেপে পার হতে চেয়েছিলাম। কর্তৃপক্ষ অনুমতি দেয়নি। পরে সেতু সংরক্ষণের গাড়ির পেছনে সাইকেল নিয়ে পার হয়েছেন। প্রথম দিকে প্রায় সকলেই পাগল বলেছে। এখন তারা প্রশংসা করে। তবে আনোয়ার হোসেনের ভাষ্যÑ সেদিনই এই প্রশংসা কাজে লাগবে যেদিন বাল্যবিয়ে দেশ থেকে দূর হবে। আনোয়ার হোসেনের বাড়ি বগুড়া সদরের নুনগোলায়। লেখাপড়া বেশিদূর এগোতে পারেননি। পঞ্চম শ্রেণী পাঠ শেষে দারিদ্র্যের কশাঘাতে তাকে সংসারের হাল ধরতে হয়। কাঠমিস্ত্রির কাজ শেখেন। এলাকায় তার খ্যাতি আছে। কাঠে ভাল নকশা করতে পারেন। কুমিল্লার দাউদকান্দিতে ফার্নিচার ডিজাইনের দোকান দেন। ভাগ্নির বাল্যবিয়ে ও নির্যাতন তাকে এতটাই ব্যথিত করে যে তিনি ৪০ হাজার টাকায় দোকান বেচে উদ্বুদ্ধকরণে সাইকেলে চেপে দেশ ভ্রমণের ধনুর্ভঙ্গ পণ করেন। প্রথমে দাউদকান্দি থেকে চট্টগ্রাম যান। এ সময় নানা ঝামেলায় পড়েন আনোয়ার। চট্টগ্রামের এক সরকারী কর্মকর্তা তাকে পরামর্শ দেন প্রতিটি জেলা সফর করার সময় জেলা প্রশাসক অথবা উপজেলা নির্বাহী অফিসারের সঙ্গে দেখা করে সহযোগিতা নিতে। এর আগে বগুড়ার ডিসির কাছ থেকে একটি প্রত্যয়নপত্র নেয়ার পরামর্শ দেন। সেই অনুযায়ী তিনি ’১৫ সালের ফেব্রুয়ারিতে বগুড়ার জেলা প্রশাসকের কাছ থেকে প্রত্যয়নপত্র নিয়ে দেশভ্রমণ শুরু করেন। প্রতিটি জেলায় গিয়ে তিনি সরকারী কর্মকর্তাদের সঙ্গে সাক্ষাত করে তার নিরবচ্ছিন্ন ভ্রমণের জন্য সহযোগিতা চান। সকলেই সহযোগিতার হাত বাড়িয়ে দেন। গার্লস স্কুলে গিয়ে প্রধান শিক্ষকের কাছে অনুমতি চান এ্যাসেমব্লিতে কথা বলার। বাল্যবিয়েতে স্বামী-স্ত্রীর জীবনের ঝুঁকি বাড়ে। বালিকা বধূ হয়ে সন্তান ধারণ করলে মাতৃ মৃত্যুর শঙ্কা থাকে। কোথাও বাল্যবিয়ের আয়োজন করলে তা জেনে প্রশাসন ও আইনপ্রয়োগকারী কর্তৃপক্ষকে জানানোর অনুরোধ করেন। বাল্যবিয়ে হলে জেল জরিমানা হতে পারে এমন বিষয় জানান এলাকায় ঘুরে ঘুরে। মেয়েদের স্কুলে তিনি কথা বলার অনুমতি চাইলে পেয়েছেন সংশ্লিষ্টদের সহযোগিতা। স্ত্রী ২ মেয়ে ২ ছেলে নিয়ে সংসার। দুই মেয়ের বিয়ে দিয়েছেন নির্ধারিত বয়সে। দোকান বিক্রির টাকা বাড়িতে রেখে কিছু টাকা সঙ্গে নিয়ে বের হন দেশ সফরে। ভ্রমণে যেখানে টাকার প্রয়োজন হয় তখন বাড়িতে মোবাইল ফোনে জমানো টাকা থেকে ৫শ’ টাকা বিকাশ করার কথা বললে টাকা পাঠিয়ে দেয়া হয়। যেখানে রাত সেখানে ডাকবাংলোতে থাকার অনুমতি চান। অনেক সময় দুর্বৃত্তের কবলেও পড়েছেন আনোয়ার। তবে পুলিশ তাকে সহযোগিতা করেছে। বগুড়ার প্রতিটি গ্রামে তিনি বাল্যবিয়ে বন্ধে লোকজনকে বোঝান। স্কুলে গিয়ে কোমলমতি শিশুদের ডেকে বলেন, শিশু বয়সে যেন কেউ বিয়ের পিঁড়িতে না বসে। তারপরও যদি কোন বাবা-মা বিয়ের আয়োজন করে সঙ্গে সঙ্গে যেন তাকে খবর দেয়া হয়। আগে যে লোকজন তাকে পাগল বলে ঠাওরেছিল তারাই এখন তার সঙ্গে কাজ করছে। এটাই তার বড় প্রাপ্তি। বললেন, মানুষ সচেতন হলে সকল অন্যায় দূর হয়ে যাবে। সাইকেলের সামনে লাল রঙের টিনে লেখা পড়ে স্কুলের শিশুরা স্লোগান দেয় ‘হতে চাইনা বিয়ের পাত্রী, হতে চাই স্কুলের ছাত্রী।’
×